বাজেটে স্বাস্থ্য খাত এবং অন্য বিষয় by ডা. এম এ হাসান

২০১১-১২ সালের বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এই বাজেট-ভাবনা আজ শুধু সরকারের অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের রাজস্ব বিভাগ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের নয়, সচেতন জনগণকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
এ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য সংকট তথা জ্বালানি সংকটকে সামনে রেখে ঘোষিত হতে যাচ্ছে বাজেট। বাণিজ্যমন্ত্রীর অক্ষমতা,


লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ৮-১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বায়বীয় বাজার, মৃতবৎ টিসিবি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে আক্ষরিক অর্থে ওষ্ঠাগত করেছে। সীমাহীন অন্ধকারে, খরতাপে দগ্ধ হয়ে, অসহনীয় যানজটে অচল হয়ে, মানুষ যখন বিদ্যুৎ সংকট, পানি সংকট, গ্যাস সংকট ইত্যাকার সংকটে নিমজ্জিত এবং পদে পদে এক যুদ্ধক্ষেত্র অতিক্রম করছে। যাঁরা এ সরকারের শতভাগ শুভাকাঙ্ক্ষী, যাঁরা মনে করেন এ সরকার ডুবলে তাঁদের জীবনে সংকট সৃষ্টি হবে, তাঁরাও সংগত কারণেই নেতিবাচকভাবেই ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের বোধোদয় প্রয়োজন, তেমনি সরকারের জন্য প্রয়োজন ধারালো ছুরি এবং কৌটিল্যশাস্ত্রে পারদর্শী এমন শাস্ত্রী, যিনি অনাবশ্যক খরচের খাত ছেঁটে নতুন ঘোড়া এবং পারঙ্গম কর্মী নিয়োগ করতে পারবেন। সম্পূরক বাজেটের জন্য একটি বরাদ্দ ও স্থান রেখে যেতে হবে। সংকটের যথাযথ মূল্যায়ন ব্যতিরেকে উচ্চাভিলাষী বাজেট জাতির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। বর্তমানে দেশের প্রধান সংকট জ্বালানি। এ সংকট উত্তরণের জন্য দেশি ও বিদেশি উদ্যোগে তেল, গ্যাস খননকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু এ কারণে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের ব্যবস্থা করতে হবে যেকোনো গ্রহণযোগ্য শর্তে।
এ ক্ষণে কয়লাসমৃদ্ধ অঞ্চলে বিশেষ ব্যবস্থায় ত্বরিত কয়লা উত্তোলন করে এবং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যান্য শিল্প স্থাপনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা জাতির মরা-বাঁচার ব্যাপার। এ-সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। আর ইতিবাচক প্রচারে ব্যর্থতার দায় উচ্চপর্যায়ে কাউকে না কাউকে নিতেই হবে। দ্রুত কয়লা উত্তোলনের কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে কমিটি গঠন এখনই করতে হবে। এ-সংক্রান্ত ব্যয় বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এবং সিস্টেম লস হ্রাসে জার্মান সরকার অনেক আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছিল। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে এবং নানা উচ্চ প্রযুক্তিতে সাহায্য দিতে তারা আগ্রহী হয়েছিল এ সরকার আসার পরপরই। পরিকল্পনামন্ত্রী ও বৈদেশিক সাহায্য দপ্তরের (ইআরডি) অক্ষমতার কারণেই তা যথাসময়ে অগ্রসর হতে পারেনি। অনেক ভালো সাহায্য প্রস্তাব অক্ষমতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বাস্তবতার মুখ দেখেনি। এই বিকল্প বিদ্যুৎ প্রকল্পে যেমন বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন, তেমনি দেশের উন্নয়নে প্রায়োরিটি ও প্রায়োগিক বাস্তবতা মূল্যায়নে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। নির্ধারণ করা প্রয়োজন উন্নয়নের ধাপ এবং তার ব্যয়। এই জ্বালানি সমস্যা সমাধানে যথাযথ মনোযোগ প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত প্রক্ষেপণ তথা কর্ম অগ্রগতিসংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে আনতে হবে। পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ, অর্থসঞ্চালন, তার স্বচ্ছ ব্যবহার, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে জনগণকে অবগত করতে হবে। কৃষকের সমস্যা ও প্রান্তিক মানুষের জীবন বাঁচাতে যথাযথ বরাদ্দ প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণে স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন শ্রমশক্তি নির্মাণে যথাযথ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দেশের বৃহৎ এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রশিল্প বিকাশ, কৃষিবান্ধব অর্থনীতি, সাম্যভিত্তিক বাজার ও সমাজ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী এনজিওদের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে যারা উৎসাহী হবে না, তেমন এনজিওর কর্মকাণ্ড সীমিত করে আনতে হবে। এ ছাড়া পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিচারব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়ার জন্য সামাজিক সমঝোতামূলক বিচার তৃণমূল পর্যায়ে নিতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকারকে যেমন শক্তিশালী করতে হবে, তেমনি ইউনিয়ন পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, সামাজিক বাজার এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। ব্যয় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি দমনে জনগণের সম্পৃক্ত করতে হবে। এ-সংক্রান্ত আইনি জটিলতা ও বিরোধ পঞ্চায়েত পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই গ্রাম্য পঞ্চায়েত ও সালিসব্যবস্থার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যাঁরা ফিরছেন বা যাঁরা শেয়ারবাজারে নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের সংকট উত্তরণের একটি প্রেসক্রিপশন থাকা প্রয়োজন এ বাজেটে। সমাজ বাজারে অংশীদারি বা সমবায় ব্যাংক এর একটা সমাধান হতে পারে। আকর্ষণীয় সুদে সরকারি বন্ডের সঞ্চালন, বিনিয়োগকারীদের জন্য শর্তসাপেক্ষ ইনস্যুরেন্স প্রথা প্রচলন, এঙ্প্যাট্রিয়েট ব্যাংক ও ইনসু্যুরেন্স সময়ের দাবি। বাজেট-ভাবনায় এসব বিষয় অন্তর্গত হওয়া প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপটে ১৬ কোটি মানুষের দেশে নানা সংকট নিরসনের সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানীয়জল, সেচের জল নিশ্চিত করতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। একই সঙ্গে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগসহ সারফেস ওয়াটার সংরক্ষণ ও পরিশোধনের ওপর যথাযথ মনোযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে দুই কোটি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের জীবনের স্বার্থে এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সিলেট-ময়মনসিংহের হাওর ও নদী খননসহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সর্বাত্মক চেষ্টা নিতে হবে। নদীদূষণসহ শিল্পবর্জ্য শোধনের ব্যর্থতা জাতিকে আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়াম পারদসহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী অ্যানিলিন ডাই ও পেস্টিসাইড-সংক্রান্ত মৃত্যুফাঁদে ঠেলে দিচ্ছে। এ-সংক্রান্ত নিষ্ক্রিয়তা বা দুর্বল পদক্ষেপ 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' সেবাকে প্রহসনমূলক উদ্যোগ হিসেবে প্রমাণিত করবে। যে সাম্যভিত্তিক সমাজ এবং মানব মর্যাদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ ছিল, তার সফল বাস্তবায়ন চায় এ দেশের মানুষ।

লেখক : সভাপতি ও প্রধান বৈজ্ঞানিক, অ্যালার্জি, অ্যাজমা অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্ট কমিটি

No comments

Powered by Blogger.