শ্রদ্ধাঞ্জলি-শুদ্ধ সংগীতের সংশপ্তক যোদ্ধা by মাহমুদ হাশিম
‘তিনি ছিলেন আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের এক অতন্দ্র যোদ্ধা। তিনি হয়তো নীরবে চলে গেলেন, কিন্তু বড় কিছুর জন্য তাঁর যে স্বপ্ন, তাঁর যে অবদান, তা জাতি মনে রাখবে চিরদিন’—বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীত প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ, সংগঠক শফিউর রহমানের কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে এ মন্তব্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের।
গুণী এ সংগঠকের ইচ্ছা অনুযায়ী ২৭ জুন সোমবার তাঁর মরদেহ শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে একজন গুণীর প্রতি আরেকজন গুণীর এমন মন্তব্য জানিয়ে দেয়, এতটা নীরবে বিদায় নেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না শফিউর রহমান।
কিন্তু কী এমন অবদান তিনি রেখে গেলেন যে তাঁর যাওয়ার সময় জাতি তাঁকে সম্মান জানাতে পারল না, কিন্তু মনে রাখবে চিরদিন?
স্বাধীনতার পরপর অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো সংগীত জগতেও ছিল একটা বড় শূন্যতা, বন্ধ্যত; বিশেষ করে, উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা ও পরিবেশনের জন্য ছিল না কোনো ব্যবস্থা। এমনই এক সময়ে সংগীতের প্রতি এক উদ্ধাররহিত অনুরাগ আর জাতীয় প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে গঠন করেন শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী। ৩৬ বছর, তিন যুগে, বেশির ভাগ সময় নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে গড়ে তোলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানটি। না, কোনো বড় ইমারত গড়ে তোলেননি তিনি, তৈরি করেছেন উচ্চাঙ্গসংগীতের অসংখ্য শিল্পী আর বোদ্ধা শ্রোতাগোষ্ঠী।
৩৬ বছরে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী কোনো ছেদ ছাড়াই করেছে ৪০০-এর মতো অনুষ্ঠান। নিয়মিত মাসিক অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিভা স্ফুরণ (অনূর্ধ্ব-১৬), প্রতিভা বিকাশ (১৬ থেকে ৩২) ও প্রতিভা সম্মান (২৫ বছরের ঊর্ধ্ব) কার্যক্রমের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চাকে দিয়েছেন দৃঢ় ভিত্তি, রাজধানীর গণ্ডি ছাড়িয়ে একে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা দেশে। শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করছেন দেশের বহু প্রতিভাবান শিল্পী।
শুধু নবীন শিল্পীই নয়, দেশের প্রায় সব বড় উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী গেয়েছেন এখানে। ভারতের ওস্তাদ নাসীর উদ্দীন ডাগর, ওস্তাদ ফৈয়াজ উদ্দীন ডাগর, রাম কিশোর দাস, ভিজি কার্নাড, দেবেন্দ্র মুদ্দেশ্বর, কৌশিক ভট্টাচার্য, রাজনারায়ণ ভট্টাচার্য ও সুসময় মিশ্রের মতো শিল্পীরা গেয়েছেন শুদ্ধ সংগীত গোষ্ঠীর আসরে।
১৯৮০ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর আসরে গেয়ে আসছেন ওস্তাদ রবিউল হোসেন। তিনি বলেন, শফিউর রহমান শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে যা করেছেন, তাকে এককথায় বলা যায় বিপ্লব। গভীর ভালোবাসা, আত্মপ্রত্যয় আর কমিটমেন্টের কারণেই এই অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছেন তিনি।
হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন—এমন সময়ও বন্ধ রাখেননি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান। অসুস্থতায় শয্যাশায়ী ছিলেন বহুদিন, নিজে আসতে পারেননি অনুষ্ঠানে। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের একনিষ্ঠ সঙ্গী স্ত্রী উষা রহমান আর ছেলে ইমনকে রোগশয্যার পাশ থেকে তুলে দিয়ে পাঠিয়েছেন অনুষ্ঠানের আয়োজনে।
যে কাজটি রাষ্ট্রীয় আয়োজনে হওয়ার কথা, সে কাজটিকে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন শফিউর রহমান। সমস্যাসংকুল যাত্রাপথে ৩০ বছর ধরে পাশে পেয়েছেন সংগীতানুরাগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে। ১৯৮১ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর সব অনুষ্ঠান হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে। এর জন্য দিতে হয়নি কোনো ভাড়া, এমনকি গোষ্ঠীর অনেক ব্যয় নিজ কাঁধে তুলে নেন অধ্যাপক সায়ীদ। শফিউর রহমানের মৃত্যুর পরও তিনি দিয়েছেন শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি।
ওপার বাংলার মালদহে বিখ্যাত শাঠিয়ার পরিবারে ১৯৩২ সালের ২২ অক্টোবর জন্মেছিলেন যে মানুষটি, দেশ বিভাগের পর চলে এলেন এপার বাংলায়। ১৯৫১ সাল থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস। সংগীতকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে আমৃত্যু উজাড় করে দিয়ে গেছেন সবটুকু।
রাষ্ট্র কোনো খোঁজ নেয়নি তাঁর—না জীবদ্দশায়, না মৃত্যুতে; চানওনি। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ অনেক সংগঠন তাঁকে জীবদ্দশায় দিয়েছে সম্মাননা, মৃত্যুতে দিয়েছে অশ্রুর অর্ঘ্য।
মাহমুদ হাশিম
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্রের সমন্বয়কারী।
কিন্তু কী এমন অবদান তিনি রেখে গেলেন যে তাঁর যাওয়ার সময় জাতি তাঁকে সম্মান জানাতে পারল না, কিন্তু মনে রাখবে চিরদিন?
স্বাধীনতার পরপর অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো সংগীত জগতেও ছিল একটা বড় শূন্যতা, বন্ধ্যত; বিশেষ করে, উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা ও পরিবেশনের জন্য ছিল না কোনো ব্যবস্থা। এমনই এক সময়ে সংগীতের প্রতি এক উদ্ধাররহিত অনুরাগ আর জাতীয় প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে গঠন করেন শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী। ৩৬ বছর, তিন যুগে, বেশির ভাগ সময় নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে গড়ে তোলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানটি। না, কোনো বড় ইমারত গড়ে তোলেননি তিনি, তৈরি করেছেন উচ্চাঙ্গসংগীতের অসংখ্য শিল্পী আর বোদ্ধা শ্রোতাগোষ্ঠী।
৩৬ বছরে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী কোনো ছেদ ছাড়াই করেছে ৪০০-এর মতো অনুষ্ঠান। নিয়মিত মাসিক অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিভা স্ফুরণ (অনূর্ধ্ব-১৬), প্রতিভা বিকাশ (১৬ থেকে ৩২) ও প্রতিভা সম্মান (২৫ বছরের ঊর্ধ্ব) কার্যক্রমের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চাকে দিয়েছেন দৃঢ় ভিত্তি, রাজধানীর গণ্ডি ছাড়িয়ে একে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা দেশে। শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করছেন দেশের বহু প্রতিভাবান শিল্পী।
শুধু নবীন শিল্পীই নয়, দেশের প্রায় সব বড় উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী গেয়েছেন এখানে। ভারতের ওস্তাদ নাসীর উদ্দীন ডাগর, ওস্তাদ ফৈয়াজ উদ্দীন ডাগর, রাম কিশোর দাস, ভিজি কার্নাড, দেবেন্দ্র মুদ্দেশ্বর, কৌশিক ভট্টাচার্য, রাজনারায়ণ ভট্টাচার্য ও সুসময় মিশ্রের মতো শিল্পীরা গেয়েছেন শুদ্ধ সংগীত গোষ্ঠীর আসরে।
১৯৮০ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর আসরে গেয়ে আসছেন ওস্তাদ রবিউল হোসেন। তিনি বলেন, শফিউর রহমান শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে যা করেছেন, তাকে এককথায় বলা যায় বিপ্লব। গভীর ভালোবাসা, আত্মপ্রত্যয় আর কমিটমেন্টের কারণেই এই অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছেন তিনি।
হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন—এমন সময়ও বন্ধ রাখেননি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান। অসুস্থতায় শয্যাশায়ী ছিলেন বহুদিন, নিজে আসতে পারেননি অনুষ্ঠানে। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের একনিষ্ঠ সঙ্গী স্ত্রী উষা রহমান আর ছেলে ইমনকে রোগশয্যার পাশ থেকে তুলে দিয়ে পাঠিয়েছেন অনুষ্ঠানের আয়োজনে।
যে কাজটি রাষ্ট্রীয় আয়োজনে হওয়ার কথা, সে কাজটিকে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন শফিউর রহমান। সমস্যাসংকুল যাত্রাপথে ৩০ বছর ধরে পাশে পেয়েছেন সংগীতানুরাগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে। ১৯৮১ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর সব অনুষ্ঠান হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে। এর জন্য দিতে হয়নি কোনো ভাড়া, এমনকি গোষ্ঠীর অনেক ব্যয় নিজ কাঁধে তুলে নেন অধ্যাপক সায়ীদ। শফিউর রহমানের মৃত্যুর পরও তিনি দিয়েছেন শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি।
ওপার বাংলার মালদহে বিখ্যাত শাঠিয়ার পরিবারে ১৯৩২ সালের ২২ অক্টোবর জন্মেছিলেন যে মানুষটি, দেশ বিভাগের পর চলে এলেন এপার বাংলায়। ১৯৫১ সাল থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস। সংগীতকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে আমৃত্যু উজাড় করে দিয়ে গেছেন সবটুকু।
রাষ্ট্র কোনো খোঁজ নেয়নি তাঁর—না জীবদ্দশায়, না মৃত্যুতে; চানওনি। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ অনেক সংগঠন তাঁকে জীবদ্দশায় দিয়েছে সম্মাননা, মৃত্যুতে দিয়েছে অশ্রুর অর্ঘ্য।
মাহমুদ হাশিম
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্রের সমন্বয়কারী।
No comments