পঞ্চদশ সংশোধনী-মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ইতিবাচক চেষ্টা by শেখ হাফিজুর রহমান

বহুল আলোচিত সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন, ২০১১ পাস হয়েছে গত ৩০ জুন। পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে বেশ কটি বিশ্লেষণমূলক ও সমালোচনামূলক লেখা পড়লাম। তাতে যে কথাটা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হলো, আওয়ামী লীগ এই সংশোধনীর মাধ্যমে লেজেগোবরে করে ফেলেছে।


এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার কাউকে খুশি করতে পারেনি। এ সংশোধনীতে জোটের মধ্যকার বামপন্থীরা নাখোশ, বুদ্ধিজীবীরা বেজার, ডানপন্থীরা তো এর বিরুদ্ধে রীতিমতো হরতাল ডেকে বসেছে! কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরো বিষয়ের মধ্যে একটা ইতিবাচকতা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। প্রথমত, সংসদের বিশেষ কমিটি করে সম্ভাব্য সংশোধনীর বিষয়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত গ্রহণের বিষয়টি ছিল ভালো। কেননা, এর আগে সংবিধান সংশোধনী হয়েছে সামরিক ফরমান বলে, রাতের অন্ধকারে বা ‘রাবার স্ট্যাম্প’ সংসদের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, আমার কাছে মনে হয়েছে যে এ সংশোধনীয় মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফেরার একটা সদিচ্ছা ও ইতিবাচক ‘জেসচার’ বা ইঙ্গিত ছিল।
বিভিন্ন লেখায় সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এসেছে তা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে কি না? আমার কথা হচ্ছে, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান তো আওয়ামী লীগের হাতেই করা। তারপর সংবিধানকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রদান করেন প্রথমে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯৬ সালে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তাতে আওয়ামী লীগের পক্ষে সংবিধানে হাত দেওয়া সম্ভব ছিল না। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠায় ক্ষমতায় আসার কারণেই এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধান সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ, জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দিতে সাহস করেছে। আরেকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে বলে আমি মনে করি। আর সেটি হচ্ছে, ১৯৭২ সালের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপট। ওই সময় সারা বিশ্ব পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্ত ছিল। সমাজতন্ত্রের যে সাম্যের বাণী, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যয়, তাতে বিশ্বের লাখো-কোটি শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ছিল উজ্জীবিত। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দ্বিতীয়ত, ১৯৫২ সাল থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অত্যন্ত শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে। তৃতীয়ত, ১৯৭২ সালে ছিলেন কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু নিজে, যিনি একই সঙ্গে ছিলেন বাঙালি ও মুসলিম, যাঁর চেতনার মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে ১৯৫২ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আমাদের যে অর্জন ও প্রগতিশীল নানা ধ্যানধারণা—সংবিধানে স্থান দিতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০১১ সালে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর উল্লিখিত পরিস্থিতির কোনোটিই উপস্থিত নেই। অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আদর্শিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে ও চেতনাগতভাবে ১৯৭২ সালে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে পিছিয়ে পড়েছি অনেক অনেক দূর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা যদি মাথায় রাখি, তাহলে আমি বলব, বিদ্যমান বাস্তবতায় এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ বিবেচনা করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুশকিলটা হচ্ছে, এ ধরনের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা সহজ। কিন্তু সেটা দিয়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে যেমন রোধ করা যাবে না, তেমনি সংবিধানের প্রাধান্য, সর্বোচ্চতা ও ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা যাবে না। কেননা, সামরিক শাসকেরা এসে প্রথমেই সংবিধান স্থগিত করবেন। ফলে সাংবিধানিক বিধানের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। সামরিক শাসক আইয়ুব খান সংবিধান স্থগিত করে সামরিক ফরমান দিয়ে দেশ চালিয়েছেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সাহেবও একই কাজ করেছেন। আর সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিচারক, বিচারালয় এবং ‘রাবার স্ট্যাম্প’ সংসদেরও কোনোকালেই কোনো অভাব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না।
রাষ্ট্র বনাম দোসো মামলায় (PLD 1958 SC 533) পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মুনির আইয়ুব খানের অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনকে বৈধ বলে রায় প্রদান করেছিলেন। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট হালিমা খাতুন বনাম বাংলাদেশ মামলায় [30 (1978) DLR (SC) 207] বলেছেন যে সংবিধান সামরিক ফরমানের অধীন। অর্থাৎ সামরিক শাসকের আমলে সামরিক ফরমানই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। এমনকি সংবিধানও সামরিক ফরমানের অধীন! বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের রায় দিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এতে বিচারকেরা সংবিধানের প্রাধান্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষার যে শপথ নিয়েছেন, তা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর যে বিষয়ে আরও অনেক বেশি উদ্যম ও ‘ইনপুট’ দরকার ছিল, সেটি হচ্ছে পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশদূষণ রোধ। কেননা, সারা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ, যারা সবচেয়ে বেশি ‘পরিবেশ ঝুঁকি’র মধ্যে রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। প্রতিদিন হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে ১৬ হাজার টন এবং তেজগাঁওয়ের শিল্প-কারখানা থেকে তিন হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ঢাকা শহরে ১৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। দেশের চারটি প্রধান শহরে বছরে ৬৫ লাখ লোক বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, সাগরগর্ভে উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা—সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশের অবস্থা খুবই নাজুক। এ পরিস্থিতিতে ‘নিরাপদ পরিবেশের অধিকারকে’ (Right to Safe Enviৎonment) সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে অতি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু ১৮ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদে শুধু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সংযুক্তি খুবই অপর্যাপ্ত। উল্লেখ্য, ১১৭টি দেশ ইতিমধ্যে তাদের সংবিধানে ‘নিরাপদ পরিবেশের অধিকারকে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, বিদ্যমান সংবিধান ও সংবিধান সংশোধনীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সাংবিধানিক মূল্যবোধ’ ও ‘সাংবিধানিক সংস্কৃতি’। সাংবিধানিক মূল্যবোধকে যদি আমরা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে বারবার সংবিধান সংশোধনের যেমন কোনো প্রয়োজন হবে না, অন্যদিকে শক্তিশালী হবে গণতন্ত্র ও সুশাসন।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hৎkaৎzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.