সাড়ে বত্রিশ ভাজা by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সকাল সকাল মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা দেখে ঘাবড়ে যাই। জাকির মামার জরুরি তলব। তিনি লিখেছেন, ‘জলদি আয়। বিপদ!’ আমার ডেরা থেকে মামার বাসা বেশি দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলাম মামার সাত মসজিদ রোডের বাসায়।
মামাকে দেখে আমি অবাক। গাল বাঁকা করে আজব ভঙ্গিতে হাঁ করে আছেন তিনি। আমার ছানাবড়া চোখ দেখে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন মামা। এতে লেখা, ‘চোয়ালের ব্যায়াম করছিলাম। হঠাৎ কট্ করে একটা আওয়াজ। তারপর থেকে এ অবস্থা। মুখের নড়ন-চড়ন বন্ধ। চোয়ালের হাড় ডিসপ্লেসড হলো কি না। আমাকে শিগগির ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।’
রাজধানীতে মামা আমার একমাত্র মুরব্বি। বিপদ-আপদের ভরসা। এই তো সেদিন বেকায়দায় পড়ে মামার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলাম। চেয়েছিলাম দুই হাজার টাকা। মামা চেহারায় পাঁচ এঁকে ফোঁস ফোঁস্র করে বললেন, ‘মাসের শেষে আসিস খালি ঝামেলা করতে।’ তারপর নোট একখান ধরিয়ে দিয়ে টিপস দিলেন, ‘এখানে বসে বসে নিজেও দূষিত হচ্ছিস, শহরটারও জঞ্জাল বাড়াচ্ছিস। এর চেয়ে গ্রামে গিয়ে হাঁস-মুরগির খামার করলেই তো পারিস। এক হালি ডিমের দাম এখন কত, জানিস?’
কাজেই মামার বিপদ মানে আমার বিপদ। একটি প্রতিষ্ঠানের বিলিং সেকশনে আছেন তিনি। বয়স কম নয়। পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। একদিন পাশের টেবিলে সমবয়সী এক সহকর্মী তাঁর সামনেই চিৎপটাং। না, পটল তোলেননি। পড়ে গিয়ে হাসপাতালে। ডাক্তার সব চাপালেন উপরি আয়ের সোহাগে বেড়ে ওঠা ভুঁড়ির ওপর। চর্বি থেকে কোলেস্টেরোল বেড়েছে। তা থেকে মাইল্ড স্ট্রোক। চোখের সামনে এই নজির দেখে মামার টনক নড়েছে। শরীর ঠিক রাখতে ব্যায়াম ধরেছেন। সেই ব্যায়াম থেকে এই বিপত্তি।
কিন্তু মামি কোথায়? বাসার আর সবাই?
মামাকে এ কথা জিজ্ঞেস করতেই হাতের কাছে রাখা প্যাডে বলপেন দিয়ে খস্খস্ করে লিখলেন, ‘মরতে গেছে!’
বেগতিক দেখে ঝামেলা বাড়ালাম না। মামির জন্য একটা চিরকুট ফেলে তা রাখলাম চোখে পড়ার মতো জায়গায়। এবার মামাকে নিয়ে রওনা হলাম একটা ক্লিনিকের দিকে।
ক্লিনিকের রিসেপশনে থাকা দুজন মামাকে দেখে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাল। একজন মামার হাঁ করা চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। দ্বিতীয়জন হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘স্ট্রোক নাকি? এই হামজা, এই সতু...হুইল চেয়ার!’
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই লোক গড়গড় করে একটা হুইল চেয়ার এনে মামাকে ঠেসে বসিয়ে দিল। তারপর একজন সামনে আরেকজন পেছনে ছুটতে লাগল হুইল চেয়ার নিয়ে। সঙ্গে নাদান আমি। মাথায় তড়াক তড়াক লাফাচ্ছে দুশ্চিন্তা—কী জানি, স্ট্রোকই নয় তো? হতেও পারে। কে বলবে? ব্রেইন স্ট্রোকে এমন গাল বাঁকা হয় শুনেছি।
হুইল চেয়ার ঢুকে গেল জরুরি বিভাগে। মামাকে দুই জওয়ান চ্যাংদোলা করে আটার বস্তার মতো ফেলল একটা বিছানায়। শুকনো চেহারার একজন ডিউটি ডাক্তার এসে মামার হাঁ করা মুখের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। মামা কটমট করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। এই ফাঁকে সমস্যা বোঝাতে সচেষ্ট হলাম।
বললাম, ‘ব্যায়াম করতে গিয়ে এই অবস্থা।’
‘হুঁ, মনে হচ্ছে ব্রেইন স্ট্রোক।’
ভারিক্ক্রিচালে বললেন একজন। তাকিয়ে দেখি আরেক চিকিৎসক। চেহারা, বেশভূষা সব মিলিয়ে ডিউটি ডাক্তারের চেয়ে ভারি। দুই ডাক্তার মিলে মামাকে স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করলেন। প্রেশার মেপে দেখলেন। টিপেটুপে কাতচিৎ করে কী যেন দেখলেন। তারপর ভারিক্কি ডাক্তার লিখে দিলেন বেশ কিছু পরীক্ষার নাম। সবই জরুরি। এর মধ্যেই হাতের ইশারায় মামা বোঝালেন কাগজ-কলম চাই। সে ব্যবস্থা করার আগেই নতুন দুজন লোক এসে রিলিফের মালের মতো মামাকে নিয়ে রওনা হলো। আমি কিছু বলতে চেষ্টা করলাম। তার আগেই জবাব এল, ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, টেস্ট!’
এদিকে মামার ভর্তির ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সাধারণ ওয়ার্ডে সিট নেই। ছয় তলায় একটা কেবিন নেওয়া হয়েছে। তবে মামার এখনো আরেকটা পরীক্ষা বাকি। আমি কেবিনে অপেক্ষা করছি তাঁর জন্য। এসির ঠান্ডায়ও ঘামছি। ভাবলাম, এবার মামিকে জানাই। মোবাইলে ফোন করতেই ওপাশ থেকে মামির কান্না জড়ানো কণ্ঠ, ‘বাজারে গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনে তোর মামার মেসেজ পেয়ে আমি তো অস্থির। রাস্তায় এত্তো জ্যাম—বাসায় পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তোর চিরকুট পেয়েছি। তোরা এখন কোথায়?’
মামিকে খুলে বললাম সব। মিনিট বিশেকের মধ্যে মামি আর মামাতো ভাইবোন এসে হাজির। সঙ্গে মামার একজন বিজ্ঞ শ্যালকও এসেছেন। তিনি বারবার তাঁর বোন ও ভাগনে-ভাগনিকে সুপরামর্শ দিচ্ছেন—সময় থাকতে সম্পত্তি আর টাকাপয়সার বিষয়টা বুঝে নাও। কোথায় কী আছে জেনে নাও সব। কখন কী হয়—বলা যায়? এসব কথায় মামি চিকন সুরে মাতম শুরু করলেন। তাঁর ছেলেমেয়ের চোখ ছানাবড়া।
এর মধ্যে মামাকে এনে শোয়ানো হলো বিছানায়। মামা পারলে দৃষ্টির আগুনে ভস্ম করে দেন আমাকে। সতেজে হাত ঝাঁকিয়ে আবার কাগজ-কলম নিয়ে আসার ইঙ্গিত করলেন তিনি। ছুটে গিয়ে নিয়ে এলাম কাগজ-কলম। মামা খস্খস্ করে লিখলেন, ‘একটু খাড়া হয়ে নিই, আমাকে এনে এই সাড়ে বত্রিশ ভাজার মধ্যে ফেলার মজাটা টের পাইয়ে দেব! এরা আসল ডাক্তার কি না, খোঁজ নিয়েছিস আহাম্মক? আদৌ কোনো সার্টিফিকেট আছে এদের?’
সে খোঁজ নেওয়ার আগেই একগাদা টেস্ট আর ভর্তির বিল এসে হাজির। মামা এমনভাবে সে বিলের দিকে তাকালেন, তা যেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য কিছু দেখছেন। এমন সময় কট্ করে মৃদু আওয়াজে সোজা হয়ে গেল মামার চোয়াল। তারপর তিনি হুঙ্কারের আদলে আর্তনাদ ছাড়লেন, ‘ওরে, আমার তো এখনই আসল স্ট্রোক করবে রে!’
রাজধানীতে মামা আমার একমাত্র মুরব্বি। বিপদ-আপদের ভরসা। এই তো সেদিন বেকায়দায় পড়ে মামার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলাম। চেয়েছিলাম দুই হাজার টাকা। মামা চেহারায় পাঁচ এঁকে ফোঁস ফোঁস্র করে বললেন, ‘মাসের শেষে আসিস খালি ঝামেলা করতে।’ তারপর নোট একখান ধরিয়ে দিয়ে টিপস দিলেন, ‘এখানে বসে বসে নিজেও দূষিত হচ্ছিস, শহরটারও জঞ্জাল বাড়াচ্ছিস। এর চেয়ে গ্রামে গিয়ে হাঁস-মুরগির খামার করলেই তো পারিস। এক হালি ডিমের দাম এখন কত, জানিস?’
কাজেই মামার বিপদ মানে আমার বিপদ। একটি প্রতিষ্ঠানের বিলিং সেকশনে আছেন তিনি। বয়স কম নয়। পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। একদিন পাশের টেবিলে সমবয়সী এক সহকর্মী তাঁর সামনেই চিৎপটাং। না, পটল তোলেননি। পড়ে গিয়ে হাসপাতালে। ডাক্তার সব চাপালেন উপরি আয়ের সোহাগে বেড়ে ওঠা ভুঁড়ির ওপর। চর্বি থেকে কোলেস্টেরোল বেড়েছে। তা থেকে মাইল্ড স্ট্রোক। চোখের সামনে এই নজির দেখে মামার টনক নড়েছে। শরীর ঠিক রাখতে ব্যায়াম ধরেছেন। সেই ব্যায়াম থেকে এই বিপত্তি।
কিন্তু মামি কোথায়? বাসার আর সবাই?
মামাকে এ কথা জিজ্ঞেস করতেই হাতের কাছে রাখা প্যাডে বলপেন দিয়ে খস্খস্ করে লিখলেন, ‘মরতে গেছে!’
বেগতিক দেখে ঝামেলা বাড়ালাম না। মামির জন্য একটা চিরকুট ফেলে তা রাখলাম চোখে পড়ার মতো জায়গায়। এবার মামাকে নিয়ে রওনা হলাম একটা ক্লিনিকের দিকে।
ক্লিনিকের রিসেপশনে থাকা দুজন মামাকে দেখে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাল। একজন মামার হাঁ করা চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। দ্বিতীয়জন হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘স্ট্রোক নাকি? এই হামজা, এই সতু...হুইল চেয়ার!’
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই লোক গড়গড় করে একটা হুইল চেয়ার এনে মামাকে ঠেসে বসিয়ে দিল। তারপর একজন সামনে আরেকজন পেছনে ছুটতে লাগল হুইল চেয়ার নিয়ে। সঙ্গে নাদান আমি। মাথায় তড়াক তড়াক লাফাচ্ছে দুশ্চিন্তা—কী জানি, স্ট্রোকই নয় তো? হতেও পারে। কে বলবে? ব্রেইন স্ট্রোকে এমন গাল বাঁকা হয় শুনেছি।
হুইল চেয়ার ঢুকে গেল জরুরি বিভাগে। মামাকে দুই জওয়ান চ্যাংদোলা করে আটার বস্তার মতো ফেলল একটা বিছানায়। শুকনো চেহারার একজন ডিউটি ডাক্তার এসে মামার হাঁ করা মুখের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। মামা কটমট করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। এই ফাঁকে সমস্যা বোঝাতে সচেষ্ট হলাম।
বললাম, ‘ব্যায়াম করতে গিয়ে এই অবস্থা।’
‘হুঁ, মনে হচ্ছে ব্রেইন স্ট্রোক।’
ভারিক্ক্রিচালে বললেন একজন। তাকিয়ে দেখি আরেক চিকিৎসক। চেহারা, বেশভূষা সব মিলিয়ে ডিউটি ডাক্তারের চেয়ে ভারি। দুই ডাক্তার মিলে মামাকে স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করলেন। প্রেশার মেপে দেখলেন। টিপেটুপে কাতচিৎ করে কী যেন দেখলেন। তারপর ভারিক্কি ডাক্তার লিখে দিলেন বেশ কিছু পরীক্ষার নাম। সবই জরুরি। এর মধ্যেই হাতের ইশারায় মামা বোঝালেন কাগজ-কলম চাই। সে ব্যবস্থা করার আগেই নতুন দুজন লোক এসে রিলিফের মালের মতো মামাকে নিয়ে রওনা হলো। আমি কিছু বলতে চেষ্টা করলাম। তার আগেই জবাব এল, ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, টেস্ট!’
এদিকে মামার ভর্তির ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সাধারণ ওয়ার্ডে সিট নেই। ছয় তলায় একটা কেবিন নেওয়া হয়েছে। তবে মামার এখনো আরেকটা পরীক্ষা বাকি। আমি কেবিনে অপেক্ষা করছি তাঁর জন্য। এসির ঠান্ডায়ও ঘামছি। ভাবলাম, এবার মামিকে জানাই। মোবাইলে ফোন করতেই ওপাশ থেকে মামির কান্না জড়ানো কণ্ঠ, ‘বাজারে গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনে তোর মামার মেসেজ পেয়ে আমি তো অস্থির। রাস্তায় এত্তো জ্যাম—বাসায় পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তোর চিরকুট পেয়েছি। তোরা এখন কোথায়?’
মামিকে খুলে বললাম সব। মিনিট বিশেকের মধ্যে মামি আর মামাতো ভাইবোন এসে হাজির। সঙ্গে মামার একজন বিজ্ঞ শ্যালকও এসেছেন। তিনি বারবার তাঁর বোন ও ভাগনে-ভাগনিকে সুপরামর্শ দিচ্ছেন—সময় থাকতে সম্পত্তি আর টাকাপয়সার বিষয়টা বুঝে নাও। কোথায় কী আছে জেনে নাও সব। কখন কী হয়—বলা যায়? এসব কথায় মামি চিকন সুরে মাতম শুরু করলেন। তাঁর ছেলেমেয়ের চোখ ছানাবড়া।
এর মধ্যে মামাকে এনে শোয়ানো হলো বিছানায়। মামা পারলে দৃষ্টির আগুনে ভস্ম করে দেন আমাকে। সতেজে হাত ঝাঁকিয়ে আবার কাগজ-কলম নিয়ে আসার ইঙ্গিত করলেন তিনি। ছুটে গিয়ে নিয়ে এলাম কাগজ-কলম। মামা খস্খস্ করে লিখলেন, ‘একটু খাড়া হয়ে নিই, আমাকে এনে এই সাড়ে বত্রিশ ভাজার মধ্যে ফেলার মজাটা টের পাইয়ে দেব! এরা আসল ডাক্তার কি না, খোঁজ নিয়েছিস আহাম্মক? আদৌ কোনো সার্টিফিকেট আছে এদের?’
সে খোঁজ নেওয়ার আগেই একগাদা টেস্ট আর ভর্তির বিল এসে হাজির। মামা এমনভাবে সে বিলের দিকে তাকালেন, তা যেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য কিছু দেখছেন। এমন সময় কট্ করে মৃদু আওয়াজে সোজা হয়ে গেল মামার চোয়াল। তারপর তিনি হুঙ্কারের আদলে আর্তনাদ ছাড়লেন, ‘ওরে, আমার তো এখনই আসল স্ট্রোক করবে রে!’
No comments