অপরাধী চক্রকে শনাক্ত করা জরুরি-কিডনি কেনাবেচা

সুস্থ-সবল কোনো মানুষ একটা কিডনি স্বেচ্ছায় দান করলে তেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয় না বলে চিকিৎসকেরা মনে করেন। তবে অতিদরিদ্র মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ কিডনি বেচার মানে কোনোভাবেই এর সঙ্গে মেলানো যায় না। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দাম ঠিক করে দেওয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো, নিদারুণ অর্থকষ্টে থাকা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। তাই বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা নিষিদ্ধ।


কিন্তু সেই আইন অকার্যকর গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকেই জানা যাচ্ছে। জয়পুরহাটের কালাইয়ের ১৮ গ্রামে গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক মানুষ নিজের কিডনি বেচে দিয়েছেন। বেসরকারি সংস্থার ঋণের চাপ থেকে মুক্তি পেতে আর দালালদের প্রলোভনে নগদ অর্থপ্রাপ্তির আশায় তাঁরা এ কাজ করেছেন। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা-ও তাঁরা জানতেন না। এর ওপর এই অভাবী মানুষেরা চুক্তিমাফিক অর্থও পাননি। মাঝ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ লোপাট করেছে দালালেরা।
রাজধানীর প্রসিদ্ধ হাসপাতালগুলো—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন ও ইউনাইটেড হাসপাতালে বেশির ভাগ অস্ত্রোপচার হয়েছে। অথচ এদের কর্তাব্যক্তিরা এসবের কিছুই জানতেন না—এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। অস্ত্রোপচার-সংক্রান্ত কোনো নথি ও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রও দেওয়া হয়নি হাসপাতাল থেকে। এমনকি কিডনিদাতা ও গ্রহীতার তথ্যাবলি সংরক্ষণের কথা থাকলেও হাসপাতালগুলো কোনো রেকর্ড সংরক্ষণ করেনি। শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালগুলো সাধারণ সেবাপ্রার্থীবান্ধব না হয়ে ‘দালালবান্ধব’ হয়ে পড়া দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরে।
বহু মানুষ এমন নিদারুণ হতাশার ভেতর দিন যাপন করেন যে নিজের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, এমনকি নিজেকেও বেচে দিতে কুণ্ঠিত হন না। এ জন্য দায়ী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী অপরাধী চক্র। দেশ-বিদেশের বিত্তবানদের জন্য কালোবাজারে যাচ্ছে গরিবের এই কিডনি। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, এর সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স ও ব্যবসায়ীরাও জড়িত। যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা মাঠপর্যায়ের দালাল। তাঁদের দুজন নিজেও কিডনি বিক্রি করেছেন। কিন্তু পেছন থেকে কারা কলকাঠি নাড়ছে আর লুটে নিচ্ছে দরিদ্র মানুষের শরীর ও স্বপ্ন, তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি।
বেসরকারি সংস্থার ঋণ যেখানে দারিদ্র্যমুক্তি ঘটানোর কথা, সেখানে কালাইয়ের দরিদ্র মানুষ কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন, তা ভাববার বিষয়। ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে তাঁদের কিডনি বেচার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এ ঘটনায় ঋণ কার্যক্রমের অমানবিক দিক নিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর টনক নড়া উচিত।
অভাব তাড়াতে মানুষ নিরন্তর উপায় খোঁজে। এমনকি আত্মঘাতী পথ মাড়াতেও দ্বিধা করে না। এমন অঘটন ঠেকাতে দরকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। বিশেষ করে, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচার যে জাল বিস্তৃত হয়েছে, তা ভেঙে দিতে হবে। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচার মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ, চিকিৎসক, সুশীল সমাজের সদস্য—সবারই আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.