তোমার জন্য হে মহাসমাবেশ! by ফজলুল বারী

তোমার জন্য হে মহাসমাবেশ, ঢাকা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হল দেশ!/থামিয়ে দেওয়া হল মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস আর নদীতে হাঁসের মতো সাঁতরে আসা লঞ্চের চাকা!/ তন্ন তন্ন সব দেহ খোঁজা হল চেকপোস্টে, ভ্রাম্যমাণ আদালতে,/ তোমার জন্য ফের গণগ্রেফতার চালালো পুলিশ,/

রোজগেরে ছেলেটাকে থানার গারদে আটকা দেখে হাউমাউ কাঁদলেন নিরুপায় মা/ থানা-কোর্ট পাড়ার আশপাশে গণগ্রেফতার আর জামিন বাণিজ্যে খুশি খুশি পুলিশ-উকিলগন/ তাদের ক্যাশিয়ারদের ফিসফাস দর কষাকষি- ‘এই টাকার মইধ্যে ছাড়া আমি নাই কইয়া দিলাম কিন্তু’/এসবই তোমার জন্য।  

তোমার জন্য হে মহাসমাবেশ, ক্ষমতার দিলখুশ আড়মোড়া ভেঙে উপেক্ষিত চৌদ্দদলের হাত ধরে ‘আবার এসো প্রিয়’ বলে গণমিছিল, মানববন্ধন করেছে আওয়ামী লীগ,/ আবার একখান করবে বলেছে ১৪ মার্চ/ উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি চিন্তিত!/ ‘একটি অনুমতি দাও, ‘হে প্রিয় পুলিশ’/ আবেদনপত্র হাতে ডিএমপির সদর দফতরে ধর্ণা দিয়েছেন ভবিষ্যতে মন্ত্রী হতে ইচ্ছুক বিএনপির নেতারা।/ ১১টি শর্তে দয়া(!) দেখিয়ে ডিএমপি বলেছে- এই নাও অনুমতি দিলাম/ তবে শর্তের বাইরে গেলে কিন্তু ‘খবর আছে’!/ ফকিরাপুল থেকে নাইটেঙ্গেল পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে মহাসমাবেশের সীমানা!/ বলেছে- এর বাইরে কাউকে পাওয়া গেলে কিন্তু ধাওয়া!/ অতঃপর একান্ত অনুগত ছাত্রের মত,/ লাজ-নম্র বিএনপি নতুন আবেদনে অনুনয় করে বলেছে- আরেকটু জায়গা দাও ‘হে প্রিয় পুলিশ, প্লিজ দাও না!’/ এর সবই হে মহাসমাবেশ তোমার জন্য।

তোমার জন্যে হে মহাসমাবেশ, আগামীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক ‘একদার তুখোড় নিরপেক্ষ(!) সাংবাদিক’ শফিক রেহমান,/ ম্যাডামের জন্য বিশাল একখানা বক্তৃতানামা লিখেছেন!/ পাছে যদি হয় ভুল, অথবা আবার যদি জোসে ‘লুলা-ল্যাংড়া করে দেবার’ কথা বলে বসেন ম্যাডাম,/ তাই ইচ্ছে ছিল, শ্যাম্পেনের মৌতাতে ভরপুর সম্পূর্ণ রঙিন বক্তৃতানামার পুরোটা লিখিত পড়বেন।/ কিন্তু পাছে যদি ফের, জনসভার বক্তৃতা তোতা পাখির মত লিখিত পড়ার কথা উল্লেখ করে/ স্বভাবসুলভ টিপ্পনি কাটেন প্রধানমন্ত্রী!/ অতএব পুরোটা লিখিত পড়ার সিদ্ধান্ত, ডিলিট-বাদ/ প্রিয়দর্শিনী ম্যাডাম এখন পয়েন্ট টু পয়েন্ট দেখে দেখে বলবেন।/ বলে দিবেন এ সরকারের মৃত্যু ঘোষণা ‘আলবিদা নামা!’/ কারণ এরা ক্ষমতায় থাকলে আমার প্রিয় সব জামায়াতি যুদ্ধাপরাধী আর/ মাসুম দুই বাচ্চার বিচার করে ফেলবে!/ অতএব আজ আবার বলে দেব, দূর হ’!/ এর সবই শুধু তোমার জন্য।

তোমার জন্য হে মহাসমাবেশ, পুলিশের মাইরের ডরে গর্তের ভেতর ঢুকে যাওয়া জামায়াত-শিবির/ ফের শক্তি দেখাতে খুশি খুশি ‘গেট রেডি’!/ ‘ঢাকা যদি না যাও তবে পাঁচশ টাকা দাও’/ শিরোনামের আন্তঃদলীয় ফতোয়াও জারি করেছে পাকিস্তান ভায়া বেহেস্তমুখী(!) যুদ্ধাপরাধীদের দলটি।/ হে মহাসমাবেশ তোমার জন্য জানাও গেল, রুইকাতলা যুদ্ধাপরাধী নেতারা জেলে থাকাতে তাদের মালে টান পড়ার খবর!/


গোয়েন্দা রিপোর্ট নাকি বলেছে- ঝোপ বুঝে কোপ মারার নাশকতার জন্য তৈরি ‘হিযবুত তাহরীর!’/ আর জেএমবি কাম হরকাতুল জিহাদ!/ পাছে ‘চোর যাবার পর বুদ্ধি বাড়ার’ কলঙ্ক যদি হয়’,/ সে দুশ্চিন্তায় শীর্ষ কথিত গোয়েন্দাদের ঘুম নেই!/ এর সবই তোমার জন্য।

তোমার জন্য হে মহাসমাবেশ, যার যার নেত্রীর নেকনজরে পড়ার-থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে দেশের টিভি চ্যানেল গং!/ প্রতিযোগিতার শিরোনাম ‘লাইভ টেলিকাস্ট করুম অথবা করুম না!’/ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু’ আপাতত তাদের কিতাবে বাদ!/ অথবা তাদের টাকা খেয়ে ওসব কথা কী আর বলা সাজে?/ জমকালো প্রতিযোগিতায় আবার সবার উপরে ‘আমি সত্য’ চ্যাম্পিয়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ বিটিআরসি! মহাসমাবেশকে নাজায়েজ ফতোয়া আরোপ করে/ তাদের সংবিধিবদ্ধ(!) হুঁশিয়ারিটির নাম ‘জনস্বার্থে লাইভ টেলিকাস্ট না করার অনুরোধ’! এর সবই তোমার জন্য।

তোমার জন্যে হে মহাসমাবেশ, দেশের একপক্ষের মনে বইছে আরব বসন্তের মাতাল সমীরণ/ আর আরেক পক্ষে তৈরি হয়েছে ‘ভয়’! ‘করিছিনু পণ তোমারে আর দিব না খেতে ক্ষমতার রসগোল্লা!’/ অথবা ‘তোমারে বসিতে দিব না রাজপথে’, ‘ফকিরাপুল টু নাইটেঙ্গেল ছাড়া গোটা ঢাকা শহর আমার’/ ক্ষমতার এমন একটি প্রকাশ্য কামড়াকামড়িতে উদ্বিগ্ন-ছারখার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল!/ আবার কী আসবেন একজন নূর হোসেন?/ আগেরবারের মত যিনি যুবলীগের না,/ কোনো একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী(!) অথবা এক চিমটে জামায়াত মিশেল!/ এমন একটি রোদের অক্ষরে লেখা লাশ কী মিলবে আজ?/ মিলাবে কী প্রিয়তম পুলিশ অথবা তাদের কুশীলব কেউ? তেমন একটি লাশের অপেক্ষায় কী ‘আজিকার তাহাজুদের নামাজের পর’/ জায়নামাজে বসে আকুল কেঁদেছেন মহাসমাবেশের মহানেত্রী’?

হে মহাসমাবেশ, তোমার জন্য এভাবে শামসুর রহমানের অমর কবিতা/’ তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা’র ব্যর্থ অনুকরণের চেষ্টাকে নিজগুণে মাপ করে দিও।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.