কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

কেবল আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারকে দুষলেই তো হবে না, জাতীয় জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরাও কী গত সাড়ে তিন দশকে সৃষ্ট ভয়াবহ ভুলগুলোর দায় এড়াতে পারবেন! মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী রাষ্ট্রনৈতিক পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁরাও কী সম্পৃক্ত ছিলেন না! এখনো কী থাকছেন না!


বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড়ে কুড়াল মারা এবং তাকে জায়েজ করার সময় শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ানরা কথা বলেননি। হয়তো ব্যক্তিজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য, কাঙ্ক্ষিত সামাজিক অবস্থান, বিত্তসঞ্চয় ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কেউ কেউ 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' নীতিতে দূরে থেকেছেন। কেউ কেউ বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা থাকেনি বলে তাঁরা হয়তো যে যাঁর নিজের মতো চলেছেন। ভেবেছেন যদি কখনো তেমন সুযোগ আসে তবে কৃতকর্মের কালো দাগগুলো ধুয়ে-মুছে সাফ করে পথে এলেই হবে। সব কিছু গুঁড়িয়ে তাঁরা পথে এসেছেন এবং ভালো যে তাঁরা এখন যা বলছেন তা যথার্থ কথা। অন্তত আমার মনের কথাই যে তাঁরা বলছেন সে ব্যাপারে দ্বিরুক্তি করব না। মন্দের ভালো মনে করে সেসব কথার অনুরণন তুলে আমিও বলি, '৭২-এর সংবিধানে পুরোপুরি ফিরতে চাই। জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত দেখতে চাই। দ্রোহ-প্রেমের শাশ্বত ঐতিহ্যের রসসিঞ্চিত ভূমিতে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল মূর্তি পেতে চাই। সেখানে কোনো ছাড় দেওয়া কিংবা আপস করার পক্ষে আমি নই। এখানে একটা কথা বলি, আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার আমল বলেই বোধ হয় অনেক সত্য দ্বিধাহীনভাবে জোর গলায় বলা যাচ্ছে। অপছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে হৈচৈ করা যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় ইচ্ছামতো লেখা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সমালোচনা করা যাচ্ছে। প্রতিবাদী হয়ে ভীষণ সাহস দেখানো সম্ভব হচ্ছে। জিয়াউর রহমান যখন গোলাম আযম, শাহ আজিজ, আলিমদের মতো চিহ্নিত রাজাকারদের পাশে নিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিলেন, তখন আজকের অনেক বীরকে চুপ থাকতে দেখেছি। কেবল চুপ কেন, প্রবল প্রতাপশালী জিয়ার সানি্নধ্য এবং দাক্ষিণ্য পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হতে দেখেছি। বাংলাদেশ বেতারকে পাকিস্তানি আদলে রেডিও বাংলাদেশ করার ব্যাপারে চুপ থাকতে দেখেছি। বিটিভিতে রবীন্দ্রসংগীতের রুটিন অনুষ্ঠান বন্ধ করা হলেও চুপ থাকতে দেখেছি। সুফিয়া কামাল, কলিম শরাফীর মতো গুণীদের কালো তালিকাভুক্তিতে দেখেও না দেখার ভাণ করতে দেখেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে নীরবে মেনে নিতে দেখেছি। সিনেমা, নাটক, গান, প্রকাশনা ইত্যাদি দিয়ে জিয়াকে খুশি করার দলে আজকের অনেক সামাজিক বীরও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে জিয়াকে বড় বানানোর প্রোপাগান্ডায় যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন তাঁদের তো আজও আশপাশে বুক চিতিয়ে আত্মপ্রচারণার বেসুরো ঢাক পেটাতে দেখি। তবে হ্যাঁ, তাঁরা সব কিছু গুছিয়ে-গাছিয়ে পথে এসেছেন এবং জাতি-দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছেন, কলাম লিখছেন, টকশোতে বসছেন। আমি এটাকে পুরোপুরি ভালো বলি না। বলি, মন্দের ভালো। যা নিয়ে তৃপ্ত হতেই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে আবারও বলি, মন্দের ভালো যাঁরা করছেন তাঁদের কথাও লেখা আমি গভীর মন দিয়ে শুনি এবং পড়ার চেষ্টা করি। আবারও বলি, তাঁদের কথায় আমি আমার নিজ ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাবনা, প্রত্যাশা ও বেদনার অনুরণন পাই। দেশ ও জাতির রক্ষাকবচ এবং সর্বোচ্চ দলিল জাতীয় সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযোজনের ব্যাপারে উলি্লখিত বিশিষ্টজনদের কথাবার্তা ও যুক্তির পক্ষে আমি। বিষয়টি '৭৫-পরবর্তী সময়ে জিয়া সংবিধানে সংযুক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশটাকে পাকিস্তান বানানো এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের অবজ্ঞা করে সংখ্যালঘু বানানোর স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি এটা করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও চেতনার প্রতি বুটজুতার নিষ্ঠুর লাথি ছিল জিয়ার এই উদ্যোগে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে ছিল জিয়ার এই পদক্ষেপ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক জীবনাচারের পরিপন্থী এই বিষয়টিকে যদি আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি দেয় তবে তো তা আমার মতো কারো কারো কাছে আশাহত বেদনারই হবে। রাজনৈতিক নেতারা 'বিসমিল্লাহ' সংযোজনের পক্ষে যা বলেন তা তাঁদের মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে না। যেসব কথা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য এবং দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের পরিপন্থী। বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য ত্যাগী নমস্য নেতার বিশ্বাসের পরিপন্থী। বাঙালি জাতির হাজার বছরের সর্বধর্ম সমন্বয়ের মানবিক জীবন দর্শনের সঙ্গে তার মিল থাকে না। নেতাদের কথায় পাকিস্তানি শাসকদের মনোবাসনার ছায়া দেখতে পাই যেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁর কবর দেওয়া হয়েছে। দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা পাকিস্তান আমলেও ছিল। বঙ্গবন্ধু এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছেন। অথচ তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে এটা নিয়ে মাথাই ঘামাননি। তিনি যদি চাইতেন তবে তো পারতেনই। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যা করেননি, জিয়া সেটাই করেছিলেন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সস্তা এবং ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে। আজ যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার সংসদে এই পদ্ধতি সিদ্ধ করে নেয় তবে তো জিয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সঠিক বলেই স্বীকৃতি পাবে। এই ব্যাপারে বর্ষীয়ান কেউ কেউ সর্বধর্ম সমন্বয়ের ব্যাপারে ফর্মুলা দিচ্ছেন। সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'-এর স্থলে বাংলায় 'পরম করুণাময় সর্বশক্তিমানের নামে' জাতীয় বিষয় সংযোজন করা হলে সব ধর্মাবলম্বীই নাকি সহজ ও স্বাভাবিকভাবে তা উচ্চারণ করতে পারবেন। ওই যে আবার সেই মন্দের ভালো এসে গেল। এটি আসল সমাধান নয়, জোড়াতালি। তবুও মন্দের ভালো। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম? সেটার কী হবে! স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি এবং পাকিস্তানসহ আরব বিশ্বকে খুশি করতেই এই বিধান সংযোজন করা হয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র-যুব সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষক সমাজ, প্রগতিশীল সাংবাদিক সবাই এ বিধানের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগও ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেদিনের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের কথা তো এত অল্পসময়ে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রের যে কোনো ধর্ম থাকে না, এ কথা বোকাও বোঝে। তবু রাজনীতির কুটিল হিসাব-নিকাশে আজ এরশাদের কারণেই আওয়ামী লীগকে জেনেশুনে বিষপান করতে হচ্ছে। সংবিধান সংশোধনে গঠিত জাতীয় কমিটি এসব ব্যাপারে নানা পেশার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। তার মধ্যে অবশ্য সংস্কৃতিচর্চায় নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলেন বলে শুনিনি। তবে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কারো কারো কাছে আলোচনা-সংক্রান্ত কথাবার্তা শুনেছি। মতবিনিময় শেষে সংশোধনী কমিটির মুখপাত্র এবং বিশিষ্টজনদের মন্তব্য ও বক্তব্য দেখেছি ও শুনেছি। গণমাধ্যমে। বুঝেছি ব্যাপারটা অনেকটাই লোক দেখানো। মতবিনিময়ের ব্যাপারটি ওয়ানওয়ে ট্রাফিক হয়েছে। ফল সম্ভবত যথা পূর্বং তথা পরং। দেখেশুনে বগল বাজাচ্ছেন এরশাদ। সেই সঙ্গে অবশ্যই বিএনপি ও জামায়াতও। তারাও তো এটাই চেয়েছে। ফতোয়ার ব্যাপারেও এরা খুশি। শেষ পর্যন্ত যদি আওয়ামী লীগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শরিয়াহ আইনটিও বাগিয়ে নেওয়া যায় তবে তো আর কথাই নেই। এটি আশঙ্কার কথা। সত্য হবে না জেনেও আশঙ্কা হয়। ঘরপোড়া গরুর অবস্থা। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করায় এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাঁকে স্বাগত জানানোয় বিএনপি ও জামায়াত গোষ্ঠী ভীষণ বেজার। সংসদে না গিয়ে রাজপথে অহেতুক জনঝঞ্ঝাট ঘটিয়ে বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি গরম করার পুরনো পথ বেছে নিয়েছে তারা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাতের, কিন্তু এটা তো সত্য যে রাষ্ট্র ও জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবমাননাকর। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার বারবার এ ব্যাপারে বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে মতামত জানাতে বলেছেন। বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। দেবেও বলে মনে হচ্ছে না। তবে সংসদে গিয়ে মতামত তুলে ধরে যদি কাজের কাজ কিছুই না হতো তবুও লাভ হতো গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার। দেশে এবং বিদেশের মানুষ জানত বিরোধী দলের পরাজয়ে গ্লানির কিছু নেই। গণতন্ত্রচর্চায় কিছু কিছু পরাজয় সম্মানের। জয় বাংলা।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.