সময়চিত্র-তিস্তা চুক্তি: বাংলাদেশ কী পাচ্ছে? by আসিফ নজরুল
তিস্তা এই অঞ্চলের একটি নয়নাভিরাম নদী। রাষ্ট্রীয় সীমানা এই অসম্ভব সুন্দর নদীকে তিক্ত বিরোধের বিষয় করে তুলেছে। গঙ্গা বা সিন্ধু নদীর পানি ভাগাভাগির জটিলতার জন্য আমরা ব্রিটিশদের ত্রুটিপূর্ণ দেশভাগের সীমানাকে দায়ী করে থাকি। এর কিছুটা সত্যতা রয়েছে। কিন্তু তিস্তার ক্ষেত্রে তা বলার উপায় নেই।
তিস্তার পানি ভাগাভাগি গত প্রায় ৬০ বছরের আলোচনার পরও সম্পন্ন হয়নি, তার দায় শুধুই ভারত ও বাংলাদেশের।
আমরা শুনছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তিস্তা ছাড়াও ফেনী নদী নিয়ে একটি চুক্তি হবে। এসব নদীর পানি ঠিক কীভাবে ভাগাভাগি হচ্ছে, তা এখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। সংসদ, বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার বা তাদের তথ্য জানানোরও কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। এমনকি বাংলাদেশের পক্ষে এ নিয়ে আলোচনায় সম্পৃক্ত নেই পররাষ্ট্র বা পানিসম্পদমন্ত্রী! অন্য সব দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে পানি নিয়ে আলোচনাও করছেন এমন দুজন উপদেষ্টা, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি নন, পানিসম্পদ বিষয়ে যাঁদের কোনো ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানও সম্ভবত নেই।
তথ্যের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওপর। ভারতের রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকেরা এ নিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের কোনো কোনো বক্তব্যে আসন্ন তিস্তা চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। ফেনী নদীর বিষয়ে তথ্য আরও অস্পষ্ট।
২.
আগেই বলে রাখি, নদীর পানি আসলে ভাগাভাগির বিষয় নয়। পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো নদীর পানি ভাগাভাগি করে না, করে নদীর অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ও সমন্বিত ব্যবহার, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ। গত ২০ বছরে পূর্ব ইউরোপ (যেমন: সাভা নদী), আফ্রিকা (লেক ভিক্টোরিয়া ও জাম্বেসি নদী), দক্ষিণ আমেরিকা (পানতানাল ও প্যারাগুয়ে নদী) এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (মিকং নদী) অনুন্নত দেশগুলোও তা-ই করেছে। করেছে যে তার কারণ, এভাবে ব্যবহার করলেই কেবল নদীর অববাহিকার সব দেশের পক্ষে সমভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব, পরিবেশ ও নদীর জীবনীশক্তিও রক্ষা করা সম্ভব।
এমন উদাহরণ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নেই। স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে অর্ধেকের বেশি সময় বাংলাদেশে ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু অববাহিকাভিত্তিক সমন্বিত ব্যবহার দূরের কথা, ভারতের সঙ্গে গঙ্গা বাদে বাকি প্রায় অর্ধশত অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগিরই কোনো সুরাহা হয়নি। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদী চুক্তিতে বলা আছে কেবল ফারাক্কা পয়েন্টে কল্পিত পানির পরিমাণের অনুমানভিত্তিক ভাগাভাগির কথা। এই চুক্তির কিছু শর্ত ভারত পালন করেনি, এ নিয়ে কার্যকর প্রতিবাদ করার মতো শক্তি বাংলাদেশের সরকারগুলোর ছিল না, এখনো নেই। এর অন্যতম কারণ, দেশের স্বার্থ-সম্পর্কিত ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারগুলোর সীমাহীন অনীহা বা ব্যর্থতা।
তা ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে অনেক। দুই দেশ কৃষির জন্য অনেকাংশে নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল, দুই দেশের সেচের জন্য নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হতদরিদ্র, দুই দেশেই শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে নদীর পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু কেউ যথেষ্টভাবে অন্যের প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করেনি। নদী নিয়ে আলোচনার প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ তাই অভিন্ন নদীর প্রায় সবটুকু পানি দাবি করে বসেছে। অভিন্ন সব বড় নদীর উজানের দেশ হওয়ায় ভারত তার দাবি অনেকাংশে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। অনন্যোপায় বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতের সদিচ্ছা, বন্ধুত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর। সমস্যা হচ্ছে, এই আইনের কথা চীন বা পাকিস্তানের সঙ্গে দর-কষাকষির সময় ভারত বলে থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না অনেক সময়।
১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদী চুক্তিতে আন্তর্জাতিক নদী আইনের উল্লেখ নেই, তবে এর দুটো প্রতিষ্ঠিত নীতির কথা বলা হয়েছে। ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার (ইক্যুইটেবল ইউটিলাইজেশন) এবং কারও ক্ষতি নয় (নো-হার্ম) নীতির ভিত্তিতে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি হয়েছে বলা হলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট ন্যায়সংগত হয়নি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতিও এতে মোচন হয়নি। এর বড় প্রমাণ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মার শুকনো জমি, আর গড়াই নদীর মৃত্যুদশার কোনো পরিবর্তন হয়নি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও।
তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি নিয়ে তাই বাংলাদেশের মানুষের মনে সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। এ বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলের যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ যথেষ্টভাবে রক্ষিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশের কারণ রয়েছে।
৩.
তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবা এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা (দালিয়া) ব্যারাজ নির্মাণ করেছে বহু বছর আগে। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারাজ ও সেচ-খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশের ব্যারাজটি শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। তাই দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য-দশা ঘোচানোর একটি বড় শর্ত হচ্ছে তিস্তায় ন্যায্য পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার পরপর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কীভাবে ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এই আলোচনা কখনো আর সুসম্পন্ন হয়নি। ১৯৮৬ সালে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা প্রদান করে। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদীর ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের বক্তব্য অনুসারে, নদীর নাব্যতার জন্য ১০ শতাংশ পানি রেখে দেওয়াই যথেষ্ট হবে। ভারতের কোনো কোনো মহল থেকে এ সময় ভারতের অধিক পরিমাণ কৃষিভূমি ইতিমধ্যে সেচ-সুবিধা ব্যবহার করছে—এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করে বসে।
ভারতের এই উদ্বেগজনক দাবি যে এখনো বহাল আছে, তার নমুনা আমরা পাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কংগ্রেসদলীয় সাংসদ ১ সেপ্টেম্বর বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি পেলেও তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত পাবে ৭৫ শতাংশ! তাঁর বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশ পানি পাবে বাকি মাত্র ২৫ শতাংশ। ভারতের পক্ষে আলোচনাকারী দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন তাঁকে এ তথ্য দিয়েছেন বলে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন। এই উদ্বেগজনক তথ্যের কোনো প্রতিবাদ এখনো বাংলাদেশ করেনি, ঈদের ছুটির আলস্যে কি না জানি না, এ নিয়ে গণমাধ্যমকেও তেমন বিচলিত মনে হচ্ছে না।
৪.
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, তিস্তা নদীতে ঐতিহাসিকভাবে শুকনো মৌসুমে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। আমি মনে করি, এর ন্যূনতম ৫০ শতাংশ অর্থাৎ সাত হাজার কিউসেকের কম পানি পেলে তা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হবে। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বাংলাদেশের সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সেচযোগ্য জমির প্রায় সমান। অথচ উজানের দেশ হওয়ার সুযোগে আগেই তিস্তার পানি সরিয়ে ফেলায় পশ্চিমবঙ্গ সেচ-সুবিধা পায় বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি জমিতে। সেচ লক্ষ্যমাত্রার নয় লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমির অর্ধেকেরও বেশি (৫ লাখ ২৭ হাজার) ইতিমধ্যে সেচ-সুবিধা পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সেচ লক্ষ্যমাত্রা যেখানে সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি, সেখানে ভারতের উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে বর্তমানে সেচ-সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে মাত্র এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে। চুক্তি করে আরও কম পানি পেলে উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ আর প্রাণবৈচিত্র্যের কী অবস্থা দাঁড়াবে?
আমার ধারণা, তিস্তায় বেশি পানি দাবি করার ক্ষেত্রে ভারত এর পানির বর্তমান ব্যবহারকে (এগিজস্টিং ইউটিলাইজেশন) যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছে। অতীতে বহুবার ভারত এই দাবি করেছে। এটি অত্যন্ত অসংগত এ কারণে যে উজানের দেশ হওয়ায় ভারত একতরফাভাবে বেশি পানি ব্যবহার করার ভৌগোলিক সুযোগ পেয়ে প্রথমেই বাংলাদেশকে পানি ব্যবহারের সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত করে ফেলে। এই বঞ্চনা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়, ফলে এটি নদীর পানি ভাগাভাগির ভিত্তি হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায়পরায়ণ ব্যবহারের নীতি অনুসারে তাই অববাহিকার দেশগুলোকে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য ব্যবহারের (পোটেনশিয়াল ইউটিলাইজেশন) হিসাবও বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশের যে পরিমাণ জমিকে সেচ-সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছিল, তাতে সেচ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে বিবেচনায় নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ তো প্রশ্নই আসে না, তিস্তার ৫০ শতাংশ পানি পেলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট হবে না।
মনে রাখতে হবে, চুক্তি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা পয়েন্টে অবস্থিত পানির ভাগাভাগির। আরও উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিম, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হচ্ছে, সেখান থেকে ভারত কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করছে, তা দুই দেশের আলোচনায় আনাই সম্ভব হয়নি। শুধু গজলডোবায় পাওয়া পানির ভাগাভাগিতেই যদি বাংলাদেশ কম পানি পায়, তাহলে তা কীভাবে ন্যায়পরায়ণ নীতি হবে? কীভাবে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো যাবে?
৫.
তিস্তার পানি ব্যবহারের অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, ভারতেরও রয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি কমে যায় বলে দুই পক্ষকেই উদারতা ও সহমর্মিতা দেখাতে হবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু পশ্চিমবঙ্গে সেচকাজে ব্যবহূত জমির হিসাবেই ভারত তিস্তার পানির অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে বহু বছর ধরে। দুই দেশের তুলনামূলক সুবিধা ভোগের চরম অসাম্য তাই দূর করতে হবে, অন্যথায় তিস্তা চুক্তি কখনোই বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারবে না।
তিস্তার যেটুকু তথ্য আমরা পাচ্ছি, ফেনী নদীর ক্ষেত্রে সেটিও পাওয়া যাচ্ছে না। আরও অনালোচিত এই নদীর পানি ভাগাভাগিতে আরও অসাম্য থাকতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। এই আশঙ্কা সত্যি হলে বহু কিছু একতরফাভাবে প্রদান করে বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেল, এমন পরিতাপ ও ক্ষোভ বাড়বে দেশে। আমরা কখনোই তা প্রত্যাশা করি না।
ড. আসিফ নজরুল: আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।
আমরা শুনছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তিস্তা ছাড়াও ফেনী নদী নিয়ে একটি চুক্তি হবে। এসব নদীর পানি ঠিক কীভাবে ভাগাভাগি হচ্ছে, তা এখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। সংসদ, বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার বা তাদের তথ্য জানানোরও কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। এমনকি বাংলাদেশের পক্ষে এ নিয়ে আলোচনায় সম্পৃক্ত নেই পররাষ্ট্র বা পানিসম্পদমন্ত্রী! অন্য সব দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে পানি নিয়ে আলোচনাও করছেন এমন দুজন উপদেষ্টা, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি নন, পানিসম্পদ বিষয়ে যাঁদের কোনো ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানও সম্ভবত নেই।
তথ্যের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওপর। ভারতের রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকেরা এ নিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের কোনো কোনো বক্তব্যে আসন্ন তিস্তা চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। ফেনী নদীর বিষয়ে তথ্য আরও অস্পষ্ট।
২.
আগেই বলে রাখি, নদীর পানি আসলে ভাগাভাগির বিষয় নয়। পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো নদীর পানি ভাগাভাগি করে না, করে নদীর অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ও সমন্বিত ব্যবহার, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ। গত ২০ বছরে পূর্ব ইউরোপ (যেমন: সাভা নদী), আফ্রিকা (লেক ভিক্টোরিয়া ও জাম্বেসি নদী), দক্ষিণ আমেরিকা (পানতানাল ও প্যারাগুয়ে নদী) এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (মিকং নদী) অনুন্নত দেশগুলোও তা-ই করেছে। করেছে যে তার কারণ, এভাবে ব্যবহার করলেই কেবল নদীর অববাহিকার সব দেশের পক্ষে সমভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব, পরিবেশ ও নদীর জীবনীশক্তিও রক্ষা করা সম্ভব।
এমন উদাহরণ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নেই। স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে অর্ধেকের বেশি সময় বাংলাদেশে ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু অববাহিকাভিত্তিক সমন্বিত ব্যবহার দূরের কথা, ভারতের সঙ্গে গঙ্গা বাদে বাকি প্রায় অর্ধশত অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগিরই কোনো সুরাহা হয়নি। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদী চুক্তিতে বলা আছে কেবল ফারাক্কা পয়েন্টে কল্পিত পানির পরিমাণের অনুমানভিত্তিক ভাগাভাগির কথা। এই চুক্তির কিছু শর্ত ভারত পালন করেনি, এ নিয়ে কার্যকর প্রতিবাদ করার মতো শক্তি বাংলাদেশের সরকারগুলোর ছিল না, এখনো নেই। এর অন্যতম কারণ, দেশের স্বার্থ-সম্পর্কিত ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারগুলোর সীমাহীন অনীহা বা ব্যর্থতা।
তা ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে অনেক। দুই দেশ কৃষির জন্য অনেকাংশে নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল, দুই দেশের সেচের জন্য নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হতদরিদ্র, দুই দেশেই শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে নদীর পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু কেউ যথেষ্টভাবে অন্যের প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করেনি। নদী নিয়ে আলোচনার প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ তাই অভিন্ন নদীর প্রায় সবটুকু পানি দাবি করে বসেছে। অভিন্ন সব বড় নদীর উজানের দেশ হওয়ায় ভারত তার দাবি অনেকাংশে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। অনন্যোপায় বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতের সদিচ্ছা, বন্ধুত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর। সমস্যা হচ্ছে, এই আইনের কথা চীন বা পাকিস্তানের সঙ্গে দর-কষাকষির সময় ভারত বলে থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না অনেক সময়।
১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদী চুক্তিতে আন্তর্জাতিক নদী আইনের উল্লেখ নেই, তবে এর দুটো প্রতিষ্ঠিত নীতির কথা বলা হয়েছে। ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার (ইক্যুইটেবল ইউটিলাইজেশন) এবং কারও ক্ষতি নয় (নো-হার্ম) নীতির ভিত্তিতে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি হয়েছে বলা হলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট ন্যায়সংগত হয়নি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতিও এতে মোচন হয়নি। এর বড় প্রমাণ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মার শুকনো জমি, আর গড়াই নদীর মৃত্যুদশার কোনো পরিবর্তন হয়নি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও।
তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি নিয়ে তাই বাংলাদেশের মানুষের মনে সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। এ বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলের যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ যথেষ্টভাবে রক্ষিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশের কারণ রয়েছে।
৩.
তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবা এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা (দালিয়া) ব্যারাজ নির্মাণ করেছে বহু বছর আগে। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারাজ ও সেচ-খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশের ব্যারাজটি শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। তাই দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য-দশা ঘোচানোর একটি বড় শর্ত হচ্ছে তিস্তায় ন্যায্য পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার পরপর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কীভাবে ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এই আলোচনা কখনো আর সুসম্পন্ন হয়নি। ১৯৮৬ সালে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা প্রদান করে। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদীর ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের বক্তব্য অনুসারে, নদীর নাব্যতার জন্য ১০ শতাংশ পানি রেখে দেওয়াই যথেষ্ট হবে। ভারতের কোনো কোনো মহল থেকে এ সময় ভারতের অধিক পরিমাণ কৃষিভূমি ইতিমধ্যে সেচ-সুবিধা ব্যবহার করছে—এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করে বসে।
ভারতের এই উদ্বেগজনক দাবি যে এখনো বহাল আছে, তার নমুনা আমরা পাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কংগ্রেসদলীয় সাংসদ ১ সেপ্টেম্বর বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি পেলেও তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত পাবে ৭৫ শতাংশ! তাঁর বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশ পানি পাবে বাকি মাত্র ২৫ শতাংশ। ভারতের পক্ষে আলোচনাকারী দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন তাঁকে এ তথ্য দিয়েছেন বলে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন। এই উদ্বেগজনক তথ্যের কোনো প্রতিবাদ এখনো বাংলাদেশ করেনি, ঈদের ছুটির আলস্যে কি না জানি না, এ নিয়ে গণমাধ্যমকেও তেমন বিচলিত মনে হচ্ছে না।
৪.
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, তিস্তা নদীতে ঐতিহাসিকভাবে শুকনো মৌসুমে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। আমি মনে করি, এর ন্যূনতম ৫০ শতাংশ অর্থাৎ সাত হাজার কিউসেকের কম পানি পেলে তা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হবে। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বাংলাদেশের সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সেচযোগ্য জমির প্রায় সমান। অথচ উজানের দেশ হওয়ার সুযোগে আগেই তিস্তার পানি সরিয়ে ফেলায় পশ্চিমবঙ্গ সেচ-সুবিধা পায় বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি জমিতে। সেচ লক্ষ্যমাত্রার নয় লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমির অর্ধেকেরও বেশি (৫ লাখ ২৭ হাজার) ইতিমধ্যে সেচ-সুবিধা পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সেচ লক্ষ্যমাত্রা যেখানে সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি, সেখানে ভারতের উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে বর্তমানে সেচ-সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে মাত্র এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে। চুক্তি করে আরও কম পানি পেলে উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ আর প্রাণবৈচিত্র্যের কী অবস্থা দাঁড়াবে?
আমার ধারণা, তিস্তায় বেশি পানি দাবি করার ক্ষেত্রে ভারত এর পানির বর্তমান ব্যবহারকে (এগিজস্টিং ইউটিলাইজেশন) যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছে। অতীতে বহুবার ভারত এই দাবি করেছে। এটি অত্যন্ত অসংগত এ কারণে যে উজানের দেশ হওয়ায় ভারত একতরফাভাবে বেশি পানি ব্যবহার করার ভৌগোলিক সুযোগ পেয়ে প্রথমেই বাংলাদেশকে পানি ব্যবহারের সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত করে ফেলে। এই বঞ্চনা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়, ফলে এটি নদীর পানি ভাগাভাগির ভিত্তি হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায়পরায়ণ ব্যবহারের নীতি অনুসারে তাই অববাহিকার দেশগুলোকে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য ব্যবহারের (পোটেনশিয়াল ইউটিলাইজেশন) হিসাবও বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশের যে পরিমাণ জমিকে সেচ-সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছিল, তাতে সেচ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে বিবেচনায় নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ তো প্রশ্নই আসে না, তিস্তার ৫০ শতাংশ পানি পেলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট হবে না।
মনে রাখতে হবে, চুক্তি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা পয়েন্টে অবস্থিত পানির ভাগাভাগির। আরও উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিম, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হচ্ছে, সেখান থেকে ভারত কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করছে, তা দুই দেশের আলোচনায় আনাই সম্ভব হয়নি। শুধু গজলডোবায় পাওয়া পানির ভাগাভাগিতেই যদি বাংলাদেশ কম পানি পায়, তাহলে তা কীভাবে ন্যায়পরায়ণ নীতি হবে? কীভাবে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো যাবে?
৫.
তিস্তার পানি ব্যবহারের অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, ভারতেরও রয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি কমে যায় বলে দুই পক্ষকেই উদারতা ও সহমর্মিতা দেখাতে হবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু পশ্চিমবঙ্গে সেচকাজে ব্যবহূত জমির হিসাবেই ভারত তিস্তার পানির অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে বহু বছর ধরে। দুই দেশের তুলনামূলক সুবিধা ভোগের চরম অসাম্য তাই দূর করতে হবে, অন্যথায় তিস্তা চুক্তি কখনোই বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারবে না।
তিস্তার যেটুকু তথ্য আমরা পাচ্ছি, ফেনী নদীর ক্ষেত্রে সেটিও পাওয়া যাচ্ছে না। আরও অনালোচিত এই নদীর পানি ভাগাভাগিতে আরও অসাম্য থাকতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। এই আশঙ্কা সত্যি হলে বহু কিছু একতরফাভাবে প্রদান করে বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেল, এমন পরিতাপ ও ক্ষোভ বাড়বে দেশে। আমরা কখনোই তা প্রত্যাশা করি না।
ড. আসিফ নজরুল: আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।
No comments