মূল রচনা-দ্বিতীয় জীবন by প্রণব বল

দুূর্ঘটনায় মা-বাবাকে হারিয়েছিল ছোট্ট ইয়াসমিন। সেই মর্মন্তুদ ঘটনার পর হয়েছিল স্মৃতিভ্রষ্ট, ঠিকানাবিহীন। এক দিনহীন অটোরিকশা চালকের ঘরে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এর মধ্যেই আচমকা একদিন ইয়াসমিন আবার ফিরে পেল শৈশবের স্মৃতি। ইয়াসমিন খুঁজছে তার আপনজনকে... বিস্তারিত এবারের মূল রচনায়।


উত্তম-সুচিত্রার হারানো সুর ছবিটির কথা মনে আছে? দুর্ঘটনায় স্মৃতি লোপ পাওয়া উত্তমকুমার সুচিত্রা সেনের নিবিড় পরিচর্যায় সুস্থ হতে থাকেন। সুস্থ হতে হতে দুজনের প্রেম-ভালোবাসা, অতঃপর বিয়ে। একদিন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় উত্তম ফিরে পান তাঁর হারানো অতীতের স্মৃতি। এরপর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সুচিত্রার কথা মুছে যায় স্মৃতি থেকে।
এ তো গেল ছবির কাহিনি। এবার বাস্তবে ফেরা যাক। বাস্তবের এ কাহিনির ট্র্যাজিক চরিত্রের নাম ইয়াসমিন আকতার। ছয় বছর ধরে স্মৃতিভ্রষ্ট থাকা ইয়াসমিন সম্প্রতি ফিরে পেয়েছে তার অতীতের সুর, কিন্তু হারিয়ে গেছে বর্তমান। বাস্তবের এই গল্পের শুরুটা শোনা যাক তার মুখ থেকেই।
‘ঢাকা-চাঁদপুর লঞ্চে যাচ্ছিলাম আমরা। লঞ্চের ভেতর আমি মা-বাবার পাশেই ছিলাম। ঝাল-মুড়ি আনতে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছাদে (ডেকে) গেলাম। এমন সময় হঠাৎ ঝড় ওঠে। আমাদের লঞ্চ উল্টে যায়। জ্ঞান ফিরে দেখি, আমার পাশে সারি সারি লাশ। এক পুলিশ আঙ্কেল ওই লাশের ভিড়ে আমার মা-বাবাকে দেখালেন। তারা মারা গেছে।’ জীবনের বিভীষিকাময় সেদিনের কথা এভাবেই বলছিল ইয়াসমিন।
বেঁচে গেলেও ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালের এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় স্মৃতি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল ইয়াসমিন। মা-বাবাহারা আশ্রয়হীন ইয়াসমিনকে ২০০৬ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের রাস্তা থেকে মো. সাহেদ তুলে আনেন নিজের কুঁড়েঘরে। সাহেদ বলেন, ‘তখন সে শুধু তার নাম ও একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিল না, এমনকি তার মা-বাবার নামও। কাঁদছিল। তখন আমি তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসি। বোনের মতো মানুষ করতে থাকি।’
এভাবে কেটে গেছে অনেক দিন। মা-বাবার নাম নেই, কোনো ঠিকানা নেই। কার কাছে দেবে মেয়েটিকে। তাই পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহার আদর্শপাড়া চরহাজারী গ্রামে বড় হতে থাকে ইয়াসমিন। আস্তে আস্তে মায়া বাড়তে থাকে সাহেদের পরিবারের সদস্যদের। সাহেদের মাকে মা, দুই ভাইকে বড় ও ছোট ভাই বলে ডাকে ইয়াসমিন। সাহেদকে ডাকে মেজো ভাইয়া। স্কুলে ভর্তি করানো হয় ইয়াসমিনকে। দেখতে দেখতে ইয়াসমিন পটিয়া এ জে চৌধুরী স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর পাট চুকিয়ে ফেলে। এভাবেই কাটছিল দিন। ইয়াসমিনের ছোট জীবনের গল্পে বড় মোচড় নিয়ে আসে আরেকটি দুর্ঘটনা। সাহেদ ও অন্যদের জবানিতে সেটি ছিল গত ডিসেম্বর মাসের কোনো একদিন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল তখন। স্কুল থেকে ফিরে কী কারণে যেন পুকুরের দিকে গিয়েছিল ইয়াসমিন। হঠাৎ সে দেখতে পায়, দুই বছরের এক শিশু (সাহেদের ভাইপো) পানিতে ডুবে যাচ্ছে। খুব বেশি পানি ছিল না পুকুরে। ইয়াসমিন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উদ্ধার করে পাড়ে তোলে শিশুটিকে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ইয়াসমিন এবং জ্ঞান ফেরার পর সে হয়ে ওঠে অন্য এক ইয়াসমিন। এত দিন হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনি যে স্মৃতি, সেসব কিছু জাদুমন্ত্রের মতো একের পর এক মনে পড়ে যেতে থাকে তার। তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা জীবনের মা-বাবা, বাড়ি, শৈশবের সহপাঠী, স্কুলের নাম—আরও অনেক কিছু।

দ্বিতীয় জীবন
ইয়াসমিনের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহার আদর্শপাড়া চরহাজারী গ্রামে। তার আশ্রয়দাতা মো. সাহেদ এখন অটোরিকশা চালান। সাহেদের কুঁড়েঘরের সামনের উঠোনে বসি আমরা। ইয়াসমিন আসে। পরনে জরির কাজ করা ঝলমলে জামা। লাল ওড়না। ইয়াসমিন প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। ঘরের রোয়াকের এক পাশে বসেন সাহেদ। ইয়াসমিনকে ঘিরে জড়ো হন সাহেদের মা, বড় মা, অন্যান্য মুরব্বি আর বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চার দল। ইয়াসমিন তার কথা শুরু করে। তার উচ্চারণ শুদ্ধ। কথায় শহুরে টান স্পষ্ট।
‘সম্ভবত ২০০৫ সাল। এপ্রিলে আমার জন্মদিন ছিল। সম্ভবত ৭ তারিখ। আমরা চাঁদপুরে জন্মদিন পালন করে ফিরছিলাম। ফেরার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনাটি ঘটে। আমার পাপ্পির নাম রাকিবুল হাসনাত। মাম্মি রিয়া মুন্নী, ডাক্তার। আমাদের বাড়ি চাঁদপুরে, দাদার নাম সাব্বির জাফর। আমার বাবা একমাত্র ছেলে।’
বাবা-মায়ের সঙ্গে সিলেট-টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়ার কথাও মনে পড়ছে একটু-আধটু। স্মৃতি ফিরে পাওয়া ইয়াসমিন গড়গড় করে বলতে থাকে আনুমানিক ছয় বছর আগে তার ফেলে আসা জীবনের কথা। ‘চাঁদপুরে ও ঢাকায় আমাদের দুটো বাড়ি। ঢাকার মাতুব্বর বাজারের কাছে। ঢাকার কাছাকাছি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম। স্কুলের নাম ম্যাক্সাসাইট। পুরো নাম মনে নেই।’
‘তোমার নানাবাড়ির কথা মনে আছে কিছু?’ ইয়াসমিনকে প্রশ্ন করি।
‘নানাবাড়িতে কখনো যাইনি। আমার মাম্মি নানাবাড়ির কথা কখনো মুখে আনত না। আনতে নিষেধ করত। নানার নামও জানি না। আমাদের ঢাকার বাসায় এক আন্টি ছিলেন। তিনি বাসার কাজ করতেন। মা-বাবা তাঁকে আন্টি ডাকতে বলে দিয়েছিল। আমাদের গাড়িচালকের নাম জিয়া।’ বলল ইয়াসমিন।
যে ইয়াসমিন এত দিন বাবা-মায়ের নাম বলতে পারত না, সে এখন তার শৈশবের সহপাঠীর নামও বলতে পারছে। ‘আমার বন্ধু ছিল কিরণ। সুমন আঙ্কেলের ছেলে। ঢাকায় তাদের বাড়ির সামনে একটি বাঘ ছিল। সেটি দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাত। আমি তার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতাম।’
‘দুর্ঘটনার পর তুমি কী করলে?’
‘দুর্ঘটনার পর ওই পুলিশ আঙ্কেল আমার গলার লকেটে মাম্মি-পাপ্পির ছবি দেখে কয়েকটা লাশ দেখালেন। তারপর বলেন, তোমার বাবা-মায়ের লাশ। তারপর উনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। দুই-তিন দিন তাঁর কাছে রাখলেন। এরপর উনি বললেন, এখানে চোর-ডাকাত বেশি। তোমার লকেট, নূপুর আমার কাছে রাখো। একদিন পুলিশ আঙ্কেল গাড়ি করে আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। তারপর রাস্তায় আমাকে একটি চিপস কিনে দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। আর ফিরলেন না। এরপর আমি আর কিছুই জানি না।’
ইয়াসমিনের মনে নেই। তবে খুব সম্ভবত এই সময়েই রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সময় তাকে নিজের ছোট্ট টিনশেড ছাউনি বেড়ার কুঁড়েঘরে নিয়ে আসেন সাহেদ।

বিস্মৃত সদ্য অতীত
পুরোনো দিনের স্মৃতি ফিরে পেয়েছে ইয়াসমিন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দুর্ঘটনা-পরবর্তী গত কয়েক বছরের স্মৃতি বেমালুম ভুলে গেছে সে। তার স্কুলের নাম, শিক্ষক, নিজের সহপাঠীদের কথা—সবকিছু। জান্নাতুল ফেরদৌস পড়ে ইয়াসমিনের সঙ্গে। কিন্তু ইয়াসমিন তাকে দেখে বলে, ‘আমি তাকে চিনি না।’ সবার সঙ্গে সে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে এখন।
শুধু কি তাই! জাহানারা বেগম ইয়াসমিনকে এখানে আসার শুরু থেকে পড়াতেন। তাঁকেও চিনতে পারছে না ইয়াসমিন। কেবল তার মেজো ভাইয়া সাহেদ ছাড়া আর কাউকে মনে পড়ছে না। নতুন করে সবার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে হচ্ছে।

পাঠকের মন্তব্য
গত ২৫ জানুয়ারি ইয়াসমিনের এই সংবাদটি প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। কাহিনিটি পড়ে অনেক পাঠক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মন্তব্যে সাহেদের দায়িত্ববোধের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা। অনেকে এ ঘটনাকে সিনেমা বা গল্পের সঙ্গে তুলনা করেন।
নুসরাত নামে একজন মন্তব্যে লিখেছেন, ‘সংবাদটি পড়ে মায়া লাগছিল মেয়েটির জন্য। কিন্তু তার মা-বাবা মারা গিয়ে থাকলে সাহেদের পরিবার ও সাহেদ সত্যি তার একজন ভালো অভিভাবক বলে মনে করছি। মেয়েটির বিপদে ভাইয়ের মতো পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি বাংলা ছবি দেখে ভাবতাম এর কোনো ভিত্তি নেই। এখন দেখছি, বাস্তবেও এমন হয়...।’
অনেকে ইয়াসমিনকে তার স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
কেউ কেউ সাহেদ ও ইয়াসমিনকে আর্থিক সহযোগিতা করার কথাও বলেছেন। এ ছাড়া ইয়াসমিনের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের জন্য সাহায্য তহবিল খোলার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। আবার একজন সাহেদের ছবি প্রকাশেরও অনুরোধ করেছেন।
মামুন রশীদ নামে একজন সাহেদকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘যে দায়িত্বটা পুলিশ নেয়নি, সেটা আপনি নিয়েছেন। সাহেদ, ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করব না।’

হারানো সুর
মো. সাহেদ এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। প্রতিদিন ইয়াসমিনকে নিজের অটোরিকশায় স্কুলে দিয়ে আসেন। সাহেদের মা পাখিজা বেগমকে ইয়াসমিন পাঁচ বছর ধরে তার মা হিসেবে জানে। মেয়ের মতো করে দীর্ঘদিন ধরে লালন পালন করে আসছেন তাকে। মাঝেমধ্যে মান-অভিমানও হয় দুজনের মধ্যে। পাখিজা বলেন, ‘আঁর ফোয়া (ছেলে) যহন মাইয়াটারে নিয়ে আসে, তখন খুব ছোড। আস্তে আস্তে মানুষ করছি। আমাদের সংসারেও টানাটানি। আয়-রোজগার কম। তার ফরও আঁর (আমার) সাহেদ তার যাতে কোনো অযত্ন না হয়, সেদিকে নজর রাখে।’
একটু থেমে পাখিজা আবার বলতে থাকেন, ‘অনেক বড় ঘরের মাইয়া। তাই এহন যদি তারে তার আত্মীয়দের হাছে ফিরাই দিতে পারি ভালো। যদিও আঁরার খুব হষ্ট (কষ্ট) অইব।’
এই বাড়িতে, পাখিজার জা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে ইয়াসমিনের সখ্য সবচেয়ে বেশি।
পুরোনো স্মৃতি ফিরে পাওয়ার পর থেকে ইয়াসমিন এখন কেবল তার চাঁদপুর ও ঢাকার বাড়িতে যেতে চাচ্ছে। ‘আমাদের অনেক সুন্দর বাড়ি। সেখানে যাব। আমার বন্ধু কিরণের কাছে যাব। মেজো ভাইয়াকে নিয়ে যাব।’ ইয়াসমিন বারবার বলছিল।
সাহেদও চান তাকে তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সঠিক কোনো ঠিকানা পাচ্ছেন না। তাই তিনি থানা ও আদালতে ডায়েরি করে রেখেছেন। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি এখনো।
সাহেদ বলছিলেন, ‘আমাদের কোনো বোন ছিল না। তাই তাকে কাঁদতে দেখে তখন কোলে করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসি। সাধ্যমতো পড়ালেখা করিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে সে অনেক বড় ঘরের সন্তান। সে চলে গেলে আমাদের খুব কষ্ট হবে। তবু তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। সেটাই আমার দায়িত্ব।’
‘সিনেমায় এ রকম দেখা যায়, বাস্তবেও হতে পারে’
স্মৃতি হারানোর এই সমস্যা সম্পর্কে কী বলছেন চিকিৎসকেরা? কথা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান সহকারী মহিউদ্দিন আহমেদ সিকদারের সঙ্গে। পুকুর থেকে ডুবন্ত শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর এখানে কিছুদিনের জন্য ভর্তি করা হয়েছিল ইয়াসমিনকে। মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার। মানসিক আঘাত থেকে এ ধরনের স্মৃতিভ্রমের ঘটনা ঘটে। ইয়াসমিন লঞ্চ দুর্ঘটনার কথা বলছে। পরে আরেকটি ট্রমায় সে অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন তারা আমাদের কাছে নিয়ে আসে। সুস্থ হওয়ার পর তার আস্তে আস্তে আগের ঘটনা মনে পড়তে থাকে।’
সদ্য অতীত ভুলে যাওয়া প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন সিকদার বলেন, ‘আগের ঘটনা মনে পড়ার পর সে মাঝখানের কিছু স্মৃতি ভুলে যেতে পারে। এটাকে আমরা ট্রমা বলি। এপিসোড ভুলে যাওয়ার মতো। সিনেমায় এ রকম দেখা যায়। বাস্তবেও হতে পারে। ইয়াসমিনকে কাউন্সেলিং করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে সে আর কোনো বড় ধরনের ট্রমার মধ্যে না যায়।’

No comments

Powered by Blogger.