অনুভবে একুশ ও প্রিয় বাংলা ভাষা by মোঃ ফিরোজ সোহাগ

ভোরে দোয়েলের মনকাড়া শিস শুনে আর হালকা সবুজাভ সোনালি রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যখন তুলতুলে মাটির বুকে চলতে শুরু করি, তখন হৃদয়ের সতেজটা যেন গাঙচিলের সীমাহীন ছুটে চলাকেও হার মানায়। চোখে নীলাভ স্বপ্ন আর মুখের বুলির তুবড়ি যেন চরকায় সুতা বোনার শব্দকেও স্তব্ধ করে দেয়।


মনে করিয়ে দেয় শুষ্ক বাতাস; আমি কতটা স্বাধীন! অনেক বেশি দাম দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আত্মত্যাগের শুরুটা মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরেই। বাংলার ভাষা শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক অনুপ্রেরণার উৎস। ভাষা শহীদদের স্মরণেই ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা আরোপ, ভাষাকেন্দ্রিক অসাম্য সৃষ্টি ও শোষণ, ভাষাভিত্তিক উপেক্ষা ও প্রান্তিককরণ পৃথিবীর কোথাও আর নীরবে মেনে নেওয়া হচ্ছে না।
ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার পণ্ডিত শিক্ষক এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি চেশোয়েভ মিয়োশ তার প্রতিটি কবিতাই লিখেছেন মাতৃভাষা পোলিশে। তিনিও দেশ হারিয়ে ভাষায় বসবাস করেছেন এবং বলেছেন, 'আমার মাতৃভাষাই আমার মাতৃভূমি।' সে ভাষা পোলিশ, ইংরেজি কিংবা ফরাসি নয়। খুবই সংবেদনশীল এই ভাষ্য_ ভাষাই মাতৃভূমি, ভাষাই মা। তারপরও নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি ভাষা চিরতরে বিলীন হচ্ছে। একদিকে মাতৃভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে, অন্যদিকে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অনেককেই মাতৃভাষা থেকে সরেও যেতে হচ্ছে।
বাংলা ভাষা কি ভালো আছে? বিনা স্বদেশী ভাষা আশা যে মেটে না_ এই সত্য বারবার স্বীকার করেও বাংলার প্রসার আমরা তেমন ঘটাতে পারিনি। ভবিষ্যতে যে ঘটবে তার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল নয়। স্পষ্ট বিভাজিত তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার দুটি মূলধারায় বাংলার চর্চা ও বিকাশের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। একটি মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা, অন্যটি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থা। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণে মাতৃভাষার সর্বাধিক বিকাশ ঘটতে দেখা গেছে। নতুন সহস্রাব্দে এসে এখন বাংলাদেশের শহরগুলোতে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোরও অন্যতম স্বপ্ন; তাদের সন্তানকে যদি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানো যেত! একালের বাজার ব্যবস্থায় এই স্বপ্নটি দেখাই স্বাভাবিক। চাকরিদাতা রাষ্ট্রই হোক কিংবা বেসরকারি খাতই, ইংরেজি জানা প্রার্থীই যে অগ্রাধিকার পাচ্ছে এটা আর লুকায়িত সত্য নয়, প্রকাশ্য। বাংলা ভাষায় আবেগমথিত কাব্য রচনা করতে পারলেও বাংলা ভাষার জন্য আমরা মূল্য সংযোজন করতে পারিনি। মূল যেটুকু সংযোজিত হওয়ার ইংরেজি জানা প্রার্থীর ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
জন্মের পর প্রথম বুলি হিসেবে পাওয়া মা শব্দটি এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাম্মিতে রূপ নিতে চলেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে বহির্বিশ্বের আধুনিকতা বাংলার মানুষের পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাষাকেও সংকুচিত করে ফেলেছে। তাল মিলিয়ে উন্নতির পথে চলার প্রচেষ্টায় কাম্য উন্নতি ধরা না দিলেও নিজ মাতৃভাষাকে অন্য দেশের ভাষার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলাটা প্রায় অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের। অথচ সংবিধান বাংলাকেই করেছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনও তো বাংলার পক্ষেই। উচ্চ আদালতসহ রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাকে এখনও আপন করে নেয়নি। আইনি বাধার দোহাইও এখন অচল। তাই আজ ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তিতে আরেকবার শপথ নেওয়ার সময় এসেছে যে ভাষার জন্য রফিক, শফিক, বরকত প্রাণ দিল তা শুধু একটি সংখ্যা ২১ বা একটি তারিখের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের চেতনা ও জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে আগামীর পথে চলার।
স শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.