বহে কাল নিরবধি-বৈধতার মুখোশে দুর্নীতির বহু বিচিত্র রূপ by এম আবদুল হাফিজ

১৯৭১ সালে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম রূপে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়, আমরা কিন্তু মোটেই বিচলিত হইনি, না উৎকণ্ঠিত। কেননা দারিদ্র্য কোনো অপরাধ নয়, না কোনো স্থায়ী বাস্তবতা। কিন্তু দুর্নীতির কলঙ্ক-কালিমা অনপনেয়।// কেননা তা একটি জাতির নীতিহীনতার ইঙ্গিত বহন করে। নিরূপণ করে জাতির নৈতিকতার মান।


স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই আমাদের নৈতিকতায় যে পচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, আজ তা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মাধ্যমে। এই পরিচিতি বস্তুত ভেঙে দিয়েছে জাতির মনোবল, ধূলিসাৎ করেছে তার মর্যাদা, বিচূর্ণ হয়েছে জাতির সযত্ন লালিত স্বপ্ন। তাও আবার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্তের অভিধা একাধিকবার আমাদের ভাগ্যে জুটেছে।
তবু জীবন থেমে নেই। এমন কলঙ্ক বয়েই জাতি আজ পদার্পণ করেছে তার অস্তিত্বের চতুর্থ দশকে। সরকার এসেছে, সরকার গেছে, কিন্তু দুর্নীতির নাগপাশ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। প্রতিটি সরকারই তার স্বচ্ছতা ও সততার সাফাই গেয়েছে, অথচ প্রতিটি সরকার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি করেছে, যদিও সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্তের শিরোপাটি স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। মাত্র দুই বছর পর দেশে আবার সরকার পরিবর্তনের পালা। প্রকারান্তরে তার কাউন্টডাউন শুরুও হয়ে গেছে। সরকারি এবং বিরোধী দল ইতিমধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করেছে। শহরে-গঞ্জে শোভা পাচ্ছে 'দোয়াপ্রার্থীদের' পোস্টার ও ফেস্টুন।
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন প্রকৃতই একটি উৎসব, যখন জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এবং হতদরিদ্র ব্যক্তিটিও তখন একটি দেওয়ার অবস্থানে থাকে। তবু এসব উৎসব আয়োজন অর্থহীন লাগে এই ভেবে যে এ সব কিছু কী আমাদের অপমানের গ্লানি ঘোচাবে! নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে তো আমাদের পুরনো পরিচিত বা চেনা মুখ, যারা শুধু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নই নয়, দেশকেও দুর্নীতির অতলগহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। আমরা তো আবার ঘটা করে তাদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেব, যারা রাজনীতির নামে ৪০ বছর ধরে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। অন্তত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ দুর্নীতির একাধিক সমীক্ষক এ কথাই বলেন যে রাজনীতিক, আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরাই এ দেশে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ শ্রেণী। তাহলে তো আমরা আবার জেনেশুনে একই শ্রেণীর হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি তুলে দিতে যাচ্ছি। এতে ক্ষমতার হাতবদল হলেও হতে পারে, কিন্তু তাতে কী জাতির ভাগ্য পরিবর্তন কিঞ্চিৎ মাত্রায়ও হবে?
এমনই সব প্রাক-নির্বাচনী ভাবনা ও দেশের নষ্ট রাজনীতি নিয়ে এ দেশের মানুষ বিভ্রান্ত। ইতিমধ্যে দুর্নীতির চলমান ধারাও কিন্তু থেমে নেই। নানা রূপে, একাধিক আঙ্গিকে এবং বিচিত্র সব প্রক্রিয়ায় তা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতির কূটকৌশল এবং এর অস্বাভাবিক বিস্তার কার্যত সাধারণ মানুষের কাছে সরহফ নড়মমষরহম অর্থাৎ বোধশক্তি বিনষ্টকারী। অনেকে আজ বুঝতেও সক্ষম নয়, কোনটা দুর্নীতি এবং কোনটা দুর্নীতি নয়। আপাত বৈধতার আবরণে চলছে লুণ্ঠনের তাণ্ডব, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই মূলত সেসবের হোতা। টেন্ডার ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোকে অন্য কী নামে বোঝানো যাবে?
বিভিন্ন সরকার ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী এবং সমর্থকদের জন্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যেসব বখশিশ বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে_তাও একধরনের বৈধ বখশিশের কালচারে পরিণত হয়েছে। এবং এই কালচারের খেসারত দিতে হচ্ছে জাতিকে।
বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত একটি শ্রেণীর প্রসার ও বিস্তৃতি লক্ষণীয়। আমলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক টাউট, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, এমনকি দেশের এলিট সম্প্রদায় সরকারের অনুগ্রহভাজন এই শ্রেণীটির অন্তর্ভুক্ত। তারা তাদের ঘিরে ক্ষমতাসীনদের জন্য একধরনের অপরিহার্যতার বিশ্বাস সৃষ্টি করে রেখেছে, যার ফলে ক্ষমতার দর-দালানে তাদের অবাধ বিচরণ। সামাজিক সংযোগ, কিছুটা চালিয়াতি এবং স্তাবকতা_এ সবই তাদের ক্ষমতার বলয়ে টিকে থাকার সংশক্তি জোগায়। শুধু তা-ই নয়, এসব বৈশিষ্ট্যই বিভিন্ন সরকারের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। ফলে এরা প্রায় সব সরকারের আনুকূল্য লাভে সমর্থ হয়ে থাকে। সরকারও এসব স্তাবকের জন্য উদার। এদের জন্য বিভিন্ন পদ, পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে সরকারের কোনো ধরনের কার্পণ্য নেই। উদ্দেশ্য শুধু একটাই_এসব 'অনুগত' স্তাবকের সতত মোসাহেবির বিনিময়ে কিছু বখশিশের ব্যবস্থা করা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আমরা দেখলাম কত রকম বোর্ড, কমিটি এবং কমিশন গঠন ও পুনর্গঠন, যার মাধ্যমে সরকারের অনুগ্রহভাজনদের জন্য কিছু বখশিশের ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা_তাতে দেশ ও সর্বসাধারণের মঙ্গল নিহিত থাকুক বা না থাকুক। এমনকি বিদেশে অনর্থক ও অহেতুক দূতাবাস বা মিশন খোলা হয়েছে, তাদের কেউ কেউ সেগুলোতে নিয়োগ পেতে পারে। স্তাবকরা একটি বিশেষ সম্প্রদায় এবং তাদের টিকে থাকার শক্তি অপরিসীম।
আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার বা নিরীক্ষণের জন্য কমিটি বা কমিশন গঠনের সংবাদ। কিন্তু কস্মিনকালেও শুনি না যে ওসব পদক্ষেপ আমাদের হিতার্থে কিছু অর্জন করেছে কি না। এবং করে থাকলে তা কী? এসব কমিটি-কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের কথা ছেড়েই দিলাম। তাদের মাধ্যমে কিছু অর্জিত হোক বা না হোক, এতে কিন্তু সরকারের আসল উদ্দেশ্য অপূর্ণ থাকেনি। ইতিমধ্যে সরকার যাদের হিতার্থে ওই অঙ্গসংগঠনগুলোকে অস্তিত্বে এনেছিল, তাদের যার যা প্রাপ্য, তা কিন্তু নিখুঁতভাবে বিলি-বণ্টন হয়েছে। যথারীতি তাদের বেতন-ভাতা ও সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা ষোলো আনাই মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কমিশনপ্রধানদের মোটা বখশিশ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাউকে কাউকে দেওয়া হয়েছে মন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং সেই অনুযায়ী অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।
বিভিন্ন সময়ে সরকার সংস্কারের লক্ষ্যে প্রশাসনিক আইন, পুলিশ, ব্যাংক, বিনিয়োগ, রেডিও-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি বিষয়ে কমিশন গঠন করেছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু কমিশন তো বছরের পর বছর কাজ করে গেছে এবং সেই কমিশনগুলোর স্টাফরা নিয়মিত বেতন-ভাতা ভোগ করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা এসব কার্যক্রমের কোনো সুনিশ্চিত ফলাফল সম্পর্কে অবহিত নই। কিছু কিছু কমিশনপ্রধান ইতিমধ্যে পরিবর্তিত হয়েছেন, সম্ভবত এই কারণে যে সরকার অপেক্ষমাণ অনুগ্রহভাজনদের সরকারি অনুগ্রহের ছিটেফোঁটা দিতে চায়। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে বিদ্যমান ভাবভঙ্গিতে এ কথাই মনে হবে যে কিছু ব্যক্তিকে কিছু দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করার ছিল। এসব কমিটি-কমিশন গঠন করার পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য সেটাই। তারা সরকার বা রাষ্ট্রের কী কাজে লাগল বা লাগল না_সেটা কখনো তো বিবেচ্য বিষয় ছিল না।
কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বিনিয়োগ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সেই অবধি বিভিন্ন সরকারের ১৫ জন অনুগ্রহভাজন এ সংস্থার চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করার সুবাদে তাঁরা এই পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সুবিধা ভোগ করেছেন, আকর্ষণীয় বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। তাঁরা অবশ্য কখনোই বাংলাদেশে অবস্থিত সংস্থার তিনটি আঞ্চলিক শাখা পরিদর্শনের আকর্ষণ বোধ করেননি। যদিও তাঁদের কেউ কেউ মন্ত্রীর পদমর্যাদাও ভোগ করেছেন। তবে তা মাত্র কয়েকটি বিদেশি কম্পানিকে বোর্ডের সঙ্গে নিবন্ধিত করতে পেরেছিল। কিন্তু গত দুই যুগেও এই বোর্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অনুগ্রহভাজনদের অন্যতম আকর্ষণের স্থান বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের একটি দূতাবাস খোলা হয়েছিল বিশেষ এক ব্যক্তির চাকরি সংস্থানের জন্য। অল্প দিন সেখানে চাকরির পর সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি (একজন ব্যাংকার) অন্যত্র চলে যান। ফলে মিশনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় অর্থের শ্রাদ্ধ হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার স্পেনে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য দূতাবাস খোলে। আমরা জানি না, আওয়ামী লীগের পতনের পর সেই দূতাবাস কী ভাগ্যবরণ করেছিল। এরশাদ আমলে তাঁর সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত এক ব্রিটেনবাসী বাঙালি টনি হককে প্যারিসে রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিল। যে সরকারই এসব তুঘলকি কাজ করে থাকুক না কেন, এমন সব উদ্ভট পদক্ষেপের জন্য তারাও কম যুক্তি মজুদ করে রাখে না। তবে এসব যুক্তির অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে অসামান্য বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। ইদানীং দুর্নীতির না হলেও অনৈতিকতার আরেকটি প্রবণতা লক্ষণীয়। তা হলো, প্রশাসনের অভ্যন্তরে সরকারের সমর্থকদের সংস্থাপিত করার লক্ষ্যে বেহিসেবি এঙ্টেনশন ও প্রমোশন প্রদান এবং সহযোগী ও সমর্থকদের জন্য খয়রাতি প্রমোশন। অনুগ্রহভাজনদের জন্য ক্রমবর্ধমান বখশিশের কালচারকে হয়তো অবজ্ঞা করা যেত, যদি না এর ক্রমবর্ধমান আর্থিক বোঝা জনগণকেই বইতে না হতো। সরকারের এসব অপরিকল্পিত অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বর্ধিত পরিমাণ রাজস্বের প্রয়োজন। নানা ছুঁতো এবং ছলে রাজস্বের হার বাড়িয়ে সরকার এসব খরচ পুষিয়ে নেয়। অনুগ্রহভাজনদের জন্য সরকারের এহেন বদান্যতাকে বৈধতার একধরনের মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে এ নিয়ে জনগণ মাতামাতিতে লিপ্ত না হয়। বৈধতার মুখোশে কত বিচিত্র দুর্নীতি এ দেশে প্রচলিত, তার চূড়ান্ত ফিরিস্তি দেওয়া হয়তো কখনো সম্ভব হবে না। তবে সম্মিলিতভাবে এসব দুর্নীতি বা নীতিহীনতা আজ এক ভয়াবহ দানবে রূপান্তরিত হয়েছে_এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.