চরাচর-জামাইষষ্ঠী by স্বপন কুমার দাস

বারো মাসের তেরো পার্বণে বাঁধা বাঙালি হিন্দুসমাজের জীবনাচার। এর কোনোটি ধর্মীয় প্রথা, কোনোটি লোকায়ত। জামাইষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকে এ প্রথার উদ্ভব। বৈদিক সমাজ থেকেই জামাইষষ্ঠী উদ্যাপিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পূজার আয়োজন করা হয়।
দেবী ষষ্ঠীর প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবিকে পূজা নিবেদন করা হয়। কেউ কেউ ঘট স্থাপন করেও পূজা করেন। ষষ্ঠীদেবী দ্বিভুজা, দুনয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসনা, সর্বসুলক্ষণা ও জগদ্ধাত্রী শুভপ্রদা। তিনি মাতৃত্বের প্রতীক। বিড়াল তাঁর বাহন। প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল সন্তান লালন-পালনে এবং নিরাপত্তা প্রদানে অদ্বিতীয়। ষষ্ঠীপূজার উদ্দেশ্য সন্তানের কল্যাণ ও সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা। দুর্গাপূজার মন্ত্রেই ষষ্ঠীদেবীর পূজা করা হয়। পূজার সময় দুর্গা নামের পরিবর্তে ষষ্ঠীদেবীর নাম উচ্চারণ করা হয়। তবে যজ্ঞ হয় না। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা প্রতিমা গড়ে ব্রাহ্মণ দিয়ে ঘটা করে পূজা করেন। যাঁদের নেই তাঁরা ঘরের মধ্যে পূজা সারেন। এঁদের সংখ্যাই বেশি। পূজার সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস রেখে মায়ের পূজা করেন। পূজা শেষে যাঁর নামে যে মালসা, তাঁর হাতে তা সহাস্যে তুলে দেওয়া হয়। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়। এ সময় মৌসুমি ফলই বেশি থাকে মালসায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের দুঃসহ গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। বিশেষ করে মেয়েজামাইকে বেশি বাতাস করা হয়। এ সময় হাস্যরসে পরিবেশ অত্যন্ত আনন্দময় হয়ে ওঠে। কথিত আছে, জনৈক গৃহবধূ স্বামীগৃহে নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে বারবার বিড়ালের ওপর দোষ দিয়ে আসছিল। একদিন তার সন্তান হারিয়ে গেলে পাপের ফল ভেবে সন্তান ফিরে পাওয়ার জন্য সে বনে গিয়ে দেবী ষষ্ঠীর আরাধনা শুরু করে। গৃহবধূর আরাধনায় দেবী সন্তুষ্ট হলে সে বনে সন্তান ফিরে পায়। এ কারণে ষষ্ঠীদেবীর অন্য নাম অরণ্যষষ্ঠী। এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার অপরাধে গৃহবধূর শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে পিতৃগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ওই গৃহবধূর মা-বাবা তাঁদের সন্তানের মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হন। তাই মেয়েকে দেখতে উন্মুখ মা-বাবা একবার ষষ্ঠীপূজার দিন শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানান। জামাইষষ্ঠী পূজার দিন শ্বশুরবাড়িতে সস্ত্রীক উপস্থিত হলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। জামাইকে পরিধানের জন্য দেওয়া হয় নতুন বস্ত্র, তাকে আপ্যায়ন করা হয় বিপুলভাবে। এরপর প্রতিবছর ষষ্ঠীপূজার দিন জামাইকে একইভাবে আমন্ত্রণ জানানো হতে থাকে। জামাইও নানা উপহারসামগ্রী ও মৌসুমি ফল নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হয়। দেখাদেখি পাড়াপড়শির মধ্যেও এ প্রথার বিস্তার ঘটে। এভাবে ষষ্ঠীপূজা রূপান্তরিত হয় জামাইষষ্ঠীতে। জামাইষষ্ঠী পার্বণ প্রচলনের পেছনে যে কাহিনীই থাকুক না কেন, বাঙালি হিন্দুসমাজে এ উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কন্যাসন্তান পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাই স্বামীগৃহে তার যাতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে না হয়, সে জন্য ষষ্ঠীপূজার দিন ঢাকঢোল পিটিয়ে জামাইবাবাকে ভূরিভোজ করিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হয়। এ পার্বণের মাধ্যমে জামাইয়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক আরো নিবিড় করা হয়, যাতে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে সুখ-শান্তিতে থাকে, তার কদর বৃদ্ধি পায়। তবে সমাজ বিবর্তনে এবং অন্যান্য কারণে বর্তমান সময়ে জামাইষষ্ঠীর গুরুত্ব কিছুটা খর্ব হলেও আজও হিন্দুসমাজে এর রেশ দেখা যায়। বিশেষ করে যে পরিবারে সদ্যোবিবাহিতা কন্যা আছে, সে পরিবারে এ পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.