সরল গরল-চন্দন শীলের খাতাটি উদ্ধার করুন by মিজানুর রহমান খান

আজ তাকাব সংখ্যালঘুদের দিকেও। তাঁরা কীভাবে ভোট দেন সেটা শুধু নয়, তাঁরা কীভাবে সংখ্যালঘুদের নির্বাচিত করেন, সেদিকেও। সাধু পৌলের গির্জায় গিয়েছিলাম। ফাদারকে পাইনি। তবে তত্ত্ব পেলাম, শহরে ১৫-২০টি খ্রিষ্টান পরিবার আছে। কিছুদিন আগে ফাদার দুটো কেক আনিয়েছিলেন। আইভী এলেও শামীম আসেননি।


নারায়ণগঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভিকনলাল ঠাকুর। পলাশীর যুদ্ধের পরে। তিনি লক্ষ্মীনারায়ণের সেবায়েত ছিলেন। নারায়ণের সঙ্গে গঞ্জ যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জ। ঢাকায় হয়েছে লক্ষ্মীবাজার। সংখ্যালঘুদের ভোট ৫০ থেকে ৬০ হাজার। কিন্তু সংখ্যালঘু প্রার্থী উন্নয়নে কোনো দলের প্রয়াস ছিল না। আজকের ভোটাভুটিতে যে মিনি পার্লামেন্ট জন্ম নেবে, সেখানে সংখ্যালঘু না থাকলে অবাক হব না।
১৮৬০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আড়াই শ বছরের ইতিহাসে ওই অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সংখ্যালঘুর কোনো মুখচ্ছবি নেই বললেই চলে। উমেশ ঘোষ পরপর দুবার মেম্বার হয়েছিলেন। সেই শেষ। এবার চার-পাঁচজন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর মধ্যে অসিতবরণ নামের এক বাম নেতার একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেই বলেছেন, ধনী লোকেরা বড় দুই দলকে চাঁদা দেন। কিন্তু সংগঠিত হওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। সংখ্যালঘুদের মধ্যে যাঁরা অগ্রসর, তাঁরা নির্বাচনী তরঙ্গ থেকে তফাতে থাকতে চান।
একটি ঘটনা খুলে বলি।
চন্দন শীল শামীম ওসমানের মুখপাত্র। নারায়ণগঞ্জে ২০০০ সালের জঙ্গি হামলার তিনি করুণ শিকার। বোমায় চন্দনের দুটো পা উড়ে যায়। এখন ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। ২৩ অক্টোবর তিনি শামীমের পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিচে বর্ণিত অভিযোগ দায়ের করেন।
‘আজ রোববার ভোরে আইভী-তৈমুরের কর্মী-সমর্থকেরা বাবুরাইল ঋষিপাড়া মন্দিরে হামলা করে লুটপাট ও ক্ষতিসাধন করে। এলাকার সংখ্যালঘু ভোটাররা আমার প্রতি সমর্থন প্রদান করায় সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুরের কর্মী-সমর্থকেরা মিলিতভাবে এ হামলা করে। ফলে এসব সংখ্যালঘু ভোটার ভীতসন্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটি নির্বাচনী আচরণবিধির ১০ ধারার “গ” উপধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ এখানে লেখা, ‘অনভিপ্রেত গোলযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দ্বারা কারও শান্তি ভঙ্গ করা যাবে না।’ সুতরাং ধারাটি অপ্রাসঙ্গিক।
রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান ২৩ অক্টোবর অভিযোগপত্র পেয়েই তাতে নিজ হাতে লেখেন, ‘সংশ্লিষ্ট ওসির কাছ থেকে প্রতিবেদন দিন চার ঘণ্টার মধ্যে।’ আমি তাঁকে যখন এ নিয়ে প্রশ্ন করি, তখন ২৭ অক্টোবরের দুপুর। মাঝখানে কেটে গেছে ৮০ ঘণ্টারও বেশি। আমি ঋষিপাড়ায় যাই। খালের ওপরে মাচা বাঁধা বাঁশের পাটাতনের ওপরে কালী, বিশ্বকর্মা, সরস্বতী, শীতলা, গণেশ ও ব্রহ্মার মূর্তি। কার্তিক চন্দ্র দাস ঋষিদের পঞ্চায়েত। তিনি জানালেন, তাঁরা এ বিষয়ে কারও কাছে কারও নাম বলেননি। দেখতে দেখতে ভিড় জমল। চন্দন শীলকে কেউ চেনেন না। খবর পেয়ে প্রথম আসেন মাসুদ। আমিও কথা বলি। তিনি ঘটনার বিবরণ দেন এভাবে: ‘আমরা ঋষিপাড়ায় শামীম ওসমানকে আনার ব্যবস্থা করি। তাঁদের ফুলের মালা কিনে দিই, যাতে তিনি আসলে তাঁরা তাঁকে বরণ করতে পারেন।’ ২১ অক্টোবর রাত নয়টায় শামীম ওসমান ঋষিপাড়ায় প্রতিমার পাশেই উঠান বৈঠক করেন। পরদিন ঋষিপাড়ায় ভোট চাইতে আসেন তৈমুর। কিন্তু তিনি ফুলের মালা পাননি। মাসুদের দাবি, ‘তৈমুর বলেছিলেন, শামীম আসল তোমরা তারে ফুলের মালা দিলা, আমাকে দিলা না, কাজটা ঠিক করলা না।’ আমি উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞেস করি, তাঁরা কেউ এই সংলাপ শুনেছেন কি না। তাঁরা কেউ শোনেননি। তবে তৈমুর এসেছিলেন। এরপর মাসুদুল বলেন, তৈমুর যাওয়ার পরপরই ঋষিপাড়ায় আইভী চলে আসেন। আমি নাটকীয়তা অনুভব করি। তাঁকে থামিয়ে জনতার কাছে জানতে চাইলে তাঁরা সবাই একবাক্যে তা অস্বীকার করেন। এরপর মাসুদুল কথা ঘুরিয়ে বলেন, তিনি ভেতরে ঢোকেননি। রিকশা দিয়ে গিয়েছেন। এরও সত্যতা খণ্ডন হয়। এরপর তিনি বলেন, তাঁর লোকজন এসেছিল।
আমি সাজিতে গুছিয়ে রাখা ভাঙা প্রতিমার ছবি তুলছিলাম। এ সময় একজন এগিয়ে এলেন। তিনি আফজাল হোসেন। বললেন, ‘গোছগাছ করার আগে তোলা ছবি রয়েছে।’ তাঁকে বললাম, ‘ছবিগুলো কখন তোলা?’ বললেন, ‘তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি।’ সিটি করপোরেশনের সিবিএর নির্বাচিত সেক্রেটারি হিসেবে আইভীর ‘দুর্নীতির’ বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী।
ঋষিপাড়া থেকে বেরিয়ে আমি আবার নির্বাচন দপ্তরে যাই। ততক্ষণে ওসির প্রতিবেদন নির্বাচন দপ্তরে পৌঁছে গেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘২২ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টা থেকে ২৩ অক্টোবর ভোররাত সাড়ে চারটার মধ্যবর্তী যেকোনো সময় কে বা কারা মন্দিরের মূর্তি ভেঙে ও মন্দিরে থাকা পূজার বাসনকোসন চুরি করে নিয়ে যায়। ঘটনাটি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ কি না, সে বিষয়ে গোপন অনুসন্ধান চলছে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে ফের কথা বলি। আপনি কি সন্তুষ্ট? তিনি বললেন, ‘আরও দুই জায়গা থেকে তদন্ত রিপোর্ট পেলে তারপর বলা যাবে। র‌্যাব এবং আমাদের এক নির্বাচনী কর্মকর্তাকেও পৃথকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছি।’ তাঁরা ইতিমধ্যে কোনো রিপোর্ট দিয়েছেন কি না, জানি না। তবে একটি টিভি চ্যানেলে শামীম ওসমান ও তৈমুরকে এ বিষয়ে কথা বলতে শুনেছি। আর আইভী ২৪ অক্টোবর নির্বাচন অফিসকে লিখেছেন, ‘এটা নারায়ণগঞ্জ নয়, জাতীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হেনেছে। উদ্বেগ, দুঃখ ও ঘৃণাভরে আমরা জানাতে চাই, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার আরও ঘটনা ঘটতে পারে। মন্দিরগুলোকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া দরকার।’
চন্দন শীলের সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করি। কী করে আইভী ও তৈমুরকে দুষলেন? তিনি বললেন, ভিকটিমরা অভিযোগ করেছেন। অন্তত একজনের নাম বলুন। তিনি বললেন, এখন স্মরণ নেই, তবে তাঁদের সবার নাম খাতায় লিখে রেখেছেন। তিনি উল্টো অনুযোগ করলেন, মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি এখানে প্রতিমা ভাঙার ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু প্রথম আলোতে এসব খবর ছাপা হয় না। তিনি এ প্রসঙ্গে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে গত ১৬ সেপ্টেম্বরের প্রতিমা ভাঙার কথা উল্লেখ করেন।
আমি তাঁর দপ্তর থেকে বেরিয়ে সোজা সেই মন্দিরে যাই। সেখানে কথা হয় প্রধান পুরোহিত মহারাজ অভিজিত চক্রবর্তী, পূজা কমিটির সহসভাপতি গোবিন্দ চন্দ্র সাহা প্রমুখের সঙ্গে। তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, এর সঙ্গে ভোটের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। কয়েকটা বখাটে ছেলে মন্দিরের চত্বরে তাস খেলছিল। তাদের বাধাদানকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল হয়। তারা নির্মাণাধীন দুর্গামূর্তির ক্ষতিসাধন করেছিল। পুরোহিতকে মেরেছিল। এ ঘটনায় মুনিরসহ দুজন গ্রেপ্তার হয়। তারা পারিবারিকভাবে বিএনপির সঙ্গে জড়িত।
ভোট ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ উৎসবের শহরে পরিণত হয়ে আছে। দুর্গার রেশ না কাটতেই কালীপূজা এল। আরও অনেক বিচিত্র ধর্মমত ও ভক্তের মিলনমেলা নারায়ণগঞ্জ। ইসকন শব্দটি শুনে প্রথমে বুঝতেই পারিনি এটি কী। অন্য দেবদেবী ব্যতিরেকে যাঁরা শুধু শ্রী কৃষ্ণের ভক্ত, তাঁরা ইসকনের সঙ্গে জড়িত। এটি ইংরেজি শব্দ। নিউইয়র্কে এর গোড়াপত্তন, কবি অ্যালেন গিনসবার্গও এর অনুসারী ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ বিপিন চন্দ্র পালও ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের আখড়ায় ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের প্রদীপে সলতে পরিয়ে বিপিন পাল ব্রিটিশদের ঘুম হারাম করেছিলেন। এ রকম ঐতিহ্যের শহরে নামজাদা দূরে থাক, তেমন মানের সংখ্যালঘু নেতার উত্থান একেবারেই কেন ঘটেনি, সেটা আমার কাছে এক বিস্ময়।
যা বলছিলাম। ঋষিপাড়া বা অন্য দু-একটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন। উৎসব তা ঈদ কিংবা পূজা—সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা ভাগাভাগি করে নেয়। কোনো দলগত বিদ্বেষ নেই। গতকাল বেলা পৌনে তিনটা। টেলিফোনে ঋষিপাড়ার ওই মামলার আইও নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলি। চন্দন তাঁর অচেনা। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া জনি ভবঘুরে। রিমান্ডে কোনো তথ্য মেলেনি। শুধু এটুকু বলব, কথিত ভিকটিমদের নাম লেখা চন্দন শীলের খাতাটি উদ্ধার করুন।
আবারও বলব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ দৃষ্টান্তের নগর নারায়ণগঞ্জ। বিভিন্ন স্তরের সংখ্যালঘু নেতারা বলেছেন, এই নগরের মিনি পার্লামেন্টে সংখ্যালঘুর যে কোনো জায়গা নেই, এটা তারা সেভাবে ভাবেনওনি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠদের এ নিয়ে ভাবা উচিত। জাতীয় নীতি হওয়া উচিত। কে সি দাস রোড, হরকান্তি ব্যানার্জি রোড, বি কে দাস রোড, ভগবানগঞ্জ যে শহরের ব্যস্ততম এলাকা, সেই শহরের সংসদে সংখ্যালঘুদের রাখা উচিত জাতিগত বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখ খোলাতে পশ্চিমবঙ্গের সাচার কমিশনের মতো একটা কমিশন আমাদেরও দরকার।
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আরও অটুট মেলবন্ধন কামনা করি। যোগ্য সংখ্যালঘু প্রার্থীর জন্য আমরা অধিকতর ভোট প্রার্থনা করি। অবশ্য একজন সংখ্যালঘু বলেন, ‘আমরা আমাদের ভোট আমাদের প্রার্থীদের দিই না। কারণ, বিপদে নেতা বিপন্ন বোধ করলে আমাদের আর কে বাঁচায়।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.