সমুদ্রসীমা-বাংলাদেশ-মিয়ানমার নিজেরা নিষ্পত্তি করতে পারে না? by ইমতিয়াজ আহমেদ

আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে ফয়সালা হওয়া মোটেই সহজ নয়। এ কারণে উভয় দেশ নিজ নিজ অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে। এর রায় যা-ই হোক না কেন, একটি বিষয় নিশ্চিত যে, অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে নয়, বরং বাইরের কারণেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হচ্ছে।


এর পরিবর্তে দুটি দেশ কি সমুদ্র সম্পদ যৌথভাবে অনুসন্ধানে অগ্রসর হতে পারে না? মিয়ানমার বাংলাদেশের মানুষের কাছে বার্মা নামেই পরিচিত ছিল। চাকরি ও ব্যবসা সূত্রে অনেক বাঙালি সেখানে বিভিন্ন সময়ে গেছে। তবে গত কয়েক দশক ধরে প্রতিবেশী এ দেশটি যেন একেবারেই অচেনা হয়ে উঠছে। তাদের নিয়ে আলোচনা চলে প্রধানত দুটি ইস্যুর কারণে_ রোহিঙ্গা সমস্যা এবং ইয়াবাসহ বিভিন্ন নামের মাদকদ্রব্যের ব্যবসা। আরেকটি সমস্যাও রয়েছে তাদের সঙ্গে_ সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ। এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্সএশীয় রেলপথ দুটি দেশকে যুক্ত করতে পারে_ এমন সম্ভাবনা অনেক বছর ধরেই আলোচিত। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগস্থলও হয়ে উঠতে পারে বহু বছর ধরে সামরিক শাসনের অধীনে থাকা দেশটি। কিন্তু তারপরও বলা যায়, কাছের দেশটি যেন অনেক দূরের।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের বিষয়টি আলোচনায় আসে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রশ্নে বিরোধ দেখা দিলে। 'বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক :নিরাপত্তা প্রেক্ষিত' শীর্ষক নিবন্ধে ওবায়দুল হক পাটোয়ারি লিখেছেন :'অনিষ্পন্ন সমুদ্রসীমা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। উভয় সরকারই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। প্রচুর তেল ও গ্যাস সম্পদ মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, এমন সমুদ্র এলাকার ওপর দুটি দেশই নিজের দাবি জানাচ্ছে। নভেম্বর ২০০৮-এ মিয়ানমারের নৌবাহিনীর প্রহরায় চারটি কোরীয় জাহাজ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের জলসীমায় তেল অনুসন্ধান শুরু করলে বিষয়টি সামনে আসে। যদিও বাংলাদেশের জোরালো প্রতিবাদের মুখে মিয়ানমার এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, কিন্তু তারা ফিরে আসবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান 'বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক :অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত' নিবন্ধে লিখেছেন :'মিয়ানমারে প্রচুর গ্যাস সম্পদ রয়েছে। তারা চীন ও কোরিয়ার কোম্পানিগুলোর সহায়তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।'
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। এশিয়া পলিসির জুলাই ২০১০ সংখ্যায় জারেড বিসিংগার লিখেছেন :'যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি দেশটির দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস সংকটের সমাধান করতে পারে। উৎপাদন বণ্টন চুক্তি এবং সহায়ক চুক্তি কনোকো ফিলিপসকে চট্টগ্রামের ২৮০ কিলোমিটার দূরত্বের দুটি গভীর সমুদ্র ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম বেসরকারি খাতের এই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি ১১ কোটি ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে, যা বাংলাদেশে তাদের প্রথম।'
এ ধরনের প্রতিবেদনে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ থেকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কীভাবে লাভবান হবে, সে বিষয়ে ধারণা মেলে। কিন্তু ব্যয়বহুল ও কারিগরি ক্ষমতা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে আসা আন্তর্জাতিক কোম্পানি সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। দুটি প্রতিবেশী দেশ বিরোধে জড়িয়ে পড়ল, কিন্তু তাদের মাঝে যে রাষ্ট্র-উত্তর উপাদান_ তারা কেন আড়ালে? একই সঙ্গে এ প্রশ্নও করা যায়_ দুটি দেশ কেন এমন পক্ষের জন্য স্থান ছেড়ে দিচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকছে না?
জারেড বিসিংগার এ ক্ষেত্রে তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন। প্রথমত, অফসোরে খনন কাজ চালানোর মতো প্রযুক্তি এখন আয়ত্তে এসেছে। এর সাহায্যে কঠিন কিন্তু বিতর্কিত এলাকায় অনুসন্ধান ও খনন কাজ চালানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশেই জ্বালানির চাহিদা অপরিমেয়। তৃতীয়ত, চীন ও ভারতসহ বিশ্বের এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে দ্রুত। যে কারণে বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সাগরের সীমানা চিহ্নিত না হওয়ায় গুরুতর সমস্যা রয়ে গেছে। দুটি দেশ প্রথমবারের মতো ১৯৭৪ সালে এ সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেছিল এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তারা আলোচনা চালিয়ে যায়। কিন্তু তারপর আলোচনা আর এগোয়নি। দুই দশকের বেশি সময় পর ২০০৭ সালে তারা আবার আলোচনায় বসে, কিন্তু কোনো কার্যকর ফল ছাড়াই তা শেষ হয়। সীমানা চিহ্নিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ সমতার নীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু মিয়ানমার সমদূরত্বের নীতি আঁকড়ে ধরে থাকে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশনে ইকুইটি ও ইকুইটেবল শব্দ কয়েকবার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ইকুইডিস্ট্যান্স বা ইকুয়াল ডিস্ট্যান্স একবারও উল্লেখ নেই। তারপরও মিয়ানমার কেন বিষয়টি উল্লেখ করছে এবং তাদের দাবি ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে পেশ করেছে? অথচ এর এক বছর আগেই তারা কন্টিনেন্টাল শেলফ লিমিট সংক্রান্ত কমিশনে এ দাবি পেশ করেছিল। এর তিনটি কারণ উল্লেখ করা যায়। একটি কারণ হতে পারে ভারতের অবস্থান। তাদেরও বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে এবং এ কারণে তারা সমতার পরিবর্তে সমদূরত্বের নীতির বিষয়টি তুলে ধরার জন্য তাদের উৎসাহিত করতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, এ কারণে তারা ভারতের অবস্থানের সঙ্গে মানিয়ে চলার নীতি অনুসরণে ইচ্ছুক হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতও মিয়ানমারের কন্টিনেন্টাল শেলফ দাবির বিরোধিতা করেছে। কারণ এ দাবি তার নিজের অবস্থানের জন্য ক্ষতিকর। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা। আন্তর্জাতিক আদালতে হেরে গেলে স্বদেশের জনগণের সমালোচনা থেকে নিষ্কৃতি মিলবে। তৃতীয়ত, যদি মুখ রক্ষার মতো কোনো রায় মেলে, সে জন্য ভরসায় থাকা। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রসঙ্গে বলা যায়_ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ফয়সালা করতে না পরায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার বিকল্প ছিল না।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশেরই জ্বালানি সমস্যা প্রকট। তারা দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি কেন করতে পারল না? এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব খুরশিদ আলম বলেন, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে একটি সমাধান সূত্র পাওয়া গিয়েছিল। উভয় পক্ষ সমতা ও সমদূরত্বের নীতির সমন্বয়ে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য আরও একটি তাগিদও ছিল_ রোহিঙ্গা ইস্যু। কিন্তু বিস্ময়করভাবে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর কিছু শোনা যায়নি। এমনকি গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময়েও প্রসঙ্গটি ওঠেনি। শোনা যায়, বিরোধী নেত্রী অং সাং সু চির সঙ্গে দেখা করার জন্য তার অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা তাদের সফরকালে এ সুযোগ পেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে ফয়সালা হওয়া মোটেই সহজ নয়। এ কারণে উভয় দেশ নিজ নিজ অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছে। এর রায় যা-ই হোক না কেন, একটি বিষয় নিশ্চিত যে, অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে নয়, বরং বাইরের কারণেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হচ্ছে।
এর পরিবর্তে দুটি দেশ কি সমুদ্রসম্পদ যৌথভাবে অনুসন্ধানে অগ্রসর হতে পারে না? বঙ্গোপসাগরের তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা তারা কাজে লাগাতে পারে। তারা পরস্পর হাত মেলালে আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাদের দরকষাকষির সুযোগ অনেক বাড়িয়ে দেবে। সমুদ্রসম্পদ আহরণে দুটি দেশের প্রযুক্তিগত সামর্থ্যে সীমাবদ্ধতা আমাদের জানা। তারা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে একাডেমী অব ওসেনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যার ক্যাম্পাস থাকবে উভয় দেশে। এ ধরনের উদ্যোগের আগেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের তরুণ পেশাজীবীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ফেলোশিপ প্রদান করতে পারে। এটা একতরফাভাবেই করা যায়। তারা বাংলাদেশে এসে এখানের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হবে এবং দেশে গিয়ে তা অন্যদের অবগত করবে।
অর্থনীতির বিশ্বায়নকেও উভয়ের কল্যাণে কাজে লাগাতে তারা সচেষ্ট হতে পারে। ভারতের মন্ত্রী জয়রাম রমেশ 'চিন্ডিয়া' শব্দটি ব্যবহার করেন_ চীন ও ভারত প্রসঙ্গেই এর প্রয়োগ হয়। এ দুটি দেশে রয়েছে ২৫০ কোটির বেশি মানুষ, যা গোটা বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগের বেশি। তারা হাত মেলালে বিশ্বজুড়ে নিজেদের জন্য একটি পার্থক্য গড়ে তুলতে পারে। এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায় যে, অষ্টাদশ শতকে চীন এবং অখণ্ড ভারত ছিল বিশ্বের এক ও দুই নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। এখন বলা হচ্ছে তাদের উত্থানের কথা। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে পুনরুত্থান। চীন, ভারত, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ পরস্পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে তাতে সবারই কল্যাণ। চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এবং 'চিন্ডিয়া'র বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বলা যায়, যৌথ প্রচেষ্টা সবার জন্য সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে। এর প্রভাবে গোটা এলাকার আর্থ-সামাজিক চিত্রও বিপুলভাবে বদলে দেওয়া সম্ভব। এ লক্ষ্য সামনে রেখে চীন ও মিয়ানমারকে সার্কের পূর্ণ সদস্যপদ প্রদানে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমানে এ দুটি দেশ এবং জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, মরিশাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৫টি দেশের দক্ষিণ এশিয়ার এ জোটে রয়েছে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা। প্রত্যেক দেশই চাইবে প্রতিবেশী কিংবা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বিরোধের ইস্যু নিজের অনুকূলে নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকা কি ঠিক? তারা পরস্পর সহযোগিতা করতে পারে এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারও তা বেছে নিতে পারে।

ইমতিয়াজ আহমেদ :অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.