উত্তরসূরির স্বাধীনতা দর্শন by জিয়াউল হক মুক্তা
কেউ কেউ বলবেন, সামগ্রিক পরিকল্পনা বা অগ্রাধিকার-টগ্রাধিকার আবার কী? আসল কাজ সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল ও বৈপ্লবিক রূপান্তর। মানলাম, কিন্তু সোভিয়েত-উত্তর বিশ্ববাস্তবতায় এক দেশে বৈপ্লবিক রূপান্তরের ভূরাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা করবেন না? বিচ্ছিন্ন দ্বীপে থাকবেন? কে আপনাকে থাকতে দেবে?
এই ব্যবস্থা-বাস্তবতার মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে; সামগ্রিক সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে; সংহতির মধ্যে সংগ্রাম নিরন্তর; পরিবর্তন ও রূপান্তরের জন্য। হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো হয়তো হবে না, কিন্তু ভালো তো হবে!
আহমদ ছফা, যাকে আমি গভীরভাবে পছন্দ করি বাংলাভাষার মহত্তম সাহিত্যকর্মের একটি 'ওঙ্কার' রচনার জন্য এবং যাকে আমি ভীষণভাবে অপছন্দ করি 'শতবর্ষের ফেরারী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' রচনার মাধ্যমে একটি বিকৃত রাজনৈতিক নির্দেশনা প্রচারের জন্য; একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো ব্যাপকতর ও গভীরতর বিষয় নিয়ে যথাযথ ইতিহাস ও সাহিত্য রচিত হবে তখনই, যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রজন্ম থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ওই যুদ্ধে যারা বিভিন্ন পক্ষ ও পক্ষপাতদুষ্টতায় যুক্ত ছিলেন, তাদের কাছ থেকে ইতিহাসের যথাপাঠ অথবা কৃতকর্মের উদ্ভাস ও অবশেষের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ পাওয়া সম্ভব নয়; যদিও তাদের বিবরণ হবে ইতিহাসের আকর। আমি আহমদ ছফার সঙ্গে একমত। প্রমাণও আছে। সামরিকতন্ত্র নির্মিত ইতিহাসের আলোকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী জিয়াউর রহমানকে এক সময় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা নেতা বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের স্লোগান ছিল, 'স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া, লও লও লাল সালাম'_ বছর দশেক ধরে তা আর শুনি না, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও কিন্তু সে স্লোগান দিতে খুব লজ্জা পান। এক সময় হয়তো দেখব আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি আর বিরূপ থাকবেন না।
কোনো একটি আড্ডায় সম্প্রতি শুনেছি, সমসাময়িককালে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যুদ্ধোত্তরকালে তারা দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার আওতায় থাকেন; জয়ী বা পরাজিত যাই হোন না কেন রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো কাজে তাদের নিযুক্ত করা হয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সকলের অংশগ্রহণ ছিল এতটাই প্রত্যক্ষ যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তারা যুদ্ধকালীন বা পূর্বকালীন পক্ষগুলোর পক্ষ না নিয়ে পারেননি। দেশ ও মানুষকে ভালোবেসে নিজে মরে যাওয়ার জন্য বা শত্রুকে মেরে ফেলার জন্য যারা সশস্ত্র হয়েছিলেন, জীবনের ওপর অস্ত্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঐতিহাসিক ও যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতায় তারা বিভক্ত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে, সাধারণ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ না থেকে অসহিষ্ণু হয়ে তারা ভিন্নমতকে বিভাজনে ঠেলে দিয়েছেন_ যুদ্ধে সামরিকভাবে জিতেও যুদ্ধের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক থাকতে পারেননি; পক্ষ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার দীর্ঘপথের দুয়ারের বাইরে দণ্ডায়মান হতবিহ্বল।
আমি স্পষ্ট দেখি আমার দেশের বিপুল সম্ভাবনা। সম্ভাবনা আমাকে অস্থিরতায় ঠেলে দেয়; অনুভব করি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থাকলে আমি অনেক ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারতাম। আমাদের পূর্বপ্রজন্মের বীরগণ যুদ্ধ শেষে প্রথম দশ বছর নিজেদের পক্ষ সম্প্রসারণে সচেষ্ট থেকেছেন এবং সকলে ব্যর্থ হয়েছেন; দ্বিতীয় দশ বছর তারা কাছাকাছি এসেছেন সাধারণ শত্রু সামরিকতন্ত্র মোকাবেলায়, জয়ী হয়েছেন; তৃতীয় দশ বছরেও তারা প্রথম দশ বছরের ইতিহাসের কিছুটা পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং চতুর্থ দশ বছরে তারা আবার কাছাকাছি এসেছেন সাধারণ শত্রু যুদ্ধাপরাধ-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায়_ যদিও রাজনৈতিক ঐক্য সংহত ও সম্প্রসারণের চাইতে ত্রুটিপূর্ণ আইনি-প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যবহারই তাদের প্রধানতম কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এখন তো বটেই, এমনকি গত ৪০ বছরেও একটু বিস্তৃতভাবে দেখলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো ভাঙার সংগ্রামে, আর ঐতিহাসিকভাবে দেখলে যখন থেকে বাঙালি তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত_ সবসময়ই আমরা কিছুটা একপেশে, সংগ্রাম বা যুদ্ধের সামগ্রিকতার দিকে তাকাতে পারি না; লক্ষ্যে পেঁৗছানোর নীতি ও কৌশলের কোনো কোনোটির প্রতি এত বেশি জোর দেই যে সবগুলোর সুসমন্বয় ঘটে না। ফলে লক্ষ্য দূরবর্তী হয় বা অর্জিত হয় না কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো আরও সামগ্রিকভাবে নীতি-কৌশলগুলোর সমন্বয় ঘটাতে পারতেন; সেক্ষেত্রে দৃশ্যপট হয়তো ভিন্নতর হতো আজ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি অস্পষ্ট হচ্ছে ক্রমে? স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রকাঠামো গঠন ও রূপান্তর বা পরিবর্তনের প্রয়াস ছিল তীব্র। দ্বিতীয় দশকে তা সামান্য ফিকে হয়ে শ্রেণী-পেশার আন্দোলনে মূর্ত হয় এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র উৎখাতের এক দফায় পরিণত হয়; তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আবহমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জনগণের ব্যবহারিক জীবন-সংশ্লিষ্টতার বদলে পুরোপুরি পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে_ আদমজীর তিরিশ হাজারের বেশি শ্রমিক ও তাদের পরিবার সদস্যদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বিকার থাকলেও নেত্রীদের বাড়ি বিষয়ে ছিল ভয়াবহ মাত্রায় সোচ্চার।
ধর্ষিতাকে জিজ্ঞেস করুন তো কোন ধর্ষণ ভালো? ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণ কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে? যুবদল ক্যাডার কর্তৃক ছাত্রী বা সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ কি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বাস্তবায়ন কৌশল? ক্ষুধার্তকে জিজ্ঞেস করুন তো স্বাধীন বাংলাদেশে নিরন্ন থাকার চেয়ে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানে নিরন্ন থাকা কোন দৃষ্টিতে খারাপ? রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে খুনের আসামিদের ক্ষমা করে দিয়ে নাগরিক হিসেবে কীভাবে তার স্ত্রীর হত্যার বিচার চাইবেন? পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তার স্ত্রীর খুনিদের ক্ষমা করলে তাকেও কি তিনি স্বাগত জানাবেন? যুদ্ধাপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা জাতীয় অগ্রাধিকার; কিন্তু শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করলাম, অন্যদিকে একই সঙ্গে স্বাধীনতাকে সংহত করতে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তাতে কোনো ভূমিকা রাখলাম না_ তাতে জনগণের কী আসে যায়? পাকিস্তানি শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি ভারত বা আমেরিকার কাছে বাণিজ্য-পানি-নিরাপত্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিংবা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নির্দেশে দেশ পরিচালনার জন্য?
জানি, অনেকে বলবেন একবারে সবকিছু হয় না, অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়। ঠিক, অগ্রাধিকার ঠিক করা দরকার; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, একটা অর্জন করতে গিয়ে আরেকটাকে অবহেলা করতে হবে; সামগ্রিক পরিকল্পনাতেই থাকতে হবে অগ্রাধিকারের অবস্থান। ছোট মেয়ের খাদ্য-শিক্ষা-ভাবনা অবহেলা করে বড় ছেলের বিয়েতে জমি-জিরাত সব বেচে দিতে পারি না। আমরা 'রূপকল্প ২০২১' ঘোষণা করলাম, খসড়া 'পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা' প্রণয়ন করলাম, 'ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা' অনুমোদন করলাম_ কর্মচারী আর পরামর্শক দিয়ে; সংসদের অনুমোদন তো দূরের কথা, একদিনও এগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম না, কোনো সদস্যই কিছু জানলেন না! চমৎকার! 'চমৎকার সে হতেই হবে, হুজুরের মতে অমত কার?'
কেউ কেউ বলবেন, সামগ্রিক পরিকল্পনা বা অগ্রাধিকার-টগ্রাধিকার আবার কী? আসল কাজ সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল ও বৈপ্লবিক রূপান্তর। মানলাম, কিন্তু সোভিয়েত-উত্তর বিশ্ববাস্তবতায় এক দেশে বৈপ্লবিক রূপান্তরের ভূরাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা করবেন না? বিচ্ছিন্ন দ্বীপে থাকবেন? কে আপনাকে থাকতে দেবে?
এই ব্যবস্থা-বাস্তবতার মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে; সামগ্রিক সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে; সংহতির মধ্যে সংগ্রাম নিরন্তর; পরিবর্তন ও রূপান্তরের জন্য। হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো হয়তো হবে না, কিন্তু ভালো তো হবে! সমাজতন্ত্র হয়তো হবে না, ভালো একটা পুঁজিতন্ত্র তো হবে! কেউ কেউ আবারও বলবেন, পুঁজিতন্ত্র আবার ভালো হয় কী করে? আবারও বলব, পরিবারতন্ত্র বা লুটপাটতন্ত্রের বদলে পুঁজিতন্ত্র লক্ষ্য হিসেবে খারাপ হতে পারে না আপাতত। ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা ভারত কি এগোচ্ছে না? চীনের চেয়ে বেশি ভালো কে করছে এই দুনিয়ায়? ভেনিজুয়েলা-বলিভিয়া-কিউবা-ভিয়েতনাম কি অনুসরণ করছে চিরায়ত সমাজতন্ত্রের পথ? উত্তর কোরিয়া বা ইরান কি বিকিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা? দুনিয়াতে গতি, অগ্রগতি আর প্রগতি থেমে নেই। রাজনৈতিক ইচ্ছা হচ্ছে নির্ধারক। আমরা কতটুকু স্বপ্ন দেখি? স্বপ্ন বাস্তবায়নের নেতৃত্ব কি আমাদের আছে?
খুন হতে বা খুন করতে বদ্ধপরিকর পূর্বপুরুষ তার সীমিত বোধ ও অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ। শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর সহানুভূতি তাদের জন্য; কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের, নেতৃত্ব নিতে হবে আমাদেরই। আমাদের বয়স হয়েছে।
জিয়াউল হক মুক্তা :আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের এশিয়া অঞ্চলের পলিসি কোঅর্ডিনেটর
zmukta@oxfam.org.uk
আহমদ ছফা, যাকে আমি গভীরভাবে পছন্দ করি বাংলাভাষার মহত্তম সাহিত্যকর্মের একটি 'ওঙ্কার' রচনার জন্য এবং যাকে আমি ভীষণভাবে অপছন্দ করি 'শতবর্ষের ফেরারী : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' রচনার মাধ্যমে একটি বিকৃত রাজনৈতিক নির্দেশনা প্রচারের জন্য; একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো ব্যাপকতর ও গভীরতর বিষয় নিয়ে যথাযথ ইতিহাস ও সাহিত্য রচিত হবে তখনই, যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রজন্ম থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ওই যুদ্ধে যারা বিভিন্ন পক্ষ ও পক্ষপাতদুষ্টতায় যুক্ত ছিলেন, তাদের কাছ থেকে ইতিহাসের যথাপাঠ অথবা কৃতকর্মের উদ্ভাস ও অবশেষের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ পাওয়া সম্ভব নয়; যদিও তাদের বিবরণ হবে ইতিহাসের আকর। আমি আহমদ ছফার সঙ্গে একমত। প্রমাণও আছে। সামরিকতন্ত্র নির্মিত ইতিহাসের আলোকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী জিয়াউর রহমানকে এক সময় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা নেতা বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের স্লোগান ছিল, 'স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া, লও লও লাল সালাম'_ বছর দশেক ধরে তা আর শুনি না, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও কিন্তু সে স্লোগান দিতে খুব লজ্জা পান। এক সময় হয়তো দেখব আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি আর বিরূপ থাকবেন না।
কোনো একটি আড্ডায় সম্প্রতি শুনেছি, সমসাময়িককালে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যুদ্ধোত্তরকালে তারা দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার আওতায় থাকেন; জয়ী বা পরাজিত যাই হোন না কেন রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো কাজে তাদের নিযুক্ত করা হয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সকলের অংশগ্রহণ ছিল এতটাই প্রত্যক্ষ যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তারা যুদ্ধকালীন বা পূর্বকালীন পক্ষগুলোর পক্ষ না নিয়ে পারেননি। দেশ ও মানুষকে ভালোবেসে নিজে মরে যাওয়ার জন্য বা শত্রুকে মেরে ফেলার জন্য যারা সশস্ত্র হয়েছিলেন, জীবনের ওপর অস্ত্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঐতিহাসিক ও যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতায় তারা বিভক্ত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে, সাধারণ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ না থেকে অসহিষ্ণু হয়ে তারা ভিন্নমতকে বিভাজনে ঠেলে দিয়েছেন_ যুদ্ধে সামরিকভাবে জিতেও যুদ্ধের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক থাকতে পারেননি; পক্ষ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার দীর্ঘপথের দুয়ারের বাইরে দণ্ডায়মান হতবিহ্বল।
আমি স্পষ্ট দেখি আমার দেশের বিপুল সম্ভাবনা। সম্ভাবনা আমাকে অস্থিরতায় ঠেলে দেয়; অনুভব করি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থাকলে আমি অনেক ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারতাম। আমাদের পূর্বপ্রজন্মের বীরগণ যুদ্ধ শেষে প্রথম দশ বছর নিজেদের পক্ষ সম্প্রসারণে সচেষ্ট থেকেছেন এবং সকলে ব্যর্থ হয়েছেন; দ্বিতীয় দশ বছর তারা কাছাকাছি এসেছেন সাধারণ শত্রু সামরিকতন্ত্র মোকাবেলায়, জয়ী হয়েছেন; তৃতীয় দশ বছরেও তারা প্রথম দশ বছরের ইতিহাসের কিছুটা পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং চতুর্থ দশ বছরে তারা আবার কাছাকাছি এসেছেন সাধারণ শত্রু যুদ্ধাপরাধ-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায়_ যদিও রাজনৈতিক ঐক্য সংহত ও সম্প্রসারণের চাইতে ত্রুটিপূর্ণ আইনি-প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যবহারই তাদের প্রধানতম কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এখন তো বটেই, এমনকি গত ৪০ বছরেও একটু বিস্তৃতভাবে দেখলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো ভাঙার সংগ্রামে, আর ঐতিহাসিকভাবে দেখলে যখন থেকে বাঙালি তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত_ সবসময়ই আমরা কিছুটা একপেশে, সংগ্রাম বা যুদ্ধের সামগ্রিকতার দিকে তাকাতে পারি না; লক্ষ্যে পেঁৗছানোর নীতি ও কৌশলের কোনো কোনোটির প্রতি এত বেশি জোর দেই যে সবগুলোর সুসমন্বয় ঘটে না। ফলে লক্ষ্য দূরবর্তী হয় বা অর্জিত হয় না কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো আরও সামগ্রিকভাবে নীতি-কৌশলগুলোর সমন্বয় ঘটাতে পারতেন; সেক্ষেত্রে দৃশ্যপট হয়তো ভিন্নতর হতো আজ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি অস্পষ্ট হচ্ছে ক্রমে? স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রকাঠামো গঠন ও রূপান্তর বা পরিবর্তনের প্রয়াস ছিল তীব্র। দ্বিতীয় দশকে তা সামান্য ফিকে হয়ে শ্রেণী-পেশার আন্দোলনে মূর্ত হয় এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র উৎখাতের এক দফায় পরিণত হয়; তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আবহমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জনগণের ব্যবহারিক জীবন-সংশ্লিষ্টতার বদলে পুরোপুরি পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে_ আদমজীর তিরিশ হাজারের বেশি শ্রমিক ও তাদের পরিবার সদস্যদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বিকার থাকলেও নেত্রীদের বাড়ি বিষয়ে ছিল ভয়াবহ মাত্রায় সোচ্চার।
ধর্ষিতাকে জিজ্ঞেস করুন তো কোন ধর্ষণ ভালো? ছাত্রলীগ নেতার ধর্ষণ কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে? যুবদল ক্যাডার কর্তৃক ছাত্রী বা সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ কি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বাস্তবায়ন কৌশল? ক্ষুধার্তকে জিজ্ঞেস করুন তো স্বাধীন বাংলাদেশে নিরন্ন থাকার চেয়ে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানে নিরন্ন থাকা কোন দৃষ্টিতে খারাপ? রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে খুনের আসামিদের ক্ষমা করে দিয়ে নাগরিক হিসেবে কীভাবে তার স্ত্রীর হত্যার বিচার চাইবেন? পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তার স্ত্রীর খুনিদের ক্ষমা করলে তাকেও কি তিনি স্বাগত জানাবেন? যুদ্ধাপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা জাতীয় অগ্রাধিকার; কিন্তু শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করলাম, অন্যদিকে একই সঙ্গে স্বাধীনতাকে সংহত করতে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ তাতে কোনো ভূমিকা রাখলাম না_ তাতে জনগণের কী আসে যায়? পাকিস্তানি শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি ভারত বা আমেরিকার কাছে বাণিজ্য-পানি-নিরাপত্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিংবা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের নির্দেশে দেশ পরিচালনার জন্য?
জানি, অনেকে বলবেন একবারে সবকিছু হয় না, অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়। ঠিক, অগ্রাধিকার ঠিক করা দরকার; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, একটা অর্জন করতে গিয়ে আরেকটাকে অবহেলা করতে হবে; সামগ্রিক পরিকল্পনাতেই থাকতে হবে অগ্রাধিকারের অবস্থান। ছোট মেয়ের খাদ্য-শিক্ষা-ভাবনা অবহেলা করে বড় ছেলের বিয়েতে জমি-জিরাত সব বেচে দিতে পারি না। আমরা 'রূপকল্প ২০২১' ঘোষণা করলাম, খসড়া 'পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা' প্রণয়ন করলাম, 'ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা' অনুমোদন করলাম_ কর্মচারী আর পরামর্শক দিয়ে; সংসদের অনুমোদন তো দূরের কথা, একদিনও এগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম না, কোনো সদস্যই কিছু জানলেন না! চমৎকার! 'চমৎকার সে হতেই হবে, হুজুরের মতে অমত কার?'
কেউ কেউ বলবেন, সামগ্রিক পরিকল্পনা বা অগ্রাধিকার-টগ্রাধিকার আবার কী? আসল কাজ সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল ও বৈপ্লবিক রূপান্তর। মানলাম, কিন্তু সোভিয়েত-উত্তর বিশ্ববাস্তবতায় এক দেশে বৈপ্লবিক রূপান্তরের ভূরাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা করবেন না? বিচ্ছিন্ন দ্বীপে থাকবেন? কে আপনাকে থাকতে দেবে?
এই ব্যবস্থা-বাস্তবতার মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে; সামগ্রিক সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে; সংহতির মধ্যে সংগ্রাম নিরন্তর; পরিবর্তন ও রূপান্তরের জন্য। হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো হয়তো হবে না, কিন্তু ভালো তো হবে! সমাজতন্ত্র হয়তো হবে না, ভালো একটা পুঁজিতন্ত্র তো হবে! কেউ কেউ আবারও বলবেন, পুঁজিতন্ত্র আবার ভালো হয় কী করে? আবারও বলব, পরিবারতন্ত্র বা লুটপাটতন্ত্রের বদলে পুঁজিতন্ত্র লক্ষ্য হিসেবে খারাপ হতে পারে না আপাতত। ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা ভারত কি এগোচ্ছে না? চীনের চেয়ে বেশি ভালো কে করছে এই দুনিয়ায়? ভেনিজুয়েলা-বলিভিয়া-কিউবা-ভিয়েতনাম কি অনুসরণ করছে চিরায়ত সমাজতন্ত্রের পথ? উত্তর কোরিয়া বা ইরান কি বিকিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা? দুনিয়াতে গতি, অগ্রগতি আর প্রগতি থেমে নেই। রাজনৈতিক ইচ্ছা হচ্ছে নির্ধারক। আমরা কতটুকু স্বপ্ন দেখি? স্বপ্ন বাস্তবায়নের নেতৃত্ব কি আমাদের আছে?
খুন হতে বা খুন করতে বদ্ধপরিকর পূর্বপুরুষ তার সীমিত বোধ ও অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ। শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর সহানুভূতি তাদের জন্য; কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের, নেতৃত্ব নিতে হবে আমাদেরই। আমাদের বয়স হয়েছে।
জিয়াউল হক মুক্তা :আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের এশিয়া অঞ্চলের পলিসি কোঅর্ডিনেটর
zmukta@oxfam.org.uk
No comments