প্রতিক্রিয়া-ছোট্ট মেঘ, বড় ঝড় by মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর সেই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তাঁদেরই প্রিয়তম সন্তান মাহিরের (মেঘ) ওপর কী ধরনের নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে অনেক ধরনের বক্তব্যই গণমাধ্যমে এসেছে।
বিশেষ করে, একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মনে করে সংবাদকর্মীরা মাহিরের কাছ থেকে যে তথ্য জানার চেষ্টা করছেন, তা তার ক্রমবিকাশমান, নাজুক, কোমল মানসকাঠামোতে কী রকম ভাঙচুর ঘটাচ্ছে, সে বিষয়েও অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
এ বিষয়ে গত বুধবার প্রথম আলোতে একটি সংবেদনশীল ও যুক্তিপূর্ণ লেখা লিখেছেন সিমু নাসের। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের ইউনিসেফ ও এমআরডিআইয়ের প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ সপ্তাহেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক দুর্যোগ-পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি কর্মশালা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের জন্য গ্রুপভিত্তিকভাবে পর্যায়ক্রমে এ প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলছে। কর্মশালার ‘দুর্যোগ-পরবর্তী মনো-সামাজিক সেবা’ কার্যকর্মটির ওপর সংগত কারণেই আমাকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এ বীভৎস, রোমহর্ষক ঘটনা-পরবর্তী সময়ে শিশু মাহিরের ওপর কী রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়টিও আলোচনা করতে হয়েছে। যেকোনো দুর্যোগের পর (মা-বাবার খুন হওয়ার দৃশ্য যেকোনো শিশুর জন্যই একটি মহাদুর্যোগ) ভুক্তভোগী ও ঘটনা প্রত্যক্ষকারীদের মন-মস্তিষ্কে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের সেই নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকেরা কী কী মনো-সামাজিক পদক্ষেপ নিতে পারেন, কর্মশালায় সে বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করেছি। সিমু নাসের ইউনিসেফের যে গাইডলাইন উল্লেখ করেছেন, তা যথার্থ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও তেমনটি মনে করেন।
মনে রাখতে হবে, বড় দুর্যোগ বা বিপর্যয় অন্তত কিছু মানুষের মন-মস্তিষ্কে জীবনব্যাপী ‘ক্ষত’ তৈরি করে। আমরা মনোচিকিৎসকেরা এ স্মৃতিতাড়িত মানসিক রোগকে বলি পিটিএসডি। বিশেষ করে, যে মন-মস্তিষ্ক এখনো পরিণত হওয়ার পথে, যে মননভূমি এখনো কাদামাটির মতো নরম ও নাজুক প্রকৃতির, সে ক্ষেত্রে এ ছাপ, দাগ বা ক্ষত হবে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। আর তা যদি হয় নিজ জীবনের আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহ, নিরাপত্তার মূল উৎস হারানোর মাধ্যমে এবং সে হারানো যদি হয় বীভৎস, রোমহর্ষক, নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে তাহলে তা ওই শিশুর বোধ-অনুধাবন-উপলব্ধিতে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। কর্মশালায় দুর্যোগের পর মনো-সামাজিক সেবা কার্যক্রমের অনেক দিক নিয়েই আলোকপাত করা হচ্ছে।
তবে মাহিরের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য দু-একটি কথা বলতে চাই। যেকোনো বিপর্যয়, পীড়ন, চাপ সহ্য করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারার গুণকে আমরা বলি রিজিল্যান্স। বাংলাদেশের মানুষের বিপদ-বিপর্যয়ের পর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সেই অভাবিত শক্তি রয়েছে। তবে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। কেননা, চাপ-পীড়ন সহনক্ষমতা তাদের কম থাকে। এমনকি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকার শিশুদের মন থেকে ওই ভয়াবহ ঘটনার রেশ যাতে দ্রুত কেটে যায়, তার সেই শিশুদের একত্র করে খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনে নিয়োজিত করতে হবে। স্কুল-ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে বলে সেগুলোর পুনর্নির্মাণের অপেক্ষায় না থেকে, প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টা অনানুষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্দেশ্য একটিই, দুর্যোগের ভয়াবহ স্মৃতি ও এর ফল যেন মন-মেস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখতে না পারে; তারা যেন স্বাভাবিক, আনন্দময়, সৃজনশীল জগতে সক্রিয় হয়ে সুস্থ ও বিকাশমুখী জীবনধারায় ফিরে আসতে পারে। এ রকমটি যদি হয় সাধারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত শিশুদের জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা, তাহলে মাহিরের ক্ষেত্রে এ মনো-সামাজিক কার্যক্রম হতে হবে আরও নিবিড় ও সংবেদনশীল। কারণ, এ বিপর্যয় তার খুবই ব্যক্তিগত ও আবেগগত জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় নয় যে তা অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এতে কেবল শিশু মাহিরের জীবনই তছনছ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তার পাশে সহমর্মিতার হাত বাড়ানো। সে যা হারিয়েছে, তা কখনই পূরণ হবার সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা আদর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তার বেদনার ভার কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারি।
ডা. মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, মনোরোগ চিকিৎসক, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
এ বিষয়ে গত বুধবার প্রথম আলোতে একটি সংবেদনশীল ও যুক্তিপূর্ণ লেখা লিখেছেন সিমু নাসের। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের ইউনিসেফ ও এমআরডিআইয়ের প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ সপ্তাহেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক দুর্যোগ-পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি কর্মশালা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের জন্য গ্রুপভিত্তিকভাবে পর্যায়ক্রমে এ প্রশিক্ষণ কর্মশালা চলছে। কর্মশালার ‘দুর্যোগ-পরবর্তী মনো-সামাজিক সেবা’ কার্যকর্মটির ওপর সংগত কারণেই আমাকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এ বীভৎস, রোমহর্ষক ঘটনা-পরবর্তী সময়ে শিশু মাহিরের ওপর কী রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়টিও আলোচনা করতে হয়েছে। যেকোনো দুর্যোগের পর (মা-বাবার খুন হওয়ার দৃশ্য যেকোনো শিশুর জন্যই একটি মহাদুর্যোগ) ভুক্তভোগী ও ঘটনা প্রত্যক্ষকারীদের মন-মস্তিষ্কে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের সেই নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকেরা কী কী মনো-সামাজিক পদক্ষেপ নিতে পারেন, কর্মশালায় সে বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করেছি। সিমু নাসের ইউনিসেফের যে গাইডলাইন উল্লেখ করেছেন, তা যথার্থ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও তেমনটি মনে করেন।
মনে রাখতে হবে, বড় দুর্যোগ বা বিপর্যয় অন্তত কিছু মানুষের মন-মস্তিষ্কে জীবনব্যাপী ‘ক্ষত’ তৈরি করে। আমরা মনোচিকিৎসকেরা এ স্মৃতিতাড়িত মানসিক রোগকে বলি পিটিএসডি। বিশেষ করে, যে মন-মস্তিষ্ক এখনো পরিণত হওয়ার পথে, যে মননভূমি এখনো কাদামাটির মতো নরম ও নাজুক প্রকৃতির, সে ক্ষেত্রে এ ছাপ, দাগ বা ক্ষত হবে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। আর তা যদি হয় নিজ জীবনের আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহ, নিরাপত্তার মূল উৎস হারানোর মাধ্যমে এবং সে হারানো যদি হয় বীভৎস, রোমহর্ষক, নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে তাহলে তা ওই শিশুর বোধ-অনুধাবন-উপলব্ধিতে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। কর্মশালায় দুর্যোগের পর মনো-সামাজিক সেবা কার্যক্রমের অনেক দিক নিয়েই আলোকপাত করা হচ্ছে।
তবে মাহিরের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য দু-একটি কথা বলতে চাই। যেকোনো বিপর্যয়, পীড়ন, চাপ সহ্য করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারার গুণকে আমরা বলি রিজিল্যান্স। বাংলাদেশের মানুষের বিপদ-বিপর্যয়ের পর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সেই অভাবিত শক্তি রয়েছে। তবে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। কেননা, চাপ-পীড়ন সহনক্ষমতা তাদের কম থাকে। এমনকি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকার শিশুদের মন থেকে ওই ভয়াবহ ঘটনার রেশ যাতে দ্রুত কেটে যায়, তার সেই শিশুদের একত্র করে খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনে নিয়োজিত করতে হবে। স্কুল-ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে বলে সেগুলোর পুনর্নির্মাণের অপেক্ষায় না থেকে, প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টা অনানুষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্দেশ্য একটিই, দুর্যোগের ভয়াবহ স্মৃতি ও এর ফল যেন মন-মেস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখতে না পারে; তারা যেন স্বাভাবিক, আনন্দময়, সৃজনশীল জগতে সক্রিয় হয়ে সুস্থ ও বিকাশমুখী জীবনধারায় ফিরে আসতে পারে। এ রকমটি যদি হয় সাধারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত শিশুদের জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা, তাহলে মাহিরের ক্ষেত্রে এ মনো-সামাজিক কার্যক্রম হতে হবে আরও নিবিড় ও সংবেদনশীল। কারণ, এ বিপর্যয় তার খুবই ব্যক্তিগত ও আবেগগত জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় নয় যে তা অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এতে কেবল শিশু মাহিরের জীবনই তছনছ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তার পাশে সহমর্মিতার হাত বাড়ানো। সে যা হারিয়েছে, তা কখনই পূরণ হবার সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা আদর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তার বেদনার ভার কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারি।
ডা. মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, মনোরোগ চিকিৎসক, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
No comments