চারদিক-অবাঙালি মুক্তিযোদ্ধা জহির by আবদুর রব
তিনি ‘কওমকি গাদ্দার’ উপাধি পেয়েছিলেন। অবাঙালি জহির আহম্মদ খান নামেও লোকে তাঁকে চেনেন। আবার ন্যাংড়া (খোঁড়া) জহির বললেও যে কেউ তাঁকেচিনে নেন। প্রতিবন্ধী মানুষের নামের সঙ্গে ‘ন্যাংড়া’ ‘খোঁড়া’ যোগ করতে নেই, কিন্তু এলাকার মানুষ কি আর সে সব মানে? তাই একজন মানুষের নামের সঙ্গে যুক্ত হয় এসব শব্দ।
জহির আহম্মদ খানের সঙ্গে কথা হয় মধ্যদুপুরে। তাঁর এখন অলস সময়। একটি পানের দোকান দিয়েছেন তিনি। এই পানের দোকানে এ সময় ক্রেতার আনাগোনাও অনেকটা কম।
লালমনিরহাট জেলা শহরের যেখানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সভা-সমাবেশ হয়, সেখানেই ছুটে যান এই মানুষটি। শুধু কি তাই! আশপাশের এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে সেখানেও ছুটে যান তিনি। জানাজায় অংশ নেন, কবরস্থানে ছুটে যান তাঁদের শেষ বিদায় জানাতে।
জহির খান লালমনিরহাট জেলা শহরের মোগলহাট রেলগেটের পাশেই নর্থ বেঙ্গল গেস্ট হাউসের বাইরে একটি অস্থায়ী পানের দোকান করেন। টানাপোড়েনের জীবন তাঁর। কষ্টে-শিষ্টে কেটে যাচ্ছে সময়। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খান।
১৯৪৭ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম জহিরের। তাঁর পিতা ওয়াসিদ খান আর মা খাতুন বিবি। জহির আহম্মদ খানের দাদার বাড়ি ভারতের আসানসোলে আর নানার বাড়ি ভাগলপুরে। জহিরের বাবা ওয়াসিদ খানের পিতা ভুরে খান মিস্ত্রি ব্রিটিশ আমলে রেলের চাকরি নিয়ে লালমনিরহাটে আসেন। এই পরিবারে আগাগোড়া উর্দুর পাশাপাশি বাংলার চর্চা ছিল। ভারত থেকে এসেছিলেন তাঁরা। তাঁরা অবাঙালি পরিবার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান আমলে এই পরিবারের সদস্যরা উর্দুভাষী হওয়ার পরও মুসলিম লীগ না করে আওয়ামী লীগ করেছিল। পরিণামে সে সময়ে লালমনিরহাটের প্রভাবশালী বিহারি নেতা হাফেজ কমর উদ্দিন খান এই পরিবারের সদস্যদের ‘কওমকি গাদ্দার’ (সমপ্রদায়ের শত্রু) আখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই পরিবারে দুই সদস্য ফরিদ আহম্মদ খান ও জহির আহম্মদ খানকে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে হত্যা করার জন্য লালমনিরহাটের বিহারীরা হন্যে হয়ে খুঁজেছে। সেই গল্পগুলো জহির এখনো হুবহু বলে দিতে পারেন।
জহির আহম্মেদ খান অবাঙালি পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত লালমনিরহাটে দেশের কাজে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর আর এক ভাই ফরিদ আহম্মেদ খানও দেশের মুক্তির আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
জহির আহম্মেদ খান বলেন, ‘অবাঙালি হয়েও আমরা ছিলাম বাংলাদেশের প্রেমিক। আমার ভাই আর আমি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে যে দুবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লালমনিরহাটে এসেছিলেন, আমি সে দুবারই তাঁর জনসভার প্রচারণার জন্য প্রকাশ্যে মাইকিং করেছিলাম। আর এই কারণে বিহারিরা আমাদের ‘কওমকী গাদ্দার’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করার জন্য পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় হন্যে হয়ে খুঁজেছে।
জহির সেসব কথা বলতে বলতে আবার পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল লালমনিরহাটের মোগলহাট সীমান্তপথে ভারতে যাই। বয়সে যুবক হলেও বাম পা খোঁড়া হওয়ায় আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র প্রশিক্ষণে যেতে পারিনি। লালমনিরহাটে ফিরে আসলে বিহারিরা আমাদের হত্যা করবে। তাই লালমনিরহাটে ফিরে না এসে অনেক পথ ঘুরে আমার মামা রসুল মামুদের গ্রামের বাড়ি রংপুরের খটখটিয়া গ্রামে চলে যাই।’
রংপুরের খটখটিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমানের পরামর্শে ও সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবর সংগ্রহ, খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং গোপন স্থানে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার কাজ করেন জহির খান। ১৯৭১ সালের মে জুন মাস থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত খটখটিয়াসহ এর আশপাশের এলাকায় এভাবেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই ১৫-২০টি আবেদন করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। লালমনিরহাট মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় (অন্তর্ভুক্তি) ৬১ নম্বরে তাঁর নাম রয়েছে, কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের অজুহাতে তাঁর নাম এখনো মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লালমনিরহাট ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার আলহাজ ইউসুফ আলী বলেন, সহমুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিদার জহির আহম্মেদ খানের নাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খোন্দকার নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় (অন্তর্ভুক্তি) রয়েছে। তবে চূড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি।
লালমনিরহাট (৬ নম্বর সেক্টর) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলহাজ আবুল হোসেন বলেন, একজন অবাঙালি পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও জহির আহম্মেদ খান মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে স্থানীয়ভাবে অন্যদের সঙ্গে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অভাবের সংসার জহিরের। তাঁর স্ত্রী জোহরা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীর পরিবারের সদস্যরা উর্দুভাষী হলেও আমরা তো বাঙালি, আমার এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিজেদের বাঙালি বলেই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলে আমাদের পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুখী হতো এবং আরও গর্ববোধ করত।
আবদুর রব
লালমনিরহাট প্রতিনিধি
লালমনিরহাট জেলা শহরের যেখানেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সভা-সমাবেশ হয়, সেখানেই ছুটে যান এই মানুষটি। শুধু কি তাই! আশপাশের এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে সেখানেও ছুটে যান তিনি। জানাজায় অংশ নেন, কবরস্থানে ছুটে যান তাঁদের শেষ বিদায় জানাতে।
জহির খান লালমনিরহাট জেলা শহরের মোগলহাট রেলগেটের পাশেই নর্থ বেঙ্গল গেস্ট হাউসের বাইরে একটি অস্থায়ী পানের দোকান করেন। টানাপোড়েনের জীবন তাঁর। কষ্টে-শিষ্টে কেটে যাচ্ছে সময়। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খান।
১৯৪৭ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম জহিরের। তাঁর পিতা ওয়াসিদ খান আর মা খাতুন বিবি। জহির আহম্মদ খানের দাদার বাড়ি ভারতের আসানসোলে আর নানার বাড়ি ভাগলপুরে। জহিরের বাবা ওয়াসিদ খানের পিতা ভুরে খান মিস্ত্রি ব্রিটিশ আমলে রেলের চাকরি নিয়ে লালমনিরহাটে আসেন। এই পরিবারে আগাগোড়া উর্দুর পাশাপাশি বাংলার চর্চা ছিল। ভারত থেকে এসেছিলেন তাঁরা। তাঁরা অবাঙালি পরিবার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান আমলে এই পরিবারের সদস্যরা উর্দুভাষী হওয়ার পরও মুসলিম লীগ না করে আওয়ামী লীগ করেছিল। পরিণামে সে সময়ে লালমনিরহাটের প্রভাবশালী বিহারি নেতা হাফেজ কমর উদ্দিন খান এই পরিবারের সদস্যদের ‘কওমকি গাদ্দার’ (সমপ্রদায়ের শত্রু) আখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই পরিবারে দুই সদস্য ফরিদ আহম্মদ খান ও জহির আহম্মদ খানকে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে হত্যা করার জন্য লালমনিরহাটের বিহারীরা হন্যে হয়ে খুঁজেছে। সেই গল্পগুলো জহির এখনো হুবহু বলে দিতে পারেন।
জহির আহম্মেদ খান অবাঙালি পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত লালমনিরহাটে দেশের কাজে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর আর এক ভাই ফরিদ আহম্মেদ খানও দেশের মুক্তির আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
জহির আহম্মেদ খান বলেন, ‘অবাঙালি হয়েও আমরা ছিলাম বাংলাদেশের প্রেমিক। আমার ভাই আর আমি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে যে দুবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লালমনিরহাটে এসেছিলেন, আমি সে দুবারই তাঁর জনসভার প্রচারণার জন্য প্রকাশ্যে মাইকিং করেছিলাম। আর এই কারণে বিহারিরা আমাদের ‘কওমকী গাদ্দার’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করার জন্য পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় হন্যে হয়ে খুঁজেছে।
জহির সেসব কথা বলতে বলতে আবার পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল লালমনিরহাটের মোগলহাট সীমান্তপথে ভারতে যাই। বয়সে যুবক হলেও বাম পা খোঁড়া হওয়ায় আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র প্রশিক্ষণে যেতে পারিনি। লালমনিরহাটে ফিরে আসলে বিহারিরা আমাদের হত্যা করবে। তাই লালমনিরহাটে ফিরে না এসে অনেক পথ ঘুরে আমার মামা রসুল মামুদের গ্রামের বাড়ি রংপুরের খটখটিয়া গ্রামে চলে যাই।’
রংপুরের খটখটিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমানের পরামর্শে ও সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবর সংগ্রহ, খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং গোপন স্থানে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার কাজ করেন জহির খান। ১৯৭১ সালের মে জুন মাস থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত খটখটিয়াসহ এর আশপাশের এলাকায় এভাবেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই ১৫-২০টি আবেদন করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। লালমনিরহাট মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় (অন্তর্ভুক্তি) ৬১ নম্বরে তাঁর নাম রয়েছে, কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের অজুহাতে তাঁর নাম এখনো মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লালমনিরহাট ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার আলহাজ ইউসুফ আলী বলেন, সহমুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিদার জহির আহম্মেদ খানের নাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খোন্দকার নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় (অন্তর্ভুক্তি) রয়েছে। তবে চূড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি।
লালমনিরহাট (৬ নম্বর সেক্টর) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলহাজ আবুল হোসেন বলেন, একজন অবাঙালি পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও জহির আহম্মেদ খান মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে স্থানীয়ভাবে অন্যদের সঙ্গে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অভাবের সংসার জহিরের। তাঁর স্ত্রী জোহরা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীর পরিবারের সদস্যরা উর্দুভাষী হলেও আমরা তো বাঙালি, আমার এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিজেদের বাঙালি বলেই পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করে। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলে আমাদের পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুখী হতো এবং আরও গর্ববোধ করত।
আবদুর রব
লালমনিরহাট প্রতিনিধি
No comments