একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট by সৌরভ সিকদার
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি বুকের রক্ত ঝরিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার পেয়েছিল। আর সেই পথ বেয়ে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতীক বাংলা একাডেমী। এর প্রায় ৫০ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাঙালির ভাষার জন্য ত্যাগ আর অহংকারের বিশ্বস্বীকৃতি মিলল ইউনেসকোর একুশে ফেব্রুয়ারিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষার বিশ্বজয়ের এই বিরল সম্মান, গৌরব ও আনন্দকে স্থায়ী এবং স্বপ্নময় রূপ দিতে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর পল্টনের এক উৎসব-সমাবেশে ঘোষণা দেন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ স্থাপনের। এই ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ‘মাতৃভাষা বাংলাকে সমুন্নত রাখা এবং বাংলাসহ পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমন্বয় সাধন করা’।
২০০১ সালের ১৫ মার্চ সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমীর পাশে ১.০৩ একর জায়গায় এ ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান। মূল ভবনের স্থাপত্য ও কাঠামোগত নকশাসংশ্লিষ্ট কার্যাদি সমাপ্ত করে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভাষার অহংকারদীপ্ত বাঙালির জন্য বাংলা ভাষা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার নতুন স্বপ্ন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই স্বপ্ন অল্পদিনেই মুছে যেতে শুরু করে। ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রকল্পের কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে নতুন উদ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে এবং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের উদ্যোগে সংশোধিত প্রকল্প প্রণয়ন করে মিলনায়তনসহ ভবনের তিনতলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন করা হয়। জাতীয় সংসদে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ বিল পাস, পরিচালনা বোর্ড গঠন এবং একজন মহাপরিচালকও নিয়োগ দান করা হয়। সমপ্রতি একনেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের জন্য ৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছে সরকার, যা দিয়ে ভবন নির্মাণ, গ্রন্থাগার স্থাপন, আর্কাইভ আধুনিকীকরণ, নৃভাষাতাত্ত্বিক জরিপসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এখন শুধু লোকবল নিয়োগ এবং কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায়।
যে সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ যাত্রা শুরু করেছিল, তা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়লেও এখন আবার পালে হাওয়া লাগছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের ভাষাবিষয়ক নানা তথ্যসমৃদ্ধ আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে (যদিও অসম্পূর্ণ)। উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিদর্শনের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। দুই বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে অনুষ্ঠান-সেমিনার হচ্ছে; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনও করছেন। এ বছর তিন দিনব্যাপী ভাষামেলা ও বাংলা ভাষাবিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। হচ্ছে না শুধু যে লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা, সেই ভাষা সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ভাষার উৎকর্ষসাধনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং একুশ শতকের উপযোগী একটি অত্যাধুনিক ওয়েবসাইট নির্মাণ। আশা করা যায়, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত লোকবল নিয়োগ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে নিয়ে আমাদের অনেক বড় স্বপ্ন থাকলেও হতাশারও একটি জায়গা রয়ে গেছে, আর তা হচ্ছে—এটি বাংলা একাডেমী বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠল না। গঠনতন্ত্র অনুসারে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে হয়তো আজীবন কখনো রাজনৈতিক কখনো বা আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের মেজাজ-মর্জির ওপরও এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।
বাংলা একাডেমী যেমন আমাদের অহংকার, তেমনি আমরা আমাদের ভাষার গৌরব ও অহংকারদীপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে দেখতে চাই, দেখতে চাই বিশ্বের ভাষা গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। আর তার জন্য সরকারের আন্তরিকতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ, উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ এবং সময়োপযোগী কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ।
বাঙালির আত্মত্যাগের গৌরবের ইতিহাস অমর একুুশে ফেব্রুয়ারি এখন প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে মহোৎসবে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী নানা দেশ-জাতি-ধর্ম-গোত্রের মানুষ এর মধ্য দিয়ে যেমন আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাকে স্মরণ করছে, তেমনি নিজের ভাষার উন্নতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে তাৎপর্য, তা সফল করতে হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে প্রকৃত পক্ষে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও ভাষাচর্চার কেন্দ্রতে রূপান্তরিত করতে হবে; যা শুধু আমাদের প্রতীকী মিনারই নয়, বিশ্ববাসীর ভাষা মননের প্রতীকও হয়ে উঠবে।
No comments