সরল গরল-প্রশ্নটি আইভীর বিজয়ের চেয়ে বড় by মিজানুর রহমান খান

ক্ষমতাসীনরা হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধ্যান-ধারণা মুছে দিতে চাইছে। সেনা-সম্পৃক্ততার বিষয়টি কার্যত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণেই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে।
তারা পুলিশ দিয়ে নির্বাচন করার কথা চিন্তাও করেনি। সেনা মোতায়েন করা হয়নি—শুধু এটুকু শব্দ ও ধ্বনিগত তফাত সরকার দেখাতে পেরেছে। তারা বাধ্য হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা র‌্যাবের প্রায় এক হাজার ৪০০ সদস্য দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে। নির্বাচন কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের কাছে মাত্র চার কোম্পানি, অর্থাৎ অনধিক ৪০০ সেনা চেয়েছিল। আমরা জানি না, র‌্যাবের এক হাজার ৪০০ সেনার মধ্যে কতজন সেনাবাহিনী থেকে এসেছেন।
বিশ্বব্যাপী এমএসিপি বা এমএসিএ কথাটি পরিচিত। এটা হলো ‘মিলিটারি এইড টু দ্য সিভিল পাওয়ার বা অথরিটি’। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি ও ইতালিতে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। আমাদের দেশেও ব্রিটিশ আমল থেকে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আমরা যদি ‘সেনাপ্রীতি’ ঘোচাতে চাই, তাহলে জার্মানির মতো সংবিধান শুধরে নিলেও পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মান সংবিধান কঠোরভাবে সেনাবাহিনীর সব রকম পুলিশি ভূমিকা নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের এখানে যে কাণ্ড ঘটে গেল, সেটা ইসির স্বাধীনতাকে রক্তাক্ত করার। শঙ্কাটা সংবিধান লঙ্ঘন করে পার পেয়ে যাওয়ার।
সেনা মোতায়েনের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে। তাদের বলা হয়, স্ট্রাইকিং ফোর্স কিংবা শো অব ফোর্স। এর মানে, চমক দেখানো শক্তি। নারায়ণগঞ্জের সড়কগুলো দিয়ে জলপাই রঙের পোশাক পরা সেনারা ভোটের আগের রাতে শুধু স্বাভাবিক টহল দিলেই তার একটা বিরাট মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত তৈরি হতো।
আইভীর ভূমিধস জয়ে এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত ছিল বলা যাবে না। কিন্তু সরকার এটাই ধরে নেবে, তারা মার্জনা পাবে। কমিশন বা মিডিয়া আর এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। ভুলে যাবে। কিন্তু এদিন তো দিন নয়।
গতকাল হাইকোর্টে সরকারি সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করা হয়েছে। বিএনপিদলীয় এক সাংসদ প্রতিরক্ষাসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর আইনগত নোটিশ জারি করেছেন। এতে কারও দলীয় মতলব থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু আইনগতভাবে প্রতিকার লাভের রিট প্রচেষ্টাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ রুল জারি না করে নিয়মিত বেঞ্চে রিট দায়ের করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত আমাদের মনঃকষ্ট বাড়িয়েছে। কারণ, নির্বাচন স্থগিত করার রুল জারি না করেও এর ওপর শুনানি হতে পারত। নির্বাচন কমিশনাররা শপথে বলেন, সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব। কিন্তু বিচারপতিরা বলেন, ‘আমি সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব।’ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আইনেও সমর্থিত। সুতরাং, গতকাল আদালতে নাগরিকেরা এমন একটি জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করেছিলেন, যেখানে সংবিধান ও নির্বাচনী আইন—দুটোই লঙ্ঘিত হয়েছে।
হাইকোর্ট তার এখতিয়ার গতকাল যদি প্রয়োগ করতেন, অর্থাৎ অন্তত একটা শুনানির ব্যবস্থা করতেন, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কিন্তু জনগণের কাছে উচ্চ আদালতের মর্যাদা অনেক বেশি বেড়ে যেত। নির্বাহী বিভাগ দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘনের প্রতিকার চাওয়ার দুটো জায়গা সভ্য সমাজে স্বীকৃত। একটি আদালত, অন্যটি সংসদ। আমাদের সংসদ ৭০ অনুচ্ছেদে অবনত, রাবার স্ট্যাম্প। বাকি থাকে হাইকোর্ট। বিরোধী দল প্রায়ই সংবিধান লঙ্ঘনের রোষ রাজপথে উসুল করে নিতে চায়। এখন যদি হাইকোর্ট নাগরিকদের এভাবে পত্রপাঠ বিদায় করে, তাহলে তো বিরোধী দলেরই পোয়াবারো।
আওয়ামী লীগ সরকারই পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে প্রথমবারের মতো এই তথ্য হাজির করেছে যে সংবিধানের কতিপয় বিধান লঙ্ঘন করা হলে নাগরিকের সে জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হতে পারে। তাহলে এক দেশে শাসক ও শাসিতের জন্য দুই রকম বিধান চলতে পারে না। যিনি যত বড় মাপেরই নির্বাচিত শাসক হন না কেন, সংবিধান লঙ্ঘনে সংবিধান তাঁদের কোনো লাইসেন্স দেয় না। শাসকের পছন্দমতো কতিপয় বিধানের জন্য আদালতে নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হবে, তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। সাংবিধানিক আদালত তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করবেন। কিন্তু জনগণের যেখানে অগ্রাধিকার, যেখানে তাদের ব্যাকুলতা, যেখানে তাদের আবেগ—সেখানে শাসক যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন, তখন কী হবে? সংবিধানে এর কোনো উত্তর নেই। আমাদের নাগরিক সমাজ এর উত্তর পেতে কখনো খুব বেশি উচ্চকিত হয়নি। কিন্তু এখন নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার মতো বিধান সংবিধানে লেখার পর তাদের আর নীরব থাকার সুযোগ নেই।
নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েন না করায় সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যথার্থই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তিনি মনে হয় খেয়াল করেননি, এ রকমের একটি উক্তি জনসমক্ষে উচ্চারণ করলেই তাঁর দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। উচ্চ আদালতে নাগরিকদের পক্ষে রিট করা হয়েছে। কিন্তু কমিশনেরও রিট করার অধিকার স্বীকৃত এবং তার জন্যও দরজা খোলা।
আমরা বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে এই সাহস দেখানোর জন্য জোরালোভাবে আহ্বান জানাই। অনেকে বলছেন, আত্মমর্যাদা নিয়ে পদত্যাগ করতে। আমরা এখন বলি, পদত্যাগ না করে আইনি লড়াইয়ে নামতে। কারণ, নির্বাচন কমিশন নামের একটি সাংবিধানিক সংস্থাকেও গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে নামতে হবে। তাকে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক কিংবা দলীয় সরকারের শুধু অনুকম্পা কিংবা মর্জির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তখনই বেশি প্রশংসিত হন, যখন তাঁরা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের দেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি এমন ভরসা এখনো আছে যে সরকারের অনৈতিক ও অবৈধ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেখানে প্রতিকার মেলে। নির্বাচন কমিশনকেও তেমনি ভরসাস্থল হিসেবে আমরা দেখতে চাই। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে আর মাত্র তিন মাস। তাদের যদি জাতির প্রতি দায়দায়িত্ব থেকে থাকে, তাহলে ১২৬ অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের অবশ্যই আইনগত প্রতিকারের পথ খুঁজতে হবে। সিইসি বলেছেন, তিনি সেনা মোতায়েন না করার কারণ জানতে সচেষ্ট হবেন। আশা করব, এই চেষ্টায় তিনি কালক্ষেপণ করবেন না। সংবিধান রক্ষণের যে শপথ তিন কমিশনার নিয়েছেন, তা অর্থপূর্ণ হতে পারে যদি তাঁরা সরকারের সংবিধান লঙ্ঘনকে চ্যালেঞ্জ করেন।
আমরা কথায় কথায় টিএন সেশনের কথা উল্লেখ করি। সেটা কিন্তু এমন নয় যে আমাদের সংবিধানের চেয়ে ভারতীয় সংবিধানে অনেক শক্ত ভাষায় অনেক কিছু লিখে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ১২৬ অনুচ্ছেদের মতো অবিকল ভারতীয় সংবিধানেরও একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। তারা সেই অনুচ্ছেদ দিয়ে ২২টি বাংলাদেশের সমান বিশাল ভারতের নির্বাচনী বিধিব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত ও অনুস্মরণীয় করে তুলেছে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত এখন একটি মডেল।
অস্ট্রেলিয়ার পার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে যে দিনটিতে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন হয়, ঠিক সে সময় রাজধানী ঢাকায় সেনা মোতায়েন না করার অস্বচ্ছ সিদ্ধান্তের কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। এখানে একটি পরিহাস ঘটেছে। সেটি হলো, কমনওয়েলথ মহাসচিব তাঁর ভাষণে গভীর সন্তুষ্টির সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তাঁরা একটি মহৎ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর নির্বাচন কমিশনের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের ‘গোল্ডেন প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করতে তাঁরা একমত হয়েছেন। তিনি তখন জানতেন না, হয়তো এতক্ষণে জেনেছেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল পার্থে এসে পিকনিকের মেজাজে যখন সময় কাটায়, তখন তাঁরা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ‘গোল্ডেন প্র্যাকটিসে’ বাধা সৃষ্টি করেন।
বড় দুটি দলেরই বাতিক হচ্ছে, যেকোনো অবস্থায়—জয়ে কিংবা পরাজয়ে, সুখে কিংবা দুঃখে, লজ্জায় কিংবা অপমানে—সব পরিস্থিতিতে নিজেদের অভ্রান্ত ও কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে জাহির করা। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও তারা একই কাজ করবে। কিন্তু একটাই কথা, সরকারের সংবিধান লঙ্ঘনকে বিএনপির রাজপথে আন্দোলনের মসলা হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। এর ফসল নাগরিকদের গোলায় তুলতে হবে। আর সে জন্য নির্বাচন কমিশনেরই উচিত হবে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। আশায় থাকলাম, ওই রিটের শুনানি নিয়মিত বেঞ্চে হবে। নির্বাচন হয়েছে, আইভী জিতেছেন, ক্ষমতাসীনেরা জনতার আদালতে তিরস্কৃত হয়েছে—এসব প্রেক্ষাপটে ওই রিট যেন ‘অকার্যকর’ কিংবা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বলে গণ্য না হয়। প্রশ্নটি একজন আইভীর বিজয়ের চেয়ে বড়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.