স্বপ্ন না দেখে মানুষ বাঁচতে পারে না -সাক্ষাৎকারে ড. আনিসুজ্জামান by শাকিলা হোসেন
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামানের জন্মদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৭ সালের এই দিনে ডা. এটিএম মোয়াজ্জেম হোসেন ও মা সৈয়দা খাতুনের প্রথম সন্তান আনিসুজ্জামান কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণায় সমৃদ্ধ করেছেন নিজের মননশীলতা, সমৃদ্ধ করেছেন বাঙালির চিন্তার ক্ষেত্রও। শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে অবদানের জন্য একুশে পদকসহ বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হয়েছেন তিনি...
সমকাল :স্যার, আপনার শৈশবের দিনগুলো কি জন্মদিনে মনে পড়ে?
ড. আনিসুজ্জামান :পাছে দুর্ঘটনার শিকার হই, সেই ভয়ে আমার অভিভাবকরা আমার চলাফেরা-খেলাধুলার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। সেই ক্ষতি খানিকটা পুষিয়ে নিয়েছিলাম কিশোর সাহিত্য পড়ে। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে একটা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলাম। মুকুল ফৌজে যোগ দিয়েছিলাম কামরুল হাসানের অধীনে। নানা কারণে অনেক সাহিত্যিকের সংস্পর্শে এসেছিলাম। তার মধ্যে আহসান হাবীবের সাহচর্য আমাকে সাহিত্যমনস্ক হতে সাহায্য করে। ১৯৪৬ সালে রশীদ আলী দিবসে স্কুল থেকে ধর্মঘট করে মিছিলে যোগ দিয়ে জনসভায় আসি। সেই প্রথম রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করি। সে বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে খুব মর্মাহত হই। ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম সাধারণ।
সমকাল :কোন বয়সে প্রথম উপন্যাস পড়লেন? প্রিয় লেখক এবং প্রিয় বইয়ের কথা বলুন।
আনিসুজ্জামান :বড়দের কথাবার্তা শুনে মনে একটা সংস্কার জন্মেছিল যে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে নাটক-নভেল পড়া উচিত নয়। তাই মনে একটা বাধা অনুভব করেছি অন্তত ক্লাস এইটে পড়া পর্যন্ত। তবে আমার ঠিক ওপরে যে বোন, সে ছিল পাড়ার লাইব্রেরির সদস্য। লাইব্রেরি থেকে তাকে বই এনে দিতে হতো। সেই সুবাদে রহস্য-উপন্যাস অনেক পড়েছিলাম :প্রহেলিকা সিরিজ, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ, মোহন সিরিজ এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়ের কাহিনী। এসব আমার আট থেকে দশ বছরের মধ্যকার কথা। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই উপন্যাস পড়তে থাকি। ম্যাট্রিক পাস করার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্যাস পড়ে ফেলি।
সমকাল :শৈশবে সিনেমা দেখার বাধা ছিল? কোন ছবি প্রথম দেখলেন মনে আছে?
আনিসুজ্জামান :আমার আব্বা সপরিবারে সিনেমা ও থিয়েটার দেখতে যেতেন। আমিও যেতাম। 'বাফেলো বিল' নামে একটা ছবি দেখে ভয়ে আমি মূর্ছিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে বাংলা-হিন্দি ছবি উপভোগ করেছি।
সমকাল :সংস্কৃতি চর্চা এবং সঙ্গীদের কথা বলুন।
আনিসুজ্জামান :স্কুলজীবনের শেষদিকে আমার পাড়া থেকে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করি 'মুকুর' নামে। প্রথমে কাজী নূরুল ইসলাম ও আমি, পরে আব্দার রশীদ ও আমি ছিলাম তার সম্পাদক, গাজী শাহাবুদ্দিন তার প্রকাশক। তাতে খ্যাত-অখ্যাত অনেকে লিখেছেন, আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীর চিত্রাঙ্কন করেছেন। আমরা সবাই তখন নানা পর্যায়ের ছাত্র ছিলাম। কলেজ জীবনে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা একটা বড় ঘটনা। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে সাহিত্যচর্চার একটা অনুকূল আবহাওয়া পেয়েছিলাম।
সমকাল :বাংলা সাহিত্য পড়ার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন কেন?
আনিসুজ্জামান :বাংলা সিনেমা দেখে মনে সংকল্প জাগে, বড় হয়ে আইনজীবী হবো। তবে যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখনই সাহিত্যের দিকে আকর্ষণ জাগে। ম্যাট্রিক পাস করার আগেই তাই ঠিক করেছিলাম, বাংলা সাহিত্য পড়ব।
সমকাল :আপনার ছাত্রজীবন আর একালের ছাত্রদের পার্থক্য কী রকম?
আনিসুজ্জামান :ছাত্রজীবনে পড়াশোনা, সাহিত্যচর্চা এবং রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলাম। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজ করেছি। কলেজ থেকেই আমি বামপন্থার দিকে ঝুঁকি। আমরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করিনি। বরং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নীতিগত প্রশ্নে অনেক দাবি করেছি। চাঁদাবাজি কিংবা সন্ত্রাস অভাবনীয় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে চলেছি। এখন ছাত্র রাজনীতি অনেক দূষিত হয়েছে, সাধারণভাবে শৃঙ্খলাবোধ কমে গেছে এবং পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সমকাল :আমাদের শিক্ষার সঙ্গে কর্মের যোগ খুব কম। আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
আনিসুজ্জামান :এ তো খুব বড় প্রশ্ন, অল্প কথায় তার জবাব দেওয়া যাবে না। স্বীকার করতেই হবে যে, শিক্ষাজীবনের সঙ্গে কর্মজীবনের যোগ আমাদের নেই। তবে সে ক্ষেত্রে আমরা একাও নই। শিক্ষার লক্ষ্য সুনাগরিক সৃষ্টি করা এবং কোনো না কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা দান করা। এই কাজ আমরা ভালোমতো করতে পারছি না। নতুন যে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে, তাতে হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যাবে।
সমকাল :জীবনে কী আপনাকে তৃপ্তি দিয়েছে?
আনিসুজ্জামান :শিক্ষকতায় আমি আনন্দ পেয়েছি। জীবন আমাকে অনেক দিয়েছে এবং তাতে আমি তৃপ্ত।
সমকাল :জীবনের স্মরণীয় ঘটনা অনেক। কোনগুলো মনে দাগ কেটে আছে এখনও?
আনিসুজ্জামান :উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আমার সৌভাগ্য, এর সবটিতে আমি জড়িত হয়েছিলাম।
সমকাল :একাত্তরে দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা বলুন।
আনিসুজ্জামান : দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা খুবই বেদনাদায়ক। শরণার্থী জীবনও কেটেছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। তবে স্বাধীনতা লাভের আনন্দ সব বেদনা মুছিয়ে দিয়েছে। ভারতে আমরা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গড়ে তুলি। উত্তর ভারতের বেশ ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তৃতা দিই এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পরে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
সমকাল :বিভেদের রাজনীতি থেকে মুক্তির পথ কী?
আনিসুজ্জামান :বিভেদ অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করে রাখা। এখনও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেশের অনেক মানুষ যুক্ত নয়। তার সুফলও তারা পায় না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও দুর্বল। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বিকশিত হওয়া খুবই দরকার। অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। জাতীয় ঐক্যেই আমাদের মুক্তি।
সমকাল :আপনার অতৃপ্তি বা দুঃখ কী?
আনিসুজ্জামান :সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে শরিক হতে চেয়েছিলাম_ পারিনি। তবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা আমাদের খুব একটা বড় পাওয়া। ব্যক্তিগত জীবনে আমার অপূর্ণতাবোধ নেই। যা পেয়েছি তার তুলনা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি এখনও ঘটল না। এ দুঃখবোধ রয়ে গেল।
সমকাল :আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু জুড়ে?
আনিসুজ্জামান :অনেকের মতো আমার জীবনেরও অনেকটা জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করছি গত ৬০ বছর ধরে। এ চেষ্টার শেষ নেই। তাঁর কাছ থেকে সদর্থক এত কিছু পেয়েছি, তার জন্য আমি ঋণী তাঁর কাছে।
সমকাল :ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন এখনও? কী সেই স্বপ্ন?
আনিসুজ্জামান :স্বপ্ন না দেখে মানুষ বাঁচতে পারে না। সেসব স্বপ্নের অধিকাংশই পূরণ হয় না। তা দেশকে নিয়ে হোক, ব্যক্তিকে নিয়ে হোক। তারপরও সে স্বপ্ন দেখে। এটাই জীবনের ধর্ম।
সমকাল :জন্মদিনে কি আনন্দের উপলব্ধির বাইরে অন্য কোনো বোধ আপনাকে স্পর্শ করে?
আনিসুজ্জামান :ভাবি, আমি কোথা থেকে এলাম এবং কোথায় যাচ্ছি! এ ভাবনা আদিকাল থেকেই মানুষ করে আসছে। এ বিষয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমি জানি, মৃত্যু অনিবার্য। যখন তা ঘটবে, তখন ঘটবে। জন্মদিন আনন্দের, কিন্তু দীর্ঘ নয় তা। মৃত্যু নিয়েও আমি ভাবি না।
সমকাল :স্যার, আপনার শৈশবের দিনগুলো কি জন্মদিনে মনে পড়ে?
ড. আনিসুজ্জামান :পাছে দুর্ঘটনার শিকার হই, সেই ভয়ে আমার অভিভাবকরা আমার চলাফেরা-খেলাধুলার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। সেই ক্ষতি খানিকটা পুষিয়ে নিয়েছিলাম কিশোর সাহিত্য পড়ে। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে একটা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলাম। মুকুল ফৌজে যোগ দিয়েছিলাম কামরুল হাসানের অধীনে। নানা কারণে অনেক সাহিত্যিকের সংস্পর্শে এসেছিলাম। তার মধ্যে আহসান হাবীবের সাহচর্য আমাকে সাহিত্যমনস্ক হতে সাহায্য করে। ১৯৪৬ সালে রশীদ আলী দিবসে স্কুল থেকে ধর্মঘট করে মিছিলে যোগ দিয়ে জনসভায় আসি। সেই প্রথম রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করি। সে বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে খুব মর্মাহত হই। ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম সাধারণ।
সমকাল :কোন বয়সে প্রথম উপন্যাস পড়লেন? প্রিয় লেখক এবং প্রিয় বইয়ের কথা বলুন।
আনিসুজ্জামান :বড়দের কথাবার্তা শুনে মনে একটা সংস্কার জন্মেছিল যে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে নাটক-নভেল পড়া উচিত নয়। তাই মনে একটা বাধা অনুভব করেছি অন্তত ক্লাস এইটে পড়া পর্যন্ত। তবে আমার ঠিক ওপরে যে বোন, সে ছিল পাড়ার লাইব্রেরির সদস্য। লাইব্রেরি থেকে তাকে বই এনে দিতে হতো। সেই সুবাদে রহস্য-উপন্যাস অনেক পড়েছিলাম :প্রহেলিকা সিরিজ, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ, মোহন সিরিজ এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়ের কাহিনী। এসব আমার আট থেকে দশ বছরের মধ্যকার কথা। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই উপন্যাস পড়তে থাকি। ম্যাট্রিক পাস করার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্যাস পড়ে ফেলি।
সমকাল :শৈশবে সিনেমা দেখার বাধা ছিল? কোন ছবি প্রথম দেখলেন মনে আছে?
আনিসুজ্জামান :আমার আব্বা সপরিবারে সিনেমা ও থিয়েটার দেখতে যেতেন। আমিও যেতাম। 'বাফেলো বিল' নামে একটা ছবি দেখে ভয়ে আমি মূর্ছিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে বাংলা-হিন্দি ছবি উপভোগ করেছি।
সমকাল :সংস্কৃতি চর্চা এবং সঙ্গীদের কথা বলুন।
আনিসুজ্জামান :স্কুলজীবনের শেষদিকে আমার পাড়া থেকে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বের করি 'মুকুর' নামে। প্রথমে কাজী নূরুল ইসলাম ও আমি, পরে আব্দার রশীদ ও আমি ছিলাম তার সম্পাদক, গাজী শাহাবুদ্দিন তার প্রকাশক। তাতে খ্যাত-অখ্যাত অনেকে লিখেছেন, আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীর চিত্রাঙ্কন করেছেন। আমরা সবাই তখন নানা পর্যায়ের ছাত্র ছিলাম। কলেজ জীবনে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা একটা বড় ঘটনা। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে সাহিত্যচর্চার একটা অনুকূল আবহাওয়া পেয়েছিলাম।
সমকাল :বাংলা সাহিত্য পড়ার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন কেন?
আনিসুজ্জামান :বাংলা সিনেমা দেখে মনে সংকল্প জাগে, বড় হয়ে আইনজীবী হবো। তবে যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখনই সাহিত্যের দিকে আকর্ষণ জাগে। ম্যাট্রিক পাস করার আগেই তাই ঠিক করেছিলাম, বাংলা সাহিত্য পড়ব।
সমকাল :আপনার ছাত্রজীবন আর একালের ছাত্রদের পার্থক্য কী রকম?
আনিসুজ্জামান :ছাত্রজীবনে পড়াশোনা, সাহিত্যচর্চা এবং রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলাম। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজ করেছি। কলেজ থেকেই আমি বামপন্থার দিকে ঝুঁকি। আমরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করিনি। বরং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নীতিগত প্রশ্নে অনেক দাবি করেছি। চাঁদাবাজি কিংবা সন্ত্রাস অভাবনীয় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে চলেছি। এখন ছাত্র রাজনীতি অনেক দূষিত হয়েছে, সাধারণভাবে শৃঙ্খলাবোধ কমে গেছে এবং পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সমকাল :আমাদের শিক্ষার সঙ্গে কর্মের যোগ খুব কম। আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
আনিসুজ্জামান :এ তো খুব বড় প্রশ্ন, অল্প কথায় তার জবাব দেওয়া যাবে না। স্বীকার করতেই হবে যে, শিক্ষাজীবনের সঙ্গে কর্মজীবনের যোগ আমাদের নেই। তবে সে ক্ষেত্রে আমরা একাও নই। শিক্ষার লক্ষ্য সুনাগরিক সৃষ্টি করা এবং কোনো না কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা দান করা। এই কাজ আমরা ভালোমতো করতে পারছি না। নতুন যে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে, তাতে হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যাবে।
সমকাল :জীবনে কী আপনাকে তৃপ্তি দিয়েছে?
আনিসুজ্জামান :শিক্ষকতায় আমি আনন্দ পেয়েছি। জীবন আমাকে অনেক দিয়েছে এবং তাতে আমি তৃপ্ত।
সমকাল :জীবনের স্মরণীয় ঘটনা অনেক। কোনগুলো মনে দাগ কেটে আছে এখনও?
আনিসুজ্জামান :উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আমার সৌভাগ্য, এর সবটিতে আমি জড়িত হয়েছিলাম।
সমকাল :একাত্তরে দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা বলুন।
আনিসুজ্জামান : দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা খুবই বেদনাদায়ক। শরণার্থী জীবনও কেটেছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। তবে স্বাধীনতা লাভের আনন্দ সব বেদনা মুছিয়ে দিয়েছে। ভারতে আমরা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গড়ে তুলি। উত্তর ভারতের বেশ ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তৃতা দিই এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পরে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
সমকাল :বিভেদের রাজনীতি থেকে মুক্তির পথ কী?
আনিসুজ্জামান :বিভেদ অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করে রাখা। এখনও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেশের অনেক মানুষ যুক্ত নয়। তার সুফলও তারা পায় না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও দুর্বল। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বিকশিত হওয়া খুবই দরকার। অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। জাতীয় ঐক্যেই আমাদের মুক্তি।
সমকাল :আপনার অতৃপ্তি বা দুঃখ কী?
আনিসুজ্জামান :সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে শরিক হতে চেয়েছিলাম_ পারিনি। তবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা আমাদের খুব একটা বড় পাওয়া। ব্যক্তিগত জীবনে আমার অপূর্ণতাবোধ নেই। যা পেয়েছি তার তুলনা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুক্তি এখনও ঘটল না। এ দুঃখবোধ রয়ে গেল।
সমকাল :আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু জুড়ে?
আনিসুজ্জামান :অনেকের মতো আমার জীবনেরও অনেকটা জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করছি গত ৬০ বছর ধরে। এ চেষ্টার শেষ নেই। তাঁর কাছ থেকে সদর্থক এত কিছু পেয়েছি, তার জন্য আমি ঋণী তাঁর কাছে।
সমকাল :ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন এখনও? কী সেই স্বপ্ন?
আনিসুজ্জামান :স্বপ্ন না দেখে মানুষ বাঁচতে পারে না। সেসব স্বপ্নের অধিকাংশই পূরণ হয় না। তা দেশকে নিয়ে হোক, ব্যক্তিকে নিয়ে হোক। তারপরও সে স্বপ্ন দেখে। এটাই জীবনের ধর্ম।
সমকাল :জন্মদিনে কি আনন্দের উপলব্ধির বাইরে অন্য কোনো বোধ আপনাকে স্পর্শ করে?
আনিসুজ্জামান :ভাবি, আমি কোথা থেকে এলাম এবং কোথায় যাচ্ছি! এ ভাবনা আদিকাল থেকেই মানুষ করে আসছে। এ বিষয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমি জানি, মৃত্যু অনিবার্য। যখন তা ঘটবে, তখন ঘটবে। জন্মদিন আনন্দের, কিন্তু দীর্ঘ নয় তা। মৃত্যু নিয়েও আমি ভাবি না।
No comments