মুক্তিসংগ্রামের অকুতোভয় শিল্পী লড়াকু আজম খান by কামাল লোহানী
আজম খান আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে আর নেই। প্রথমে বর্ধিত জীবন নিয়ে ফিরে এসে বেশ কিছু দিন ভালোই ছিলেন। তারপর আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন মানুষকে লড়তে হয়, তখন অধিকাংশ সংবাদই শোক বহন করে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত মানুষ মাত্রই মানুষকে ছাড়তে চায় না।
এমনই অবস্থায় পড়েছিলাম গণশিল্পী আজম খানকে নিয়ে। কিন্তু আজম খানের বিষয়টা বোধ হয় একটু ভিন্ন। তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হলেও চিকিৎসকরা আশাবাদী ছিলেন। চিকিৎসকদের আশাবাদ আমাদেরও যে প্রচণ্ডভাবে আশান্বিত করেছিল। আজমের সব প্রিয়জন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছেন ওঁর রোগমুক্তির। এ মরণরোগ ধরে যাকে, তাকে তো শেষ করেই ছাড়ে_আগে অথবা পরে। সুতরাং আমরাও প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজমের মতো এমন একজন লড়াকু মানুষ কি সহজে হার মানবেন? এমন আশান্বিত প্রশ্নও ছিল। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৫ জুন সকালে।
শিল্পী আজম খান আমার সুদীর্ঘকালের সহযোদ্ধা এবং একই চিন্তার মানুষ। দরিদ্র সজ্জনদের কল্যাণে আজম নিজেকে নিবেদন করেছিলেন এবং নিজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীচরিত্রের আবেগে হয়ে উঠেছিলেন প্রচণ্ড বোহেমিয়ান। এই সময় থেকেই তাঁর মনে যে বিবর্তন শুরু হয়েছিল, তা থেকেই আজম জড়িত হয়ে পড়েছিলেন মেহনতি মানুষের জীবন পরিবর্তনের রাজনীতির সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে মেনন গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এই পথ চলতে চলতেই তিনি দীক্ষা পেয়েছিলেন দেশ-বিদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে। আর নিজে তো ছিলেন এ দেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। তাই তাঁকে পাকিস্তানি দুঃশাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে দেখেছি সক্রিয় যোদ্ধা হিসেবে মাঠে-ময়দানে, রাজপথে, মিছিলে ও শোভাযাত্রায়। এই সময় রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার কারণে গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। আর সেই কমিটমেন্ট থেকেই গণশিল্পী আজম খান মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রুর মোকাবিলায়। গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন আজম_ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে। পল্টনের ময়দানে লাখো মানুষের সামনে জনগণের সঙ্গে সংগ্রামের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। ছুটে গিয়েছিলেন টঙ্গীর মিলব্যারাক থেকে নওগাঁয় ঈদগাহ মাঠে কিংবা রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম জাম্বুরি মাঠে_কোনো মঞ্চ ছাড়াই সংগীতানুষ্ঠান করে মাতিয়ে দিয়েছিলেন আজম, ইকবাল, খসরু, মাহবুব, ফকির আলমগীর, ওমর, সাজুরা। সে কী অভাবিতপূর্ব সাড়া মানুষের মধ্যে! এই গণসংগীত অনুষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন মনু, মুনীরুল আলম। সেই সেদিনের গণসংগীতানুষ্ঠান আয়োজনে যেমন ছিল আন্তরিকতা, তেমনি ছিল আলোড়ন, আর সেই সঙ্গে গতর খাটিয়ে আয়োজন সেরে আবার সেই গতর খাটানো মানুষগুলোই শিল্পী হয়ে জনগণকে জাগ্রত করার গান গেয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে মনে পড়ছে, পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮ সালে সিলেটের কুলাউড়া কৃষক সম্মেলনের অভূতপূর্ব অনুষ্ঠানের কথা। যাতে আজমও ছিলেন এক সংগঠক ও শিল্পী।
রাজনৈতিক বিশ্বাস আর আত্মোপলব্ধি থেকেই আজম খান একদিন দেশজ রাজনীতির অংশে পরিণত হয়েছিলেন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ আর নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়েও গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। অবশেষে একদিন যখন বাঙালির সব অর্জন ও অধিকার নস্যাৎ করে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী জুলুম-নির্যাতন নয়, মানুষ হত্যার নির্মম নৃশংসতায় উন্মাদ হয়ে উঠল, তখনই শিল্পী আজম খান বন্ধুদের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার তুলে নিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে আজম খান ছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধা। কিন্তু শিল্পীসত্তা থেকে দেশমাতৃকাকে সম্মানের সঙ্গে সুরক্ষা ও মানুষের অধিকার লড়ে নেওয়ার যুদ্ধে জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিল্পী, সংগ্রামী আজম খান লড়েছিলেন শত্রুর বিরুদ্ধে সামনাসামনি যুদ্ধে। তা সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধের দামামায় শত্রুর কামানের গর্জন কিংবা মর্টারের আঘাতে শিল্পীর দায়িত্ব ভুলে যাননি। তাই বাংকারে কিংবা মুক্তিসেনা ছাউনিতে বসেও সারাক্ষণ ভেবেছেন শত্রু নিধনের কথা। গান বেঁধেছেন, সুর দিয়েছেন, গেয়েও শুনিয়েছেন সহযোদ্ধাদের।
শিল্পীযোদ্ধা আজম খান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে গেয়েছেন_'বিপ্লবের রক্তরাঙ্গা ঝাণ্ডা উড়ে আকাশে', 'জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই', 'মার্কিনি লাল ইয়াংকিরা চায় কিহে, রক্ত হে' কিংবা 'ইসবার লড়াই লড়নে ওয়ালা বাঁচকে না যানে পায়ে গা', 'মোরা স্বর্গে যাব গো, খালি পেটে পেটে মোরা স্বর্গে যাব গো', 'আজি বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার', 'মুসলিম লীগের কাণ্ড দেইখ্যা পরান ওঠে জ্বলি রে', 'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট', 'শিকল পরা ছল রে', 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে', 'ডলার এল দেশে' 'হিংসায় উন্মত্ত পৃথি্ব', 'অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি', 'বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে'_সেই লড়াই-সংগ্রামের অধ্যায়ে আজম খান এমন কত যে গান বন্ধুদের সঙ্গে গেয়েছেন, তার হিসাব নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী'কে পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে ভীষণভাবে হোঁচট খেলাম। দেখলাম, আমাদের যে গানের দলের নেতৃত্ব দিত, তার মধ্যে স্খলন দেখা দিয়েছে। কাঁধে স্টেন ঝুলিয়ে টিভিতে গিয়ে প্রোগ্রাম চাইছে, খবর এল। আরো খবর পেলাম, অফিসে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অস্ত্র দেখানো হচ্ছে। এই নীতিহীনতাকে 'ক্রান্তি' কিছুতেই সহ্য করতে পারল না। সভা ডেকে সংগঠন বন্ধ ঘোষণা করা হলো এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হলো এ সিদ্ধান্ত। সেই থেকে ক্রান্তির গোষ্ঠীগত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এমনই সময় বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল সংস্কৃতিক্ষেত্রে আধুনিকতার অভিষেক ঘটানোর উদ্দেশ্যে 'স্পন্দন' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন দাঁড় করালেন, যার মধ্যে ছিলেন আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফকির আলমগীর প্রমুখ।
আজম খান আগাগোড়াই শীর্ণকায় ছিলেন। অসুস্থ থাকতেন মাঝেমধ্যেই। মধ্যে তো বহু বছর সংগীত পরিবেশন থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন। আর হয়তো ফিরবেন না সংগীতে_এমনই ধারণা পোষণ করতেন সবাই। কিন্তু আজমের মনের জোরে দেহের দুর্বলতাকে জয় করে সত্যিই ফিরলেন সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যে। জীবনটাই সংগ্রামের। তাই অর্থকষ্ট হয়তো কোনো দিনও তাঁকে ছাড়েনি। তবু সংগীতকে তিনি ছাড়তে পারেননি।
আজম বোধ হয় 'ছন্নছাড়া' জীবনের এক দুর্ধর্ষ নাবিক। জীবনটাকেই সংগ্রামের 'কুরুক্ষেত্র' ভেবে কাটিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই আমরা ভাবছিলাম, হয়তো বিয়েই করবেন না। কিন্তু দেখলাম, সামাজিকতার প্রচলিত বাঁধন ছিঁড়ে একদিন আজম খান বিয়েও করলেন, তাঁর ইচ্ছামাফিক। এ জন্যও তাঁকে লড়তে হয়েছে সমাজে ও সংসারে। কোনো দিনও নিরুপদ্রব থাকতে পারেননি আজম। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাঁর সতীর্থ ও ভক্তরা ভিড় করেছিলেন হাসপাতালে। গত সপ্তাহে আজম জ্ঞান ফিরে পেয়ে ইশারায় কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন।
প্রথমবার যখন আজম খান অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন সরকারের তরফে সহযোগিতা মিলেছিল। এ প্রাপ্তি আজম খানের জন্য ছিল খুব স্বাভাবিক। এমন একজন দেশপ্রেমিক শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবল গণশিল্পী আজম খান শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই বটে, কিন্তু তিনি কখনো অতীত হবেন না। আজম খানকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ রাখতে হবে তাঁরই জন্য। লড়াকু সৈনিক, গণশিল্পী, দেশপ্রেমিক আজম খান দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে গেলেন মরণব্যাধির সঙ্গে। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
শিল্পী আজম খান আমার সুদীর্ঘকালের সহযোদ্ধা এবং একই চিন্তার মানুষ। দরিদ্র সজ্জনদের কল্যাণে আজম নিজেকে নিবেদন করেছিলেন এবং নিজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীচরিত্রের আবেগে হয়ে উঠেছিলেন প্রচণ্ড বোহেমিয়ান। এই সময় থেকেই তাঁর মনে যে বিবর্তন শুরু হয়েছিল, তা থেকেই আজম জড়িত হয়ে পড়েছিলেন মেহনতি মানুষের জীবন পরিবর্তনের রাজনীতির সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে মেনন গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এই পথ চলতে চলতেই তিনি দীক্ষা পেয়েছিলেন দেশ-বিদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে। আর নিজে তো ছিলেন এ দেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। তাই তাঁকে পাকিস্তানি দুঃশাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে দেখেছি সক্রিয় যোদ্ধা হিসেবে মাঠে-ময়দানে, রাজপথে, মিছিলে ও শোভাযাত্রায়। এই সময় রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার কারণে গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। আর সেই কমিটমেন্ট থেকেই গণশিল্পী আজম খান মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রুর মোকাবিলায়। গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন আজম_ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে। পল্টনের ময়দানে লাখো মানুষের সামনে জনগণের সঙ্গে সংগ্রামের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। ছুটে গিয়েছিলেন টঙ্গীর মিলব্যারাক থেকে নওগাঁয় ঈদগাহ মাঠে কিংবা রাতের আঁধারে চট্টগ্রাম জাম্বুরি মাঠে_কোনো মঞ্চ ছাড়াই সংগীতানুষ্ঠান করে মাতিয়ে দিয়েছিলেন আজম, ইকবাল, খসরু, মাহবুব, ফকির আলমগীর, ওমর, সাজুরা। সে কী অভাবিতপূর্ব সাড়া মানুষের মধ্যে! এই গণসংগীত অনুষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন মনু, মুনীরুল আলম। সেই সেদিনের গণসংগীতানুষ্ঠান আয়োজনে যেমন ছিল আন্তরিকতা, তেমনি ছিল আলোড়ন, আর সেই সঙ্গে গতর খাটিয়ে আয়োজন সেরে আবার সেই গতর খাটানো মানুষগুলোই শিল্পী হয়ে জনগণকে জাগ্রত করার গান গেয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে মনে পড়ছে, পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮ সালে সিলেটের কুলাউড়া কৃষক সম্মেলনের অভূতপূর্ব অনুষ্ঠানের কথা। যাতে আজমও ছিলেন এক সংগঠক ও শিল্পী।
রাজনৈতিক বিশ্বাস আর আত্মোপলব্ধি থেকেই আজম খান একদিন দেশজ রাজনীতির অংশে পরিণত হয়েছিলেন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ আর নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়েও গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। অবশেষে একদিন যখন বাঙালির সব অর্জন ও অধিকার নস্যাৎ করে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী জুলুম-নির্যাতন নয়, মানুষ হত্যার নির্মম নৃশংসতায় উন্মাদ হয়ে উঠল, তখনই শিল্পী আজম খান বন্ধুদের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার তুলে নিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে আজম খান ছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধা। কিন্তু শিল্পীসত্তা থেকে দেশমাতৃকাকে সম্মানের সঙ্গে সুরক্ষা ও মানুষের অধিকার লড়ে নেওয়ার যুদ্ধে জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিল্পী, সংগ্রামী আজম খান লড়েছিলেন শত্রুর বিরুদ্ধে সামনাসামনি যুদ্ধে। তা সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধের দামামায় শত্রুর কামানের গর্জন কিংবা মর্টারের আঘাতে শিল্পীর দায়িত্ব ভুলে যাননি। তাই বাংকারে কিংবা মুক্তিসেনা ছাউনিতে বসেও সারাক্ষণ ভেবেছেন শত্রু নিধনের কথা। গান বেঁধেছেন, সুর দিয়েছেন, গেয়েও শুনিয়েছেন সহযোদ্ধাদের।
শিল্পীযোদ্ধা আজম খান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে গেয়েছেন_'বিপ্লবের রক্তরাঙ্গা ঝাণ্ডা উড়ে আকাশে', 'জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই', 'মার্কিনি লাল ইয়াংকিরা চায় কিহে, রক্ত হে' কিংবা 'ইসবার লড়াই লড়নে ওয়ালা বাঁচকে না যানে পায়ে গা', 'মোরা স্বর্গে যাব গো, খালি পেটে পেটে মোরা স্বর্গে যাব গো', 'আজি বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার', 'মুসলিম লীগের কাণ্ড দেইখ্যা পরান ওঠে জ্বলি রে', 'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট', 'শিকল পরা ছল রে', 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে', 'ডলার এল দেশে' 'হিংসায় উন্মত্ত পৃথি্ব', 'অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি', 'বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে'_সেই লড়াই-সংগ্রামের অধ্যায়ে আজম খান এমন কত যে গান বন্ধুদের সঙ্গে গেয়েছেন, তার হিসাব নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী'কে পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে ভীষণভাবে হোঁচট খেলাম। দেখলাম, আমাদের যে গানের দলের নেতৃত্ব দিত, তার মধ্যে স্খলন দেখা দিয়েছে। কাঁধে স্টেন ঝুলিয়ে টিভিতে গিয়ে প্রোগ্রাম চাইছে, খবর এল। আরো খবর পেলাম, অফিসে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অস্ত্র দেখানো হচ্ছে। এই নীতিহীনতাকে 'ক্রান্তি' কিছুতেই সহ্য করতে পারল না। সভা ডেকে সংগঠন বন্ধ ঘোষণা করা হলো এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হলো এ সিদ্ধান্ত। সেই থেকে ক্রান্তির গোষ্ঠীগত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এমনই সময় বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল সংস্কৃতিক্ষেত্রে আধুনিকতার অভিষেক ঘটানোর উদ্দেশ্যে 'স্পন্দন' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন দাঁড় করালেন, যার মধ্যে ছিলেন আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফকির আলমগীর প্রমুখ।
আজম খান আগাগোড়াই শীর্ণকায় ছিলেন। অসুস্থ থাকতেন মাঝেমধ্যেই। মধ্যে তো বহু বছর সংগীত পরিবেশন থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন। আর হয়তো ফিরবেন না সংগীতে_এমনই ধারণা পোষণ করতেন সবাই। কিন্তু আজমের মনের জোরে দেহের দুর্বলতাকে জয় করে সত্যিই ফিরলেন সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যে। জীবনটাই সংগ্রামের। তাই অর্থকষ্ট হয়তো কোনো দিনও তাঁকে ছাড়েনি। তবু সংগীতকে তিনি ছাড়তে পারেননি।
আজম বোধ হয় 'ছন্নছাড়া' জীবনের এক দুর্ধর্ষ নাবিক। জীবনটাকেই সংগ্রামের 'কুরুক্ষেত্র' ভেবে কাটিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই আমরা ভাবছিলাম, হয়তো বিয়েই করবেন না। কিন্তু দেখলাম, সামাজিকতার প্রচলিত বাঁধন ছিঁড়ে একদিন আজম খান বিয়েও করলেন, তাঁর ইচ্ছামাফিক। এ জন্যও তাঁকে লড়তে হয়েছে সমাজে ও সংসারে। কোনো দিনও নিরুপদ্রব থাকতে পারেননি আজম। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাঁর সতীর্থ ও ভক্তরা ভিড় করেছিলেন হাসপাতালে। গত সপ্তাহে আজম জ্ঞান ফিরে পেয়ে ইশারায় কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন।
প্রথমবার যখন আজম খান অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন সরকারের তরফে সহযোগিতা মিলেছিল। এ প্রাপ্তি আজম খানের জন্য ছিল খুব স্বাভাবিক। এমন একজন দেশপ্রেমিক শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবল গণশিল্পী আজম খান শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই বটে, কিন্তু তিনি কখনো অতীত হবেন না। আজম খানকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ রাখতে হবে তাঁরই জন্য। লড়াকু সৈনিক, গণশিল্পী, দেশপ্রেমিক আজম খান দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে গেলেন মরণব্যাধির সঙ্গে। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments