কে জিতবেন, কে হারবেন? by আসিফ নজরুল

আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী তো বটেই, সারা দেশের মানুষেরই ব্যাপক আগ্রহ আছে। সরকার রাজি না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন সেখানে সেনা মোতায়েন করতে পারেনি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনে কি কোনো প্রভাব ফেলবে? নির্বাচন কি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে? এ নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে মূল প্রার্থী তিনজন। কিন্তু এই নির্বাচনে শুধু তাঁদের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে না; হবে আরও কিছু পক্ষের জয়-পরাজয় নির্ধারণ; হবে কিছু বিতর্কের মীমাংসা, অন্তত আংশিকভাবে।
প্রার্থী নিয়ে প্রথমে বলে নিই। মূল তিনজন প্রার্থীর একজন বহু বছর ধরে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের অভিযোগ কখনো উচ্চারিত হয়নি। এমনকি বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। জনপ্রিয় এই প্রার্থীকে সমর্থন করে তাঁর বিজয় সুনিশ্চিত করতে পারত আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁকে সমর্থন দেয়নি। তার পরও নির্বাচন ঠিকমতো হলে এই প্রার্থীই জিততে পারেন। তিনি জিতলে তা হবে গণতন্ত্রের জয়, সকল সুন্দর কিছুর জয়। আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের মানুষ যোগ্য বিকল্পের অভাবে বড় দুই দলের ঠিক করা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর সামনে সুযোগ এসেছে যোগ্য একজন তৃতীয় বা বিকল্প প্রার্থীকে নির্বাচন করার। তিনি নির্বাচিত হলে তা হবে বড় দুই দলের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীন ও সুশীল সত্তার জয়।
এই প্রার্থী বিজয়ী হলে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আওয়ামী লীগ তখন বলবে, বিজয়ী আমাদের লোক; কাজেই আমাদেরই বিজয় হয়েছে! তারা এটি বললেও অসুবিধা নেই। কারণ, এই প্রার্থী জিতলে নারায়ণগঞ্জে কিছুটা হলেও সন্ত্রাস ও দখলদারির রাজনীতির প্রকোপ কমবে, বিরোধী দলের রাজনীতি করার পরিবেশ থাকবে—সর্বোপরি জনগণ একজন যোগ্য ও সৎ মেয়র থাকার সুফল ভোগ করবে।
অন্যদিকে যে প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণা চালিয়েছেন, তিনি জয়ী হলে আসলে এটি হবে শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জয়, আওয়ামী লীগের নয়। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের যে দাবি অন্য দুই প্রার্থী করে আসছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তা শোনেনি। আবার নির্বাচন কমিশন এই দুই প্রার্থী বেশি জনপ্রিয়—এমন এলাকায় বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করছে। ফলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হলেও তা বিতর্কিত বিজয় হবে, এই বিজয়ে কৃতিত্ব দাবি করার মতো তেমন কিছুও দলটির থাকবে না। বরং ফলাফল এমন হলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটি আরও জোরালোভাবে বলতে পারবে বিরোধী দল।
নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী (দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত) বিজয়ী হলে তা হবে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বিজয়। আওয়ামী লীগ তখন বলতে পারবে যে দলীয় সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া এবং ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এই দাবির ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচন একইভাবে (দলীয় সরকারের অধীনে, সেনা মোতায়েন ব্যতীত এবং ইভিএম পদ্ধতিতে) করার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। আমার ধারণা, নির্বাচনে কারচুপির পরিকল্পনা থাকলে তখন জাতীয় নির্বাচনের সময় করা হবে। জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের মতো প্রযুক্তিতে চরম উৎকর্ষ অর্জনকারী দেশ গত কয়েক বছরে ইভিএম নির্ভরযোগ্য নয় বলে বাদ দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পশিক্ষিত, স্বল্প-প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বল্পোন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই দেশে একতরফাভাবে ইভিএম চালু করার পেছনে কারচুপির চিন্তাই বেশি কাজ করছে—এমন বিশ্বাস বহু মানুষ করে থাকে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ইতিমধ্যে পরাজয় ঘটেছে নির্বাচন কমিশনের। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ‘টাকা নেবেন, কিন্তু ভোট দেবেন নিজের বিবেচনায়’ এ ধরনের অনৈতিক কথা বলেছেন এবং ইভিএম পরীক্ষামূলকভাবে ভোটারদের দেখানোর সময় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতীক দেখিয়েছেন—এসব নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু তাঁর এবং নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিও সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে। কমিশন প্রার্থীদের এবং নারায়ণগঞ্জবাসীকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার দিয়েছিল যে নির্বাচনের দুই দিন আগে থেকে সেনা মোতায়েন করা হবে। এর পরও সরকার নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে সেনা মোতায়েনে নির্দেশ দেয়নি। এমনকি এ-সম্পর্কিত কমিশনের চিঠির উত্তর দেওয়ার সৌজন্য প্রকাশ করেনি। এর আগে সরকার কমিশনকে বিভিন্নভাবে উপেক্ষা করেছে। কিন্তু কমিশনের অসহায়ত্ব ও সীমাবদ্ধতা কখনো এত প্রকটভাবে ফুটে ওঠেনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘সরকার দায়িত্ব পালন না করলে আমি কী করতে পারি!’ প্রথম আলোর ওয়েবপেজে কিছু পাঠক লিখেছেন, ‘আপনি পদত্যাগ করতে পারেন।’ আমি বলব, কমিশনের উচিত ছিল আগেই আরও অনেক ব্যক্তিত্বপূর্ণ ও আত্মমর্যাদাশীল আচরণ করা। বছর খানেক আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার যখন প্রথম সেনা মোতায়েন-সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ উপেক্ষা করে, কমিশনের তখনই উচিত ছিল, হয় উচ্চ আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা অথবা পদত্যাগের হুমকি দেওয়া। এখন বিদায়লগ্নে এসেও যদি কমিশনাররা পদত্যাগ করেন, তাতে একটি উজ্জ্বল নজির স্থাপিত হতে পারে দেশে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আরেকটি সুস্পষ্ট পরাজয় ঘটেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনবাদীদের। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, সরকারের কর্তব্য হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। কমিশন সহায়তা চেয়েছিল সেনা মোতায়েনের বিষয়ে। সরকার তা উপেক্ষা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, পছন্দমতো নির্বাচন করার লক্ষ্যে তার পক্ষে সংবিধান লঙ্ঘন করাও সম্ভব। দলীয় সরকারের এমন চরিত্র আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের অধীনে নির্বাচনে দেখেছি। এবারও দেখলাম। এই দৃষ্টান্ত কোনো আইনবলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে স্বাধীনভাবে কর্ম-সম্পাদন করা (অন্তত অচিরেই) সম্ভব নয়, তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে ‘জনগণের প্রার্থী’ বিজয়ী হতে পারেন, কিন্তু বিজয়ী হবে না ‘জনগণের সরকারের’। বিভিন্ন ভুল, অনিয়ম আর আইন ভঙ্গ করে নিজেই এই পরাজয় রচনা করেছে বর্তমান সরকার।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.