নদী-কপোতাক্ষ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও by আমিরুল আলম খান

বাংলাদেশের একদা বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ছিল ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প’। পাকিস্তান আমলে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। সেচ প্রকল্পে পানির জোগান দেওয়ার মতো পানি নেই খোদ গঙ্গার বাংলাদেশ অংশে, অর্থাৎ পদ্মায়। তাই ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প’ এখন জ্বলন্ত এক সমস্যার নাম। এখানেই শেষ নয়। এখন খোদ কপোতাক্ষই এক মরা নদ।
মৃত্যু তার শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলেই, যখন নদীয়ার জেলা কালেকটর শেকসপিয়র কপোতাক্ষের পানির উৎস মাথাভাঙ্গার সঙ্গে ভৈরবের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে (১৮৫৪) পরাধীন ভারতে রেলপথের সূচনা। ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে। এই লাইনকেই ১৮৬২ সালে দর্শনা হয়ে জগতী (কুষ্টিয়া) পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেলপথ বসাতে নদীর গতিপথে সেই প্রথম মানবসৃষ্ট বাধা তৈরি হলো এ দেশে। দর্শনায় জংশন নির্মাণ করতে ভৈরবকে বিচ্ছিন্ন করা হলো মাথাভাঙ্গা নদী থেকে। ১৮৬২ সালে আসাম বেঙ্গল রেললাইন স্থাপনের সময় দর্শনায় ভৈরব নদের ওপর রেল ব্রিজ নির্মাণের সুবিধার্থে মেহেরপুরের উজানে আপার ভৈরব বেঁধে দেওয়া হয়। দর্শনায় ভৈরবের ওপর ব্রিজ নির্মাণের ফলে ভৈরবে পানিপ্রবাহ কমে যায়। ১৯৩৮ সালে দর্শনায় ভৈরব নদের বড় ধরনের বাঁক ভরাট করে কেরু কোম্পানির চিনিকল স্থাপনের ফলে ভৈরবে পানির প্রবাহ একদম কমে গেল। ভৈরবে পানি না থাকলে কপোতাক্ষ পানি পাবে কোথা থেকে?
বছর দশেক আগে সরসকাঠিতে একটি কালভার্ট নির্মাণ করে কপোতাক্ষের মৃতদেহে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন কর্তারা। তুমুল আন্দোলনের মুখে ২০০৪ সালে খননের পর সরসকাঠি কালভার্টের উজানে ১১ কিলোমিটারের একটি অসম্পূর্ণ অংশ খনন করার সময় ২০০৫ সালে সরসকাঠিতে পুনরায় বাঁধ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে ভাটিতে ৪৫ কিলোমিটার খনন করা অংশসহ আরও বিরাট এলাকা পলি ভরাট হয়ে যায়। আড়বাঁধে মোহাচ্ছন্ন পানি উন্নয়ন বোর্ড আড়বাঁধ দিতে যত আগ্রহী, নদী খাত থেকে বাঁধ তুলতে ততটাই অনীহা তার। নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিই যেন পাউবির একমাত্র কাজ! মনে হয়, পানি ব্যবস্থাপনার এই একটি পাঠই তাঁরা নিয়েছেন, পানিনিষ্কাশন যে জল ব্যবস্থাপনার আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক, সে পাঠ তাঁদের দেবে কে?
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০০০ সালের বন্যার পানি বেতনা-কপোতাক্ষ দ্রুত বহন করে নিয়ে এই জনপদের মানুষকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে বেতনা-কপোতাক্ষের বুকে জমে বিপুল পলি। পরবর্তী দু-তিন বছরেই কপোতাক্ষের নাভিশ্বাস ধরা পড়ে মানুষের চোখে। দ্রুত চর পড়ে এক ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে শুরু করে। আর তখন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের উদ্বেগ বেড়ে চলে। গড়ে ওঠে ‘কপোতাক্ষ বাঁচাও’ আন্দোলন। কপোতাক্ষ যেখানে মরিচ্চাপে লীন হয়েছে, সেখান থেকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত বিস্তৃত অংশে তার গর্ভদেশ দুপাশের ভূমি থেকে উঁচু হয়ে গেল, কিছু তার উজানের ঢলে আসা, কিছু সাগর থেকে জোয়ারের টানে উঠে আসা পলি জমে জমে। এভাবে প্রাচীন জনপদ জায়গিরমহল, পাইকগাছা, কপিলমুনি, তালা, পাটকেলঘাটা, ত্রিমোহিনী, সরসকাঠি, সাগরদাঁড়ি, ঝিকরগাছা এখন ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার।
কপোতাক্ষের মৃত্যু ঘটতে থাকে যত দ্রুততায়, কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা গ্রহণ চলে ততই ঢিমেতালে। জীবন্ত কপোতাক্ষ ছিল জীবনের অপর নাম, এখন মৃত কপোতাক্ষ লাখ লাখ মানুষের অশেষ দুর্ভোগ ও মৃত্যুর কারণ। শুধু মানুষের মৃত্যুই নয়, দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের গোটা ইকো সিস্টেম এখন হুমকির মুখে। যে অতিরিক্ত পানি তার সাগরে টেনে নেওয়ার কথা, তা টানার ক্ষমতা নেই তার। সঙ্গে সাগর থেকে উঠে আসা জোয়ারের পানি জমছে মানুষের ভিটেয়, হাট-বাজারে, স্কুল-কলেজে, মসজিদ-মন্দিরে, ফসলি জমিতে, রাস্তায়, গোরস্থানে। জীবন সেখানে স্থবির হয়ে গেছে, গোটা ইকো সিস্টেম ধসে পড়েছে।
সমস্যার সমাধানে পানি উন্নয়ন বোর্ড আড়বাঁধের (এনক্লোজার) সেই পুরোনো প্রযুক্তি নিয়েই কাজ করছে। তারা ‘সাসটেইনেবল ড্রেনেজ অব কবোডাক বেসিন আনডার যশোর-সাতক্ষীরা ডিস্ট্রিক্ট’ নামে যে প্রকল্প প্রণয়ন করেছে, তাতে সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা আরও জটিল করে তুলবে বলে ‘কপোতাক্ষ বাঁচাও’ আন্দোলনকারীরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, উল্লিখিত প্রকল্পে কপোতাক্ষ খননের জন্য যে প্রায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার পুরোটাই জলে যাবে। তাঁরা আরও বলছেন, শুধু ভাটিতে নদী খননে কপোতাক্ষ বাঁচবে না, উজান থেকে খননকাজ করতে হবে। এ জন্য স্থায়ীভাবে এখানে ড্রেজার রাখতে হবে, খনন চলবে সারা বছর। তাঁরা একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা দাবি করছেন। সে দাবি অনুযায়ী (১) কপোতাক্ষকে উজানে মাথাভাঙ্গা নদী খাত বরাবর পদ্মার সঙ্গে সংযোগ দিতে হবে এবং (২) অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথমে কপোতাক্ষ এবং পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো সংস্কার করতে হবে। ‘কপোতাক্ষ বাঁচাও’ আন্দোলনকারীরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে এটা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, উজানের প্রবাহ যুক্ত করা ছাড়া ভাটির অংশে পলি অপসারণ করে নদীকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করা যায় না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এখন কপোতাক্ষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বেতনার জলাবদ্ধতা। মোট কথা, কপোতাক্ষ-বেতনা ক্রমেই যশোর-খুলনা ও সাতক্ষীরার লাখ লাখ মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে উঠছে। তারা হচ্ছে জল-উদ্বাস্তু। কিন্তু কোথায় যাবে এই লাখ লাখ জল-উদ্বাস্তু?
‘কপোতাক্ষ বাঁচাও’ কমিটি মনে করে, একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে গোয়ালন্দসহ দেশের মধ্য অঞ্চলে বন্যার ব্যাপকতা কমে যাবে। কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার লবণাক্ততা দূর হবে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতার অবসান ঘটবে, সুন্দরবন রক্ষা পাবে এবং পরিণতিতে এই অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য অটুট থাকবে।
উল্লেখ্য, এ ধরনের সামগ্রিক ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলায় ইছামতী নদীকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে। তারা সব আড়বাঁধ, পাটা তুলে দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে নদীর দুপাশের সব স্থাপনা। আমরা পশ্চিম বাংলার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
Amirulkhan7@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.