বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম অনন্য সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আবদুস সালেক চৌধুরী অবস্থান নিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে।


নির্ধারিত সময় তিনি সংকেত দেওয়া মাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের সবার অস্ত্র। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছেন। একপর্যায়ে ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করল। ঠিক তখনই মুক্তিযোদ্ধারা চরম এক সংকটে পড়লেন। তাঁদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেল। আবদুস সালেক চৌধুরী সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন। এ ঘটনা নয়নপুরে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে।
নয়নপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। সালদা নদী রেলস্টেশনের কাছে। ১৯৭১ সালে সালদা নদী, নয়নপুরসহ আশপাশের গোটা এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানিরা তাদের এই প্রতিরক্ষা অবস্থান আরও মজবুত করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ করেন। তখন ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সালেক চৌধুরী। এ যুদ্ধের একটি বর্ণনা পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা উইং কমান্ডার (অব.) কামালউদ্দিন আহমেদের বর্ণনায়।
তিনি লিখেছেন, ‘আমরা প্রায় প্রতিরাতে সালদা নদীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিফেন্স পজিশেনে রেইড দিতাম। তারা (পাকিস্তানি) থাকত সুদৃঢ় ব্যাংকারে এবং উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। প্রতিটি রেইডেই কমবেশি ক্যাজুয়ালিটি হতো। একদিন মেজর সালেক, ক্যাপ্টেন গাফফার ও আমি চিন্তা করলাম ওদেরকে ঘেরাও করে সারেন্ডার করানো যায় কি না। এটা ছিল বড় রকমের আক্রমণের পরিকল্পনা।
‘ঠিক ভোর পাঁচটায় ইন্ডিয়ান আর্মির আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফার শত্রুর রিয়ার দিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন। গোলাগুলির প্রচণ্ডতায় আমি নিশ্চিত ছিলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি সারেন্ডার করতে বাধ্য হবে। অবস্থান পরিবর্তনের কারণে মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রইল না। পাঁচটা ৩০ মিনিট পর্যন্ত দেখলাম, পাকিস্তানি সেনারা শক্তভাবে মাটি কামড়ে বসে আছে। সারেন্ডার করার কোনো লক্ষণই তাদের মধ্যে নেই!
‘এদিকে আমি আমার ভান্ডারের সব গোলাবারুদ উজাড় করে দিলাম শত্রুর ওপর। এ ব্যাপারটি ছিল খুবই বিপজ্জনক। কারণ, আমার ও শত্রু অবস্থানের মধ্যে কোনো ব্যারিয়ার ছিল না। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। আমি চিন্তিত হলাম এই ভেবে যে, ফরসা হয়ে গেলে রিট্রিট করা খুব ডিফিকাল্ট হয়ে পড়বে। ঠিক তখনই মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফারের এলাকা থেকে গুলির আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল। ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে খবর পেলাম তাঁরা রিট্রিট করেছে। এটা ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম সরাসরি আক্রমণ।’
আবদুস সালেক চৌধুরী ১৯৭১ সালে চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। কর্মরত ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মার্চ মাসে ঢাকায় ছিলেন। ২২ এপ্রিল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর খালেদ মোশাররফের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। পরে সেক্টর গঠিত হলে দুই নম্বর সেক্টরের সালদা নদী সাবসেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। অক্টোবর মাসে মেজর খালেদ মোশাররফ আহত হলে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুস সালেক চৌধুরীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২।
আবদুস সালেক চৌধুরী ১৯৭২ সালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার হাতুরপাড়া গ্রামে। তবে তার বাবা বাস করতেন ঢাকা মহানগরের টিকাটুলির ২৭ নম্বর অভয় দাস লেনে। বাবার নাম আবদুল রহিম চৌধুরী। মা সায়মা খানম। সালেক চৌধুরী ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ। তাঁরা আট ভাইবোন। অবিবাহিত ছিলেন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.