কলকাতার চিঠি-মমতার বোধোদয়? by অমর সাহা

বন্ধুপ্রতিম দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সেপ্টেম্বরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনে বাধা দিয়ে তিনি যে কাজটি ভালো করেননি, সেটি হয়তো এখন উপলব্ধি করতে পারছেন পশ্চিমবঙ্গের ‘জনতার’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর মমতার বাংলাদেশ সফর বাতিল করার ঘটনা বাংলাদেশে যে তাঁর


জনপ্রিয়তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেটি সম্ভবত উপলব্ধি করেই অবশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দেড় মাস পর ২২ অক্টোবর এই তিস্তা চুক্তি নিয়ে মৌনতা ভাঙেন। কথা বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে। সেখানেই তিনি জানিয়ে দেন, তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তবে তিস্তার পানির প্রবাহ সম্পর্কে তাঁর সরকারের গড়া বিশেষ কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তিনি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের জন্য উদ্যোগী হবেন।
২২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজধানী দিল্লিত গিয়েছিলেন জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে। সেদিন তিনি ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে। সেখানে কথা হয় তিস্তা চুক্তি, ছিটমহল সমস্যা আর তিনবিঘা করিডর নিয়ে। সেদিনই মমতা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনিও চান তিস্তা চুক্তি সম্পাদন হোক।
যদিও আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে, ‘তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি এবং তিনবিঘায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সফর ঘিরে যে “জটিলতা” তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনের জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন মমতা। মমতাও আর চাইছেন না এ নিয়ে “পানি ঘোলা” করতে। মমতা বলেছেন, পেছনে তাকাতে চান না তিনি।’ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোতভাবে সাহায্য করতে চান তিনি। এই বৈঠকেই মমতা প্রধানমন্ত্রীকে আরও আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আমরা সর্বদাই উৎসাহী। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। আমরা বরাবরই ঢাকার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছি। দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হোক, এটা আমিও চাই। তবে সমস্যা হলো, তিস্তা নদীতে পানির অভাব। আর এই লক্ষ্যেই নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে গড়া হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। সেই কমিটিই খতিয়ে দেখবে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে কতটুকু পানি থাকে। তারপর সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী মমতা জানাবেন তাঁর মতামত। তার পরেই চুক্তি। এসব কথাই বলেছেন মমতা প্রধানমন্ত্রীকে।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার কথায়, এই লক্ষ্যে আগামী মে মাসে মমতা যেতে পারেন ঢাকায়। প্রধানমন্ত্রীও চাইছেন এমনটাই। মমতাকে রেখেই ওই সময় চুক্তি সম্পাদনও হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সেরে মমতা যোগ দেন বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে। সেই বৈঠকের ফাঁকে সেদিনই কথা বলেন মমতা সাংবাদিকদের সঙ্গে। সেখানেই মমতা জানিয়ে দেন যে তিনিও চান বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিনই প্রথম তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে মুখ খোলেন। বলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কিছু মানুষ ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি করেছে। তবু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে। যদিও মমতা সেদিন গত ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনবিঘা পরিদর্শনের সময় তিনি কেন সেখানে যাননি—এই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ ব্যাপারে তাঁকে জানানো হয়নি। তা ছাড়া তিনবিঘার বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের। তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু বা তিনবিঘা করিডর সফর না করা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো মতভেদের প্রশ্ন নেই। তিনবিঘা করিডর নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের কোনো বিরোধ নেই।
প্রসঙ্গত, গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন হওয়ার কথা থাকলেও মমতা সেই চুক্তির বিরোধিতা করে ঢাকা সফর বাতিল করেন। এর ফলে ভারত সরকার সেই সময় তিস্তা চুক্তি সম্পাদন স্থগিত করেন।
হঠাৎ করে মমতা তিস্তা নিয়ে মৌনতা ভাঙলেন কেন, তা নিয়ে অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, মমতা জানেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সুদীর্ঘ দিনের। সাবেক বামফ্রন্টের সময়ও এই সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। এবার পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও। তারাও চাইছিল পশ্চিমবঙ্গে একটা পরিবর্তন আসুক। ক্ষমতায় আসুন মমতা। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর মমতার হঠাৎ করে তিস্তা ইস্যু নিয়ে বেঁকে বসার ঘটনা মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, প্রকাশ্যে মমতা এভাবে বেঁকে না বসে বরং এ বিষয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলে যদি সমাধানের পথ খুঁজে নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে এ অবস্থা তৈরি হতো না। বরং মমতা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও জননেত্রী হিসেবে বিবেচিত হতেন। এখন মমতা বিষয়টি বুঝতে পেরেই তিস্তা নিয়ে মৌনতা ভেঙেছেন। কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কথা দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে তাঁর আপত্তি নেই।
 অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.