ক্ত মানুষ বনাম মুক্তবাজার by শহিদুল ইসলাম

এক. সোভিয়েত ইউনিয়নের শরীরে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের তকমা এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে গিয়েছিল যে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পতন হয়েছে। আমরা কেউ ভালোভাবে খতিয়ে দেখিনি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় দেশটি সমাজতান্ত্রিক ছিল কি? সোভিয়েত ইউনিয়ন কবে সমাজতান্ত্রের পথ ছেড়ে বিপথগামী হয়েছিল, আমরা আজ আর তা নিয়ে মাথা ঘামাই না।


অনেকের মতে, ১৯৬০ সালে ক্রুশ্চেভ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে 'শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র' ঘোষণা করেন, তখনই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পতন শুরু হয়। পৃথিবীর নামকরা মার্কসবাদী পণ্ডিতরা সোভিয়েত ইউনিয়নের কপালে 'সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের' তকমা এঁটে দেন এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে 'সোভিয়েতপন্থী' ও 'চীনপন্থী' কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। তখন বাংলাদেশের (পাকিস্তানের) কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিভক্তির বাইরে থাকতে পারেনি। অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী বিচ্যুতির দায়ভার স্ট্যালিনের ওপর চাপান। তাঁরা মনে করেন, স্ট্যালিন যখন লেনিন ঘোষিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিল করেন (১৯২৮), তখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের পথে পা বাড়ায়। সম্প্রতি প্রখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মার্কসবাদী পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর যেসব সমাজতন্ত্র অভিমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব বিজয়ী হয়ে সেগুলো ধ্বংস করে এবং এক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিস্থাপন করে। মার্কসীয় তত্ত্বে বলা হয় যে সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ। তাহলে গণতন্ত্রহীন একটি রাষ্ট্র বা সমাজ কি কখনো সমাজতান্ত্রিক হতে পারে? স্ট্যালিন ধ্বংস করলেও লেনিনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যে ১৯৬০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এভারেস্ট শৃঙ্গে তুলে দিয়েছিল, সে কথা কেউ-ই অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু সে অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বা সামাজিক মুক্তির মিলন না হলে তার যে পরিণাম হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন সে পরিণাম থেকে মুক্তি পায়নি। সাধারণ মানুষ যেমন অর্থনৈতিক মুক্তি চায়, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও চায়। কারণ অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রই সাধারণ মানুষের কাম্য। আজ পৃথিবীতে গণতন্ত্র নেই। করপোরেটতান্ত্রিক পুঁজিবাদ গণতন্ত্রকে গিলে খেয়েছে। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে করপোরেটতন্ত্রকে ধ্বংস করেই কেবল তা সম্ভব। কারণ করপোরেটতন্ত্র পুরোপুরি গণতন্ত্রবিরোধী। তাই আমার মনে হয়, পতনের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যা-ই হোক না কেন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় মার্কিনি প্রচার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামান্য বিচ্যুতিকে সমাজতন্ত্রের বিচ্যুতি বলে চালিয়েছে। সেই গোয়েবলসীয় প্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যদি একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা মোল্লাতন্ত্র যুক্ত থাকে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতি প্রিয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভয়। ঠাণ্ডাযুদ্ধের মধ্যে উপনিবেশমুক্ত হয়ে সেসব দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে, সেসব দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়নস অব ডলার খরচ করে এক নারকীয় রক্তাক্ত, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস রচনা করছে। ক্রমেই সে ইতিহাস উন্মোচিত হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের মৃত্যু মানে 'সব মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির' স্লোগানের মৃত্যু। কারণ এটা কেবল মার্কসবাদের কথা নয়, এ অতি পুরনো অথচ সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি। তাই মধ্যযুগের কবি চণ্ডিদাসের 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'_ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও তার জনপ্রিয়তা আজও বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি আজও সবার বড় প্রিয়, যদিও তিনি যে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেই রাষ্ট্রটিই পৃথিবী থেকে 'গণতন্ত্রের' শেষ চিহ্নটি মুছে ফেলেছে।
দুই . ১৯৫৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার তাঁর দুই সাগরেদের (ডালেস ভ্রাতৃদ্বয়) সহায়তায় ক্যু, গুপ্ত ও গণহত্যার মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন দেশগুলোর মানুষের গণতান্ত্রিক চাওয়া-পাওয়াকে হত্যা করার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই পরিকল্পনা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইতালি, মিসর, কম্বোডিয়া, চিলি, গুয়েতেমালা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং সেসব সরকারকে উৎখাত করে তাদের পছন্দের সন্ত্রাসীদের ক্ষমতায় বসায়। নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ বজায় রাখে। ১৯৭০ দশকে সেই রাজনৈতিক দর্শনের এক অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করেন মিলটন ফ্রিডম্যান। মুক্তবাজার অর্থনীতির ওই পয়গম্বরকে ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁর 'ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড ফ্রিডম' বইটি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির বাইবেল। তিনটি মূলনীতির ওপর তিনি তাঁর অর্থনীতিকে দাঁড় করান। এক. ব্যক্তিবিশেষের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের পথে সব সরকারি বাধা ও আইন-কানুনের অপসারণ; দুই. রাষ্ট্রের সম্পদ কিছু করপোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া, অর্থাৎ প্রাইভেটাইজেশন; এবং তিন. সরকারের সামাজিক খাতে ব্যয় সঙ্কোচন এবং সেবা খাতেরও বেসরকারীকরণ। মূলকথা, রাষ্ট্রকে ক্রমে শক্তিহীন করে ব্যক্তিবিশেষের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়া। তাই দেখা যায়, তেল-গ্যাস-কয়লা-বিদ্যুৎ-কম্পিউটার-মোবাইল-ল্যান্ডফোন-মিডিয়া থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, বাস-রেল-বিমান_সব কিছুই আজ পৃথিবীর কয়েকজন অর্থনৈতিক সন্ত্রাসীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। শুধু কি তাই? মানুষের হাতে প্রকৃতি উদার হাতে যে অফুরান ভাণ্ডার তুলে দিয়েছিল, সেগুলোও তাদের দখলে চলে যাচ্ছে। পানি ইতিমধ্যে এক মহার্ঘ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর কিছুদিন পর হয়তো তারা বাতাসের ওপর মূল্য ধার্য করবে। এটা হাসির কথা নয়। মাত্র ৩৫ বছর ফ্রিডম্যানীয় মুক্তবাজার অর্থনীতির সাফল্যের দিকে তাকালে তা অসম্ভব মনে হয় না। পয়গম্বরের মৃত্যুর এক মাস পর ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের World Institute for Development Economics Research একটি গবেষণা-সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে। (www.wider.anu.edu)। প্রেস রিলিজে বলা হয়, সবচেয়ে ধনী দুই শতাংশ মানুষ পৃথিবীর মোট সম্পদের অর্ধেকের মালিক। তাদের এই সম্পদ অর্জন শান্তিপূর্ণভাবে হয়নি। আইনতও নয়। জোর-জবরদস্তি, ক্যু-পাল্টা ক্যু, হত্যা, গণহত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এই সম্পদ অর্জন করেছে। আরেকটু তথ্য। ১৯৭০ সালে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে গরিব মানুষের চেয়ে ১২ গুণ বেশি উপার্জন করত, ফ্রিডম্যানীয় তত্ত্বের প্রয়োগের বদৌলতে ২০০২ সালে সেখানে ধনীরা গরিবদের তুলনায় ৪৩ গুণ বেশি উপার্জন করেছে। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট রিগান যখন মুক্তবাজার অর্থনীতির গাড়ি চালু করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সিইওরা সাধারণ মানুষের চেয়ে ৪৩ গুণ বেশি আয় করত। ২০০৫ সালের মধ্যে সে অর্থনীতি সিইওদের আয়কে ৪১১ গুণে পেঁৗছে দিয়েছে। ১৯৫০ সালে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক প্রতিবিপ্লবের পর সিইওরা তার সুফল ভালোভাবেই ঘরে তুলেছে। কিন্তু 'সেই বর্ধিত সম্পদ সবার হাতে তুলে দেওয়া হবে'_মুক্তবাজার অর্থনীতির সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্ববাসী আজ বিশ্বাস হারিয়েছে।
তিন . ফ্রিডম্যানীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষ ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে। তার এক বিশিষ্ট রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লাতিন আমেরিকায়। প্রায় ১০০ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন ও লুটপাটের পর আমেরিকার বুকের ওপর যেন বিষফোঁড়ার মতো জেগে উঠেছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের শত অপপ্রচার সত্ত্বেও ২০০৬ সালে 'একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের' স্লোগান নিয়ে ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো হুগো শ্যাভেজ জিতে ভেনিজুয়েলায় সরকার গঠন করেছেন। উরুগুয়ের বামপন্থী জোট নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। ২০০৬ সালে ব্রাজিলের নির্বাচনে লুলা ডি সিলভা ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে আবার নির্বাচিত হন। ব্যক্তিগতকরণের বিরুদ্ধে তিনি সে নির্বাচনকে জনমত যাচাই হিসেবে নিয়েছিলেন। পর পরই নিকারাগুয়ায় জয়লাভ করেন সান্দ্রিনিস্তার সাবেক সভাপতি দানিয়েল ওর্তেগা। তিনি জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্র স্প্যানিশ ফার্মের কাছে বিক্রির বিরোধিতা করে বলেন, 'কে স্প্যানিশ ফার্মকে ডেকে এনেছে?' উত্তরে বলেন, 'বড়লোকদের সরকার' যারা বর্বর পুঁজিবাদের চাকর। ২০০৬ সালের নভেম্বরে ইকুয়েডরের নির্বাচনে জয়লাভ করেন ৪৩ বছর বয়স্ক বামপন্থী রাফায়েল কোরেরা। নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা দেন, 'আমি মিলটন ফ্রিডম্যানের সমর্থক নই।' বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন বলিভিয়ার ইভা মোরেলস। ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার প্রাক্কালে তিনি বলেন, '৫০০ বছরের প্রতিরোধ বৃথা যায়নি। এই গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ আমাদের পূর্বপুরুষের যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। এ লড়াই আবার পূর্বপুরুষ আদিবাসী নেতা তুপাক কাটারির লড়াই_এ লড়াই চে গুয়েভারার লড়াই।' তিনি দেশের গ্যাস ও খনিগুলো বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির কবল থেকে মুক্ত করেন। ফ্রিডম্যানীয় চিকাগো-স্কুল পরীক্ষার বিরোধিতা করে চিলি ও আর্জেন্টিনার রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে অংশ নেন। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নেস্টর কির্চনার নিজেই স্বৈরশাসকের শিকার হয়েছিলেন। সামরিক ক্যুর ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক জমায়েতে তিনি বলেন, 'আমরা ফিরে এসেছি।' ৩০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল জান্তার শাসনামলে। চিলির প্রেসিডেন্ট মিচেল বেচলেট হাজার হাজার নির্যাতিতের একজন, যাঁরা পিনোচেটের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে তাঁকে ও তাঁর মাকে গ্রেপ্তার করে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল পিনোচেট। পিনোচেটের প্রতিবিপ্লবে অংশগ্রহণে অস্বীকার করায় সামরিক অফিসার তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ফ্রিডম্যানের মৃত্যুর এক মাস পর লাতিন আমেরিকার নেতারা বলিভিয়ায় সমবেত হয়ে নয়া-সাম্রাজ্যবাদ, মুক্তবাজার ও করপোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের শপথ নেন। ভবিষ্যতে আমেরিকা-সমর্থিত যেকোনো ধরনের ক্যুর বিরুদ্ধে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। ভেনিজুয়েলা, কোস্টারিকা, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সরকার ভবিষ্যতে আর আমেরিকায় কোনো ছাত্র পাঠাবে না। এ ছাড়া আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সব রকম লেনদেন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ভেনিজুয়েলা ইতিমধ্যে সে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। নিকারাগুয়া ঋণ পরিশোধ করে সরে আসতে চাইছে। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট কির্চনার স্পষ্ট বলেছেন, 'আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র। তোমরা কেটে পড়।'
৮০ ও ৯০-এর দশকে লাতিন আমেরিকায় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক খুবই শক্তি রাখত। আজ তারা সেখানে কোনো শক্তিই নয়। ২০০৫ সালে লাতিন আমেরিকার ঘাড়ে আইএমএফের মোট ঋণের ৮০ শতাংশ চেপে ছিল। ২০০৭ সালে তা মাত্র এক শতাংশে নেমে এসেছে। কির্চনার ঘোষণা দিয়েছেন, 'আইএমএফের পরেও জীবন আছে এবং তা সুন্দর জীবন।' মাত্র তিন বছরে সমগ্র বিশ্বে আইএমএফের সরবরাহ করা ঋণের পরিমাণ ৮১ বিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের অবস্থাও তথৈবচ। ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাংকের সব ঋণ নেওয়া বন্ধ করেছেন এবং সেখানে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। বলিভিয়া বিশ্বব্যাংকের 'আরবিট্রেশন কোর্ট' বর্জন করেছে। ২০১০ সালের প্রথমে আমেরিকা ও কানাডাকে বাইরে রেখে লাতিন আমেরিকার ৩০টি দেশ 'ন্যাটো'র প্রতিপক্ষ হিসেবে সাউথ আটলান্টিক ট্রিট্রি অরগানাইজেশন (SATO) গঠন করেছে।
চার . বিগত ৩৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র চরম হিংস্রতার সাহায্যে সারা বিশ্বে যে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করেছিল, আজ সারা বিশ্বের মুক্ত মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো রকম শোষণের বিরুদ্ধে মুক্ত মানুষের এ লড়াই চিরন্তন। শুধু তৃতীয় বিশ্বেই নয়, উন্নত বিশ্বের বিবেকমান প্রগতিশীল মানুষ এই নয়া-সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। ইউরোপ ও খোদ আমেরিকায় ফ্রিডম্যানীয় মুক্তবাজার অর্থনীতির বদৌলতে যে দুই শতাংশ মানুষ পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ দখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মী ও গণতন্ত্রী মানুষ বিভিন্ন দেশের রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলনে জোট বাঁধছেন। এমনি আন্দোলনে আক্রান্ত হয়েছেন বিল গেটস ও তাঁদের পয়গম্বর ফ্রিডম্যান স্বয়ং।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে যাঁরা সমাজতন্ত্রেরও পতন হয়েছে বলে দাবি করেন, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মানুষ তা মিথ্যা প্রমাণ করেছে। সেখানে জাতীয়তাবাদী-মার্কসবাদী জোট একের পর এক নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। তারা 'একুশ শতকের সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদের দখলে থাকা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করেছেন। একুশ শতকের সমাজতন্ত্র হলো : গণতন্ত্র+সমাজতন্ত্র। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কিংবা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। করপোরেট পুঁজিবাদ ও তার হোতা যুক্তরাষ্ট্র যাকে ভীষণ ভয় পায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.