সাত জুনের দিকে ফিরে তাকানো by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

আমরা এখন পেছন ফিরে তাকাতে ভয় পাই। পাকিস্তানের কলোনিকালে আমরা যেসব বিদ্রোহ করেছি_কৃষক বিদ্রোহ, শ্রমিক বিদ্রোহ, ছাত্র বিদ্রোহ, সেসব বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকতে চাই। আমরা ভদ্রলোক হয়ে গেছি। ভদ্রলোকদের ধরনে ৭ জুন উদ্যাপন করতে চাই।


কলোনিকালকে তত্ত্ব ও ইতিহাসের দিক থেকে বিচার না করলে তত্ত্বের কাছে পেঁৗছানো যায় না, ইতিহাসের কাছে পেঁৗছানো হয় না। শ্রেণীবাদে কি শ্রেণীসংগ্রামের কাছে পেঁৗছানো যায়? ৭ জুন কলোনির নির্যাতিত শ্রেণীগুলোর উত্থান এবং শ্রেণীসংগ্রামের উত্থান। পপুলার মুভমেন্ট থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়েছে কলোনির শ্রেণী কাঠামো। ৭ জুন আমরা কলোনির ভদ্রলোকদের ঘৃণা করতে শিখেছি, একই সঙ্গে কলোনির ভদ্রলোকদের রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতির অঙ্গন থেকে বার করে দিয়েছি। রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন এবং নারী সংগঠন। রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে শ্রেণীবোধ এবং নৈতিকতার বোধ। উচ্চারিত হয়েছে রাজনীতি কেন করব? সংগঠন কেন করব? রাষ্ট্রক্ষমতা কেন দখল করব? কলোনির ভদ্রলোকদের রাজনীতি কলোনির সাধারণ মানুষকে ব্রুটালাইজ করেছে। সেখানে রাজনীতিতে এসেছে কৃষকদের পাশে শ্রমিক শ্রেণী। আমরা এখন থেকে, সমগ্র সমাজের বোধ থেকে রাজনীতি এবং রাজনীতির ক্ষমতা বিশ্লেষণ করা শুরু করেছি। আমরা বলা শুরু করেছি, আমাদের বাদ দিয়ে রাজনীতি নয়, আমাদের বাদ দিয়ে ক্ষমতা নয়।
ষাটের দশকে ডেমরা ও আদমজীকে কেন্দ্র করে, খালিশপুরকে কেন্দ্র করে, কালুরঘাটকে কেন্দ্র করে যে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে, সেখানে রাজনীতির মধ্যে এসেছে শ্রমিকদের অধিকারের বোধ। রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন মধ্যবিত্তদের শক্তিশালী হতে সাহায্য করেছে, তেমনি শ্রমিকদের সংগঠিত হতে সাহায্য করেছে। স্বায়ত্তশাসন ব্যাখ্যা করেছে অধিকারের সংজ্ঞা। আওয়ামী লীগ মধ্যবিত্তদের সংগঠিত করেছে, আর কমিউনিস্ট পার্টি প্রধানত শ্রমিকদের মিলিট্যান্ট করেছে। পূর্ব বাংলার মুক্তি এখানেই।
জুনের আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ শ্রমিকদের একত্র করেছে অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে স্পষ্ট করেছে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে, রাজনৈতিক দাবি আদায় ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হয় না। আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি দুই দিক থেকে স্বায়ত্তশাসনের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যাকে যুক্তি দিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মানববাদ বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না, এই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, এই অর্থে সমাজতন্ত্র, মানববাদ ও স্বায়ত্তশাসন এক ও অভিন্ন। এই কাজটা করতে গিয়ে সমাজতন্ত্রীরা সাহিত্যিক উৎসবাণী পরিব্রাজন করেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং লড়াই চেতনা তীব্র করার জন্য। এই চেতনা আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছে, একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে মিলিট্যান্ট ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এভাবে সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিস্তার লাভ করেছে। জুনের আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ কেবল মানবিক সংগ্রামের টেস্টিমনি নয়, এই বিদ্রোহের ইতিহাসে ব্যবহৃত হয়েছে লড়াইয়ের বিভিন্ন উৎস, বিশেষ করে কৃষক ও ছাত্রবিদ্রোহ এবং ভাষাবিদ্রোহের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী নজির। সাহিত্যের ব্যবহারের অর্থ সমাজতন্ত্র থেকে সরে আসা নয়। আওয়ামী লীগ এই সমালোচনা মধ্যে মধ্যে করেছে। গঙ্গা-যমুনার মতো এই দুই রাজনৈতিক দল সমাজতন্ত্রকে সামনের দিকে নিয়ে এসেছে। সমাজ বাস্তবতার ভেতরে প্রবেশ করেছে দুই রাজনৈতিক দল দুইভাবে।
কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকে রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে রাখা। আর আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকে রাষ্ট্র ও সমাজের বিষয় থেকে আলাদা করে রাখা। দুই ধরনের অভিজ্ঞতা দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেছে। ৭ জুন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে, বৈঠা ও হাল নিয়ে মিছিলের পর মিছিল ঢাকায় এসেছে। এ ধরনের লাল ঝাণ্ডা, বৈঠা ও হালের মিছিল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়, মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে বারবার হয়েছে। পরবর্তীকালে বিএনপি এ ধরনের লাল ঝাণ্ডা, বৈঠা ও হালের মিছিলকে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু এ ধরনের মিছিল যে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থনীতির-রাজনীতির মেলবন্ধনের মিছিল, এই সূত্র রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে।
দুই ধরনের অভিজ্ঞতা এর মধ্যে কাজ করেছে। প্রথমটি হচ্ছে ব্যক্তির মিলিট্যান্ট হওয়ার পারসেপশন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সামষ্টিক অভিজ্ঞতার পারসেপশন। সমাজ বিশ্লেষণের জন্য এ খুবই জরুরি 'টুল'। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা কী প্রক্রিয়ায় সামষ্টিক হয়, আবার সামষ্টিক অভিজ্ঞতা কী প্রক্রিয়ায় মিলিট্যান্ট হয়_শ্রেণীক্ষমতার বাস্তবতা উপেক্ষা করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। জুন বিদ্রোহ গুলি চালিয়ে দমন করার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান সরকার; কিন্তু জুন বিদ্রোহ থেকে উত্থিত আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে নিয়ে এসেছে। আন্দোলন এই অর্থে কখনো মরে না। কিন্তু স্রোত স্তিমিত হয়। শ্রমিক আন্দোলন বর্তমানে সবচেয়ে তীব্র পোশাক শিল্পে। এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিক এই আন্দোলনকে রূপান্তরিত করেছেন মিলিট্যান্ট আন্দোলনে।
আন্দোলন টিকে থাকে, আন্দোলন যাঁরা করেন তাঁরা বেঁচে থাকেন সব দুর্যোগে। এই আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকে পপুলার গণতন্ত্রের দিকে সিভিল লিবার্টি রক্ষা করার জন্য। মনু মিয়ারা এই কাজটা আমাদের জন্য করে গেছেন।
তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে সালাম জানাতেই জুন। কিন্তু এ কথাও সত্য, এই রাজনৈতিক দলের এক অংশ মনু মিয়াদের বুকের মধ্যে ভরে রাখে, আবার একই রাজনৈতিক দলের অপর অংশ ক্ষমতার রাজনীতিতে দিকভ্রান্ত হয়ে থাকে। তবু আন্দোলন চাই, তবু বেঁচে থাকতে চাই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি, কথাসাহিত্যিক ও শিল্পকলা বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.