জনজীবন-সমস্যার সাতকাহন by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
আমার এক সজ্জন সমালোচক জুতসই সময়ে আমাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘যারা পারে না, তারা শেখায়।’ সাত জনমের ভাগ্যে শিক্ষক হয়েছিলাম। অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে কাজ করলে যারপরনাই ব্যর্থ হতাম, সে বিষয়ে আমার আস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেদিকে তাকাই সমস্যার অন্ত নেই।
নিশ্চয়ই অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে, যা ছিদ্রান্বেষীদের চোখে ধরা পড়ছে না। তবে সমস্যা সমাধান করতে না পারলেও তা ধরিয়ে দেওয়া কিন্তু একটি কাজ। তাই এই সহজ কাজই করি।
১. পনেরো কোটি মানুষের দেশে বাংলাদেশ বিমানকে আমরা এখনো ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারছি না। অথচ অর্ধেকের কম জনসংখ্যা নিয়ে থাইল্যান্ডের সিল্কের মতো মসৃণ থাই এয়ারওয়েজ ছাড়াও ব্যাংকক এয়ারওয়েজসহ অন্যান্য এয়ারওয়েজের যাত্রী হচ্ছি আমরা। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা হয়তো বা ৪০ গুণ কম, কিন্তু তাদের এয়ারওয়েজ নিশ্চয়ই কমপক্ষে ৪০ গুণ বড়। এমিরেটসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ একটি বাক্য সত্য। বিদেশি যাত্রীর কোনো প্রয়োজন নেই, শুধু দেশি যাত্রীদের সেবা দিতে পারলেই তো আমাদের বিমানের সমৃদ্ধি ঠেকায় কে? শুনেছিলাম, ভারতে রাষ্ট্রীয় কাজে ভ্রমণের জন্য জাতীয় পরিবহন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক ছিল। এ দেশে অনুরূপ নিয়ম প্রচলন করলে কি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুণ্ন হবে?
২. উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারতের রেলব্যবস্থার কোনো তুলনা নেই। স্বল্প ভাড়ায় বড় বড় দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য এমন ব্যবস্থার জুড়ি মেলা ভার। একই রকম জনবহুল দেশ হয়েও আমাদের রেলব্যবস্থা একটি লোকসানি খাত। যে দেশের এক-দশমাংশ মানুষের বাসস্থান রাজধানী যানজটে স্থবির, সেখানে রেলের মতো নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থা কেন অবহেলিত থাকবে, তা বোধগম্য নয়। চার যুগ আগে রোম শহরে গিয়ে শুনেছিলাম, রেলস্টেশন থেকে নাকি মিনিটে মিনিটে ট্রেন ছাড়ে। বড় বড় বিমানবন্দরে বিমানের ওঠানামার হার অনেকটা একই রকম। জনবহুল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম থেকে দিনে ১০-১৫টি না হয়ে ১০০টি ট্রেন তো ছাড়তে পারত। একইভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনে পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেন চললে তো যানজটও কিছুটা কমত। রাজধানীর যানজটের সমাধানে শুধু সড়কপথের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, নানা ধরনের যানবাহনের সমন্বিত ব্যবহারে তার সমাধান খুঁজতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে প্রাকৃতিকভাবে ঢাকা নদীবেষ্টিত হওয়ায় সে সুযোগও আমাদের আছে, কিন্তু ব্যবহারের আগ্রহের অভাব। রাজধানীর চারদিকে পানিপথ শুধু যাত্রী পরিবহনেই নয়, শহরের সৌন্দর্যবর্ধনেও ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. যানজট-সমস্যাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বহুমুখী আক্রমণ করতে হবে। স্কুল-কলেজে ছাত্রদের আনা-নেওয়াও যানজট-সমস্যাকে প্রকট করে। তাই স্কুল-কলেজে ভর্তি অবশ্যই ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী হওয়া উচিত। এতে যানজটও যেমন হ্রাস পাবে, ঠিক তেমনি জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে। শুধু আমেরিকা, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতেই নয়, এমনকি ভারতেও স্কুল-কলেজে ভর্তিতে বাসস্থানের নৈকট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর ফলে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার যে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তা বলা যাবে না। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী স্কুল-কলেজে ভর্তি হলে মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভিকারুননিসা আর নটর ডেম কলেজে সীমাবদ্ধ না হয়ে সারা দেশেই বিস্তৃত হবে।
৪. পাবলিক পরীক্ষা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় এলেই আমরা কোচিং সেন্টারগুলোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে থাকি, যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো কোচিং সেন্টার। অথচ বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে সফল প্রতিযোগীদের কম করে হলেও ৯৯ শতাংশ ছাত্র কোচিং সেন্টারে প্রস্তুতি নেয়। শুধু তা-ই নয়, কোচিং সেন্টারের কোনো শিক্ষকই বোর্ড কিংবা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করেন না। আমি অনেক শিক্ষার্থীকেই বলতে শুনেছি, কলেজে দেড় বছরে যা শিখেছে, কোচিং সেন্টারে তিন মাসে তার কয়েক গুণ বেশি শিখেছে। সুতরাং, ভাবতে হবে অগ্রাধিকারযোগ্য কাজ কোনটি। কোচিং সেন্টার বন্ধ করা, না আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষাদানের মানোন্নয়ন করা। এ ছাড়া যথাযোগ্য প্রশ্ন করে প্রমাণ করতে হবে যে কোচিং সেন্টারে গিয়ে কোনো লাভ নেই। ১০ লাখ ছাত্রকে যে প্রশ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে, তা দু-চার হাজার টাকা ও দু-তিনজন শিক্ষকের চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যবহার করে করাটা রীতিমতো অন্যায়। এই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য সারা বছর রীতিমতো গবেষণা করা উচিত, যেমনটি করা হয় টোয়েফল, স্যাট কিংবা জিআরই পরীক্ষার জন্য, যার মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর নানা বর্ণ-গোত্র-ধর্ম-বিশ্বাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের বাছাই করতে অসুবিধা হয় না।
৫. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব থাকলেও সাধারণ মানুষ আইন পালন করে থাকে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটালে অন্তত সাধারণ মানুষ যে পালন করে, তার উদাহরণ হলো সারা দিনের অফিস শেষে ঘরমুখী মানুষের বাসের মাত্রাতিরিক্ত বড় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, যদিও অপেক্ষাকৃত ধনবান মানুষেরা লাইনে দাঁড়িয়ে সিএনজি নিতে তত আগ্রহী নয়। একইভাবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজপতিদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দৃশ্যমান নয়। ফেরি রুটিন অনুযায়ী না চলে নেতার গাড়ির আগমনের পর যদি ছাড়ে, সাংসদেরা সংসদ বর্জন করলেও সুযোগ-সুবিধা যদি শতভাগ নিশ্চিত করতে সদা তৎপর থাকেন, নানা রকম বিল পরিশোধে যদি গড়িমসি করেন, আইনের প্রয়োগ যদি হয় ব্যক্তি দেখে, নেতাদের আইনসম্মত কিংবা বেআইনিভাবে সুবিধা ভোগের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে যদি আগামী দিনের নেতা কিংবা আজকের পাতিনেতারা সাধারণ মানুষের জীবন যদি দুর্বিষহ করেন, সাধারণ মানুষের মঙ্গলের পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোয় যদি নেতারা ব্যস্ত থাকেন, বড় মাপের অপকর্ম করেও যদি সমাজের রাঘববোয়ালেরা ধরা না পড়েন, তাহলে আইনের শাসন বলে শত চিৎকার করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হবে না। মানুষ বিশ্বাস করবে, আইন শুধু দুর্বলকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আর দুর্জন ও শক্তিশালীদের বলিষ্ঠ করার জন্য। আইনকানুন নেতাদের যত দিন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ থেকে মুক্ত রাখবে, তত দিন সেই আইনের প্রতিও যেমন সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হবে না, ঠিক তেমনই নেতাদের প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা তৈরি হবে না। নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সাধারণ মানুষকে দেশ গড়তে উৎসাহিত করা। এ কাজ করার জন্য প্রয়োজন ত্যাগ আর দুর্ভোগ পোহানোর ধৈর্য ও ভোগ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা।
৬. ফুটপাতের সামান্য আয়ে সংসার চালানো ফেরিওয়ালাদের ওপর চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ও সরকারি সম্পত্তি জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিতে অপারগতার কারণে আইন যে ক্ষমতার শাসন, সন্ত্রাসের শাসনকেই নিশ্চিত করে, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করবে। অগণিত ক্ষুদ্র মানুষের ছোট ছোট অন্যায়কে শাস্তি দিয়ে নয়, সমাজের গডফাদারদের উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী তৎপরতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।
৭. শত শত নতুন স্কুল স্থাপন নিঃসন্দেহে শিক্ষার সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু বর্তমান স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থার উন্নয়নেও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। স্কুলগুলোয় ভৌত অবকাঠামোর অভাব, লাইব্রেরিতে বইয়ের অভাব, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের অভাব, ছাত্রদের দক্ষতা অর্জনে উদ্যোগের অভাব, সর্বোপরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে একমাত্র উদ্বৃত্ত মানবসম্পদের যথাযথ উন্নয়নের অভাব দেশের উন্নয়নকে নিশ্চিতভাবে ব্যাহত করবে। শুধু ফিনল্যান্ড, সুইডেনের মতো উন্নত দেশ নয়, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তানের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলো জিডিপির ছয়-সাত শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও বিশ্বসভায় শিক্ষার মান দিয়ে সমীহ আদায় করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থা সম্মানজনক নয়।
জানি সমাজের ভুলত্রুটি তুলে ধরা সহজ, কিন্তু তা সমাধান করা মোটেই সহজ নয়। তবে এ-ও জানি, যাঁরা দেশ শাসনের এই গুরুদায়িত্ব হাতে নিয়েছেন, তাঁরা এই কঠিন কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং তাঁরা নিশ্চয়ই এই কঠিন কাজ করার যোগ্যতাও রাখেন।
আমাদের নেতারা সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করে একটি শ্রেয়তর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন, তার জন্য রইল সীমাহীন শুভকামনা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
১. পনেরো কোটি মানুষের দেশে বাংলাদেশ বিমানকে আমরা এখনো ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারছি না। অথচ অর্ধেকের কম জনসংখ্যা নিয়ে থাইল্যান্ডের সিল্কের মতো মসৃণ থাই এয়ারওয়েজ ছাড়াও ব্যাংকক এয়ারওয়েজসহ অন্যান্য এয়ারওয়েজের যাত্রী হচ্ছি আমরা। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা হয়তো বা ৪০ গুণ কম, কিন্তু তাদের এয়ারওয়েজ নিশ্চয়ই কমপক্ষে ৪০ গুণ বড়। এমিরেটসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ একটি বাক্য সত্য। বিদেশি যাত্রীর কোনো প্রয়োজন নেই, শুধু দেশি যাত্রীদের সেবা দিতে পারলেই তো আমাদের বিমানের সমৃদ্ধি ঠেকায় কে? শুনেছিলাম, ভারতে রাষ্ট্রীয় কাজে ভ্রমণের জন্য জাতীয় পরিবহন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক ছিল। এ দেশে অনুরূপ নিয়ম প্রচলন করলে কি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুণ্ন হবে?
২. উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারতের রেলব্যবস্থার কোনো তুলনা নেই। স্বল্প ভাড়ায় বড় বড় দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য এমন ব্যবস্থার জুড়ি মেলা ভার। একই রকম জনবহুল দেশ হয়েও আমাদের রেলব্যবস্থা একটি লোকসানি খাত। যে দেশের এক-দশমাংশ মানুষের বাসস্থান রাজধানী যানজটে স্থবির, সেখানে রেলের মতো নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থা কেন অবহেলিত থাকবে, তা বোধগম্য নয়। চার যুগ আগে রোম শহরে গিয়ে শুনেছিলাম, রেলস্টেশন থেকে নাকি মিনিটে মিনিটে ট্রেন ছাড়ে। বড় বড় বিমানবন্দরে বিমানের ওঠানামার হার অনেকটা একই রকম। জনবহুল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম থেকে দিনে ১০-১৫টি না হয়ে ১০০টি ট্রেন তো ছাড়তে পারত। একইভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনে পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেন চললে তো যানজটও কিছুটা কমত। রাজধানীর যানজটের সমাধানে শুধু সড়কপথের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, নানা ধরনের যানবাহনের সমন্বিত ব্যবহারে তার সমাধান খুঁজতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে প্রাকৃতিকভাবে ঢাকা নদীবেষ্টিত হওয়ায় সে সুযোগও আমাদের আছে, কিন্তু ব্যবহারের আগ্রহের অভাব। রাজধানীর চারদিকে পানিপথ শুধু যাত্রী পরিবহনেই নয়, শহরের সৌন্দর্যবর্ধনেও ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. যানজট-সমস্যাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বহুমুখী আক্রমণ করতে হবে। স্কুল-কলেজে ছাত্রদের আনা-নেওয়াও যানজট-সমস্যাকে প্রকট করে। তাই স্কুল-কলেজে ভর্তি অবশ্যই ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী হওয়া উচিত। এতে যানজটও যেমন হ্রাস পাবে, ঠিক তেমনি জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে। শুধু আমেরিকা, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতেই নয়, এমনকি ভারতেও স্কুল-কলেজে ভর্তিতে বাসস্থানের নৈকট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর ফলে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার যে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তা বলা যাবে না। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী স্কুল-কলেজে ভর্তি হলে মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভিকারুননিসা আর নটর ডেম কলেজে সীমাবদ্ধ না হয়ে সারা দেশেই বিস্তৃত হবে।
৪. পাবলিক পরীক্ষা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় এলেই আমরা কোচিং সেন্টারগুলোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে থাকি, যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো কোচিং সেন্টার। অথচ বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে সফল প্রতিযোগীদের কম করে হলেও ৯৯ শতাংশ ছাত্র কোচিং সেন্টারে প্রস্তুতি নেয়। শুধু তা-ই নয়, কোচিং সেন্টারের কোনো শিক্ষকই বোর্ড কিংবা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করেন না। আমি অনেক শিক্ষার্থীকেই বলতে শুনেছি, কলেজে দেড় বছরে যা শিখেছে, কোচিং সেন্টারে তিন মাসে তার কয়েক গুণ বেশি শিখেছে। সুতরাং, ভাবতে হবে অগ্রাধিকারযোগ্য কাজ কোনটি। কোচিং সেন্টার বন্ধ করা, না আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষাদানের মানোন্নয়ন করা। এ ছাড়া যথাযোগ্য প্রশ্ন করে প্রমাণ করতে হবে যে কোচিং সেন্টারে গিয়ে কোনো লাভ নেই। ১০ লাখ ছাত্রকে যে প্রশ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে, তা দু-চার হাজার টাকা ও দু-তিনজন শিক্ষকের চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যবহার করে করাটা রীতিমতো অন্যায়। এই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য সারা বছর রীতিমতো গবেষণা করা উচিত, যেমনটি করা হয় টোয়েফল, স্যাট কিংবা জিআরই পরীক্ষার জন্য, যার মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর নানা বর্ণ-গোত্র-ধর্ম-বিশ্বাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের বাছাই করতে অসুবিধা হয় না।
৫. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব থাকলেও সাধারণ মানুষ আইন পালন করে থাকে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটালে অন্তত সাধারণ মানুষ যে পালন করে, তার উদাহরণ হলো সারা দিনের অফিস শেষে ঘরমুখী মানুষের বাসের মাত্রাতিরিক্ত বড় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, যদিও অপেক্ষাকৃত ধনবান মানুষেরা লাইনে দাঁড়িয়ে সিএনজি নিতে তত আগ্রহী নয়। একইভাবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজপতিদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দৃশ্যমান নয়। ফেরি রুটিন অনুযায়ী না চলে নেতার গাড়ির আগমনের পর যদি ছাড়ে, সাংসদেরা সংসদ বর্জন করলেও সুযোগ-সুবিধা যদি শতভাগ নিশ্চিত করতে সদা তৎপর থাকেন, নানা রকম বিল পরিশোধে যদি গড়িমসি করেন, আইনের প্রয়োগ যদি হয় ব্যক্তি দেখে, নেতাদের আইনসম্মত কিংবা বেআইনিভাবে সুবিধা ভোগের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে যদি আগামী দিনের নেতা কিংবা আজকের পাতিনেতারা সাধারণ মানুষের জীবন যদি দুর্বিষহ করেন, সাধারণ মানুষের মঙ্গলের পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোয় যদি নেতারা ব্যস্ত থাকেন, বড় মাপের অপকর্ম করেও যদি সমাজের রাঘববোয়ালেরা ধরা না পড়েন, তাহলে আইনের শাসন বলে শত চিৎকার করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হবে না। মানুষ বিশ্বাস করবে, আইন শুধু দুর্বলকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আর দুর্জন ও শক্তিশালীদের বলিষ্ঠ করার জন্য। আইনকানুন নেতাদের যত দিন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ থেকে মুক্ত রাখবে, তত দিন সেই আইনের প্রতিও যেমন সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হবে না, ঠিক তেমনই নেতাদের প্রতিও তাদের শ্রদ্ধা তৈরি হবে না। নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সাধারণ মানুষকে দেশ গড়তে উৎসাহিত করা। এ কাজ করার জন্য প্রয়োজন ত্যাগ আর দুর্ভোগ পোহানোর ধৈর্য ও ভোগ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা।
৬. ফুটপাতের সামান্য আয়ে সংসার চালানো ফেরিওয়ালাদের ওপর চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ও সরকারি সম্পত্তি জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ব্যবস্থা নিতে অপারগতার কারণে আইন যে ক্ষমতার শাসন, সন্ত্রাসের শাসনকেই নিশ্চিত করে, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করবে। অগণিত ক্ষুদ্র মানুষের ছোট ছোট অন্যায়কে শাস্তি দিয়ে নয়, সমাজের গডফাদারদের উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী তৎপরতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।
৭. শত শত নতুন স্কুল স্থাপন নিঃসন্দেহে শিক্ষার সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু বর্তমান স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থার উন্নয়নেও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। স্কুলগুলোয় ভৌত অবকাঠামোর অভাব, লাইব্রেরিতে বইয়ের অভাব, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের অভাব, ছাত্রদের দক্ষতা অর্জনে উদ্যোগের অভাব, সর্বোপরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে একমাত্র উদ্বৃত্ত মানবসম্পদের যথাযথ উন্নয়নের অভাব দেশের উন্নয়নকে নিশ্চিতভাবে ব্যাহত করবে। শুধু ফিনল্যান্ড, সুইডেনের মতো উন্নত দেশ নয়, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তানের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলো জিডিপির ছয়-সাত শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও বিশ্বসভায় শিক্ষার মান দিয়ে সমীহ আদায় করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থা সম্মানজনক নয়।
জানি সমাজের ভুলত্রুটি তুলে ধরা সহজ, কিন্তু তা সমাধান করা মোটেই সহজ নয়। তবে এ-ও জানি, যাঁরা দেশ শাসনের এই গুরুদায়িত্ব হাতে নিয়েছেন, তাঁরা এই কঠিন কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং তাঁরা নিশ্চয়ই এই কঠিন কাজ করার যোগ্যতাও রাখেন।
আমাদের নেতারা সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করে একটি শ্রেয়তর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন, তার জন্য রইল সীমাহীন শুভকামনা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments