সরল গরল-শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য নতুন আইন দরকার by মিজানুর রহমান খান

জনসভার স্বাধীনতা এবং তা নিয়ন্ত্রণের নামে দুই বড় দল সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। তারা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও দমনপীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও নিজেদের তারা আইনের আওতায় নিতে অনাগ্রহ দেখিয়ে চলেছে। তারা পারতপক্ষে আইন মানছে না। আইন থাকলেও তারা তা ভঙ্গ করারই প্রবণতা দেখিয়ে থাকে।


মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তারা সভা করে, সভা ভাঙে। আর মুখে বলে, এ সবই তারা করছে গণতন্ত্রের নামে। একটি রাষ্ট্রে প্রায় কোনো স্বাধীনতাই অসীম কিংবা বল্গাহীন হতে পারে না। সমাবেশের স্বাধীনতাও তা-ই। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে যখন খুশি, যত খুশি সভা করছে, মিছিল করছে। দলগুলো দাবি করতে পারে যে তারা ‘পাবলিক প্লেসে’ সভা-সমাবেশ করতে পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও বিরাট ফাঁকি ও ফাঁকফোকর আছে। পুলিশের কাছে সভাসংক্রান্ত ২০০৬ সালের একটা নীতিমালা আছে। কিন্তু সেই নীতিমালা নিয়ে কখনও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে বলে জানা নেই। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ এবং ওই নীতিমালায় পুলিশ কমিশনারকে সভা-সমাবেশের বিষয়ে আকাশছোঁয়া ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পুলিশ কমিশনার নিয়োগে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, চরম দলীয় আনুগত্য ব্যতিরেকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আকাশকুসুম কল্পনা। ১২ মার্চের মহাসমাবেশ নিয়ে বিএনপি পুলিশের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েছিল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জনজীবনে এত উত্তাপ ছড়ানোর পর ডিএমপি মুখপাত্র শনিবারও বলেছেন, বিএনপিকে তাঁরা মহাসমাবেশ করতে আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেননি। এ রকম একটি আজগুবি কথা বলতে প্রচলিত আইন তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছে।
‘পাবলিক প্লেস’-এ সভা-সমাবেশ করার ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। রাস্তা আটকে অবস্থান ধর্মঘট ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি মুড়িমুড়কির মতো পালিত হচ্ছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা আটকানো কোনো ঘটনাই নয়। যেকোনো একটা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেই হলো। তবে এ কথা এভাবে বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে জনগণের প্রতিবাদের ভাষা সংকুচিত করা। বরং কেউ যাতে গণ-উপদ্রব না ঘটিয়ে সুষ্ঠুভাবে প্রতিবাদ করতে পারে, সে জন্য দরকারি সব ব্যবস্থা নিতে হবে। নীতিমালা হালনাগাদ করতে হবে। তবে সেটা কোনো আমলাতান্ত্রিক উপায়ে মানুষকে অন্ধকারে রেখে হতে পারবে না। বাংলাভিশনের এক আলোচনায় ড. আকবর আলি খান শনিবার রাতে বলেন, সমাবেশের স্বাধীনতা কীভাবে ভোগ করা হবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা দরকার। এ জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইন-কানুন দেখতেও পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার রয়েছে। তবে শর্ত হলো, জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে এসব অধিকারের ওপর আইন অনুসারে প্রযোজ্য যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করা যাবে।’ ৪০ বছর কেটে গেলেও এই অনুচ্ছেদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনকল্পে বাংলাদেশের সংসদে কোনো আইন তৈরি করা হয়নি। হয়তো কেউ ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবেন। কিন্তু এই অধ্যাদেশ ও তার আওতায় প্রণীত চার পৃষ্ঠার নীতিমালা বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হবে যে এটা একান্তভাবেই একটি আমলাতান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক শোষণের জাঁতাকল। এ কারণে ক্ষমতাসীনেরা নানা চাতুর্যের আশ্রয় নিতে পারছে। ১২ মার্চের সমাবেশের অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ বিএনপির সঙ্গে যে আচরণ করছে, সাদেক হোসেন খোকা তাঁর নামকরণ করেছেন ‘লুকোচুরি’। কিন্তু তিনি যেটা বলেননি সেটা হলো, তাঁরা পুরো জাতির সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে লুকোচুরি খেলে আসছেন। এই লুকোচুরি তাঁরা বন্ধ করবেন না। সে কারণে আমরা দেখি, দুই বড় দল যত ঝগড়াঝাঁটি করুক না কেন, প্রচলিত সমাবেশ আইনের খোলনলচে বদলানোর কথা তারা মুখে আনতেও নারাজ। আজ যারা ক্রীড়ানক, কাল তারাই খেলুড়ে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ-শাসনে কোনো তফাত নেই। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের আমলে সৃষ্টি হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ। সামরিক ফরমান ছুঁতে আওয়ামী লীগাররা বড়ই শরমিন্দা বোধ করেন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক অধ্যাদেশকে কুর্নিশ করতে তাঁদের বাধে না। ওই অধ্যাদেশের ২৫ ধারা বলছে, অধ্যাদেশের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি না করে পুলিশ কমিশনার সমাবেশ করার বিষয়ে প্রবিধান তৈরি করতে পারবেন। এই আইনের সংশ্লিষ্ট উপদফা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে জনসভা রাস্তায় হতে পারবে। ৩৬ বছর আগের রাস্তায় সভা করলে জনদুর্ভোগ আজকের মতো ভয়াবহ হতো না।
পুলিশ কমিশনার ও সরকারের কাছে আমরা সমাবেশস্থলের তালিকা প্রকাশের আবেদন জানাই। বর্তমানে পুলিশ কমিশনার যে স্থানকে মনে করবেন যে এটা সমাবেশস্থল, সেটাই তক্ষুনি সমাবেশস্থল। যখন যেটা ‘না’ বলবেন, সেটাই না। কোথাও কোনো আপিলের(মালয়েশিয়ার আইনে আছে) সুযোগ নেই। এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, আইনে পুলিশ কমিশনারকে ‘সমাবেশস্থল’ চিহ্নিত করার অবাধ লাইসেন্স দেওয়া থাকবে। অধ্যাদেশের ২৯ ধারা বলেছে, পুলিশ কমিশনার লিখিত আদেশ দ্বারা যতক্ষণ তিনি মনে করবেন যে জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য মিছিল ও সমাবেশ করা বন্ধ রাখা দরকার, ততক্ষণ তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি ও তা বহাল রাখতে পারবেন। তবে শর্ত হলো, সরকারের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা একটানা ৩০ দিনের বেশি বহাল থাকবে না। আমরা যেখানে সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না, সেখানে পুলিশ কমিশনার ও সরকারের কোনো ভিন্ন সত্তা কল্পনাও করতে বললেও তা হাসির উদ্রেক ঘটাবে।
ওই অধ্যাদেশের ৩৩(১) ধারা বলেছে, জনসভাস্থলে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে পদবিতে যিনি জ্যেষ্ঠতম, তিনি তাঁর বিবেচনায় শান্তিশৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে যেমন ইচ্ছা তেমন রূপে জনসভাস্থলে লোকজনের যোগদানসহ নানা বিষয়ে নির্দেশ জারি করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এই ধারার উদ্দেশ্যপূরণকল্পে পুলিশ সভাস্থলে সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার ভোগ করবে। ১৯৭৬ সালের এই আইনে জনসভা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা কোনোভাবেই ‘যুক্তিসংগত’ বাধানিষেধ বলে গণ্য হতে পারে না।
তাহলে কী করতে হবে, সেটা বুঝতে হলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো জনসভা করার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আমাদের বুঝতে হবে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার একটি নতুন বিলের ওপর সুইজারল্যান্ডে গতকাল গণভোট হলো। জেনেভার প্রাণকেন্দ্রে সমাবেশ করা যাবে না। পূর্বানুমতি ছাড়া সমাবেশ করলে এক লাখ ডলার জরিমানা। সমাবেশ থেকে উদ্ভূত ঘটনায় কোনো সম্পদহানি বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট মহল পরের পাঁচ বছর সভা করার অনুমতি পাবে না। মালয়েশিয়া গত নভেম্বরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আইন, ২০১১ পাস করেছে। বিরোধী দলের ওয়াকআউটের মধ্য দিয়ে পাস করা বিলে নানা বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট সময় নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও সমাবেশের নয়, বরং ‘শান্তিপূর্ণ সমাবেশ’-এর অধিকার শর্ত সাপেক্ষে নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আইন দরকার। এটা তৈরি করতে ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের, ১৯৯৯ সালের ফিনল্যান্ডের, ১৯৮৬ সালের ইংল্যান্ডের, ২০০৮ সালের জার্মানির সংশ্লিষ্ট আইনগুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এসব আইনের বিধানাবলি নিশ্চিত করে যে আমাদের ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশটি প্রহসনমূলক একটি অচলপত্র ছাড়া কিছু নয়। কোনো ব্যস্ততম জনাকীর্ণ সড়কে জনসভা করা যাবে না। তবে সর্বাগ্রে যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াতে হবে, সেই সরিষা মানে পুলিশকে ভূতমুক্ত করতে হবে। আর একে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহারে দুই বড় দলের রুচির কোনো ঘাটতি নেই। সংসদ অচল রেখে মহাসমাবেশ করে শোডাউন করার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। তবে সংসদ যেসব কারণে ক্ষমতাসীন দলের অলংকার হিসেবে চিহ্নিত, সেসব কারণ জিইয়ে রাখলে বিরোধী দল সংসদে যাবে না।
বাংলাদেশ মহাসমাবেশ, হরতাল ও তা ভণ্ডুল করার রুগ্ণ রাজনীতিতে ধুঁকতে থাকবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.