চারদিক-তাঁত কারিগর

গাছপালায় ঘেরা টিলার ওপর মাটির তৈরি ঘরবাড়ি। সবখানেই শান্ত ছায়া। ঠান্ডার ছোঁয়া। কোথাও হই-হুল্লোড় নেই। যন্ত্রযানের উচ্চশব্দ নেই। এ রকম একটি টিলার ওপর একটি ঘরের বারান্দায় বসে অনেক কথাই হলো গ্রামের নারী-পুরুষ অনেকের সঙ্গে; তাঁদের ভালো থাকা, মন্দ থাকার নানা দিক নিয়ে।


এখানকার নারীদের দারিদ্র্য এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তির নানা চেষ্টার কথা উঠে আসছিল সেসব কথায়। মণিপুরি তাঁতে কাপড় বোনা শেখার কথা বলছিলেন অনেকে।
ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। কাঁচা মাটির পথ। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কাদা ও গর্তে পায়ে চলাই মুশকিল। পিচ্ছিল কাদায় অনভ্যস্ত পা ধরে রাখা কঠিন; যদি আবার বৃষ্টি আসে! যদিও এই এলাকার নিভৃত গ্রামগুলোর নারী-পুরুষ-শিশু যুগ যুগ ধরে এই কাদামাটির পথ ধরেই চলাচল করছে। মাত্র দুই-আড়াই কিলোমিটার পথ পাকা হলেই অনেক মানুষের দুর্ভোগ কমে যেত।
ফেরার তাড়া। ফেরার জন্য বিদায় নিয়ে সেই বাড়ি থেকে একটু সামনে এগোতেই পেছন থেকে কেউ একজন বললেন, ‘আপনারা যে এলাকায় তাঁত দেখলেন, এগুলো কিন্তু আমার বানানো।’
মুহূর্তেই মাথায় ‘তাঁত কারিগর’ কথাটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এ কথাটা যিনি বললেন, আমরা এতক্ষণ তাঁর ঘরের বারান্দাতেই বসেছিলাম। তাঁর নাম জানতে চাইলেই বললেন, ‘সফর আলী।’ তাঁর বয়স এখন ৫৫ বা এর কম-বেশি। তাঁত নিয়ে কথা উঠতেই বললেন, ‘আমাকে মাতৃগর্ভে রেখে বাবা মারা গিয়েছিলেন।’ একটি ভূমিহীন পরিবারে যে শিশু জন্মের আগেই পিতাকে হারায়, ভাবতে আর অসুবিধা হয় না তার সংগ্রামটা কত তীব্র; কত লড়াকু জীবন তার। সফর আলী জানালেন, মাত্র আট-দশ বছর বয়সেই তাঁকে কাজে নামতে হয়েছে। পাঁচ টাকা আট টাকা রোজে কাজ শুরু করেন তিনি। কাজটা কী—মণিপুরি তাঁত বানানো। এলাকাটি মণিপুরি-অধ্যুষিত। মণিপুরিদের ঘরে ঘরে তাঁত আছে। তাই তাঁতের চাহিদাও আছে। প্রথমে তাঁর ওস্তাদ ছিলেন সুকই সিংহ। সফর আলী বললেন, ‘মূলত ওস্তাদ সুকই সিংহের কাছে আমি কাজটা শিখি।’ পরে ব্রজকিশোর সিংহ ও খাম্বা সিংহের কাছে কাজ শিখেছেন। তিনি জানান, তাঁর এলাকাটা পাহাড়ি হওয়ায় কাঠ সুলভ। অল্প দামে তিনি সহজেই তাঁত তৈরির জন্য কাঠ সরবরাহ করতে পারতেন। এ জন্য ওস্তাদেরা তাঁর ওপর ভরসা করতেন।
একসময় সফর আলী নিজেই কাজ শিখে ফেললেন। একাই তাঁত বানানোর কলাকুশল তত দিনে তাঁর করায়ত্ত। নিজ এলাকা ছাড়িয়ে অন্য এলাকায়ও তাঁর তৈরি তাঁতের নামধাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন অনেকের কাছেই তিনি ‘তাঁতমিস্ত্রি’ বা ‘তাঁত কারিগর’। অনেক কাজ তাঁর। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জায়গাটা তত দিনে তৈরি হয়ে গেছে। সফর আলী জানালেন, অনেকে কাঠের কাজ করলেও এলাকায় তাঁতের কারিগর খুব বেশি ছিল না। এখনো নেই। একটি মণিপুরি তাঁতে নানা রকম উপাদান লাগে। এর মধ্যে আছে—তারেং (চরকা), কনাচাই (রুল), পাঙান দেব (কাপড় বোনার জন্য সুতা টানার তিনটি ছোট যন্ত্র), চিরুনি, দুই হাজার সোনা (চিকন তারের তৈরি), চিরুনি বাস, পারালি (পা রাখার স্থান) ইত্যাদি। এই তাঁত তৈরিতে সাধারণত রাতা, গামাই ও নিমের কাঠ লাগে। ছোট (সিঙ্গেল) একটি তাঁত তৈরিতে দুজনে মিলে সময় লাগে তিন দিন এবং বড় (ডাবল) একটি তাঁত তৈরিতে সময় লাগে পাঁচ দিন। ছোট তাঁতযন্ত্রে মজুরি নেন দেড় হাজার এবং বড় তাঁতযন্ত্রে আড়াই হাজার টাকা।
সফর আলী বলেন, ‘এই তাঁত তৈরি করেই আমার জীবন চলে। ৪৫ বছর ধরে তাঁত বানাই। এ পর্যন্ত কম করেও ৫০ হাজার তাঁত বানিয়েছি। এ এলাকায় এখন যে তাঁত দেখছেন, এর বেশির ভাগই আমার তৈরি।’ তাঁর কথায় চোখেমুখে একজন তাঁত কারিগরের সাফল্য যেন ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁত বানানোর সাফল্য যতই তাঁকে আলোড়িত করছে, সেভাবে তাঁর জীবনের চাকা সামনে ততটা এগিয়ে যায়নি। এক ভিটা ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সাতজনের সংসার। ঘরে দুটি মণিপুরি তাঁত বসিয়েছেন। মেয়েরা সেই তাঁতে কাপড় বোনে। এসব দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। সফর আলীর বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল (আদি বা মধ্য) গ্রামে।
ছেলে আনোয়ার হোসেনের বয়স এখন ২৫। বাবার কাজের দায়িত্ব অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। শিখেছেন তাঁত তৈরির কাজটিও। তিনি বললেন, ‘আমাদের তৈরি তাঁত শুধু ভানুবিল নয়—ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। এ এলাকায় কাঠ সহজে পাওয়া যায় বলে তাঁত তৈরিতে সমস্যা হয় না। তবে পুঁজি পেলে আরও তাঁত বানিয়ে বসাতে পারতাম। এখন কোনোরকম চলতে পারছি।’ আনোয়ার হোসেন জানান, আগে সপ্তাহে বা মাসে তিন-চারটা তাঁত সরবরাহের চাহিদা ছিল। এখন অনেক কমে গেছে।
কিন্তু সফর আলীর তাতে কোনো হতাশা নেই; বরং এই তাঁত তাঁকে উঠে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে। জীবন চালানোর শক্তি দিয়েছে। নিজের হাতে তৈরি প্রতিটি তাঁতই তাঁর কাছে সন্তানের মতো। অনেক আদরের, অনেক ভালো লাগার ও ভালোবাসার।
আকমল হোসেন

No comments

Powered by Blogger.