সময়চিত্র-সীমান্তে গুলি, নির্বিকার সরকার by আসিফ নজরুল

নতুন বছরে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর মন্তব্য হতভম্ব করে দেয় বহু মানুষকে। সীমান্তে বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং এক যুবককে নগ্ন করে বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ তখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। মন্ত্রী এমন এক সময় বললেন: রাষ্ট্র এটি নিয়ে চিন্তিত নয়।


অন্য দেশের বাহিনী কর্তৃক নিজ দেশের মানুষের হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত বা সমর্থন করার এই নজির স্বাধীন বাংলাদেশে আর নেই। তাঁর এ বক্তব্য আকস্মিক বা নিয়তিবাদী আত্মসমর্পণ হিসেবে আমরা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। প্রথমত, তাঁর এ বক্তব্য বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। এর আগে ২০১০ সালের মে মাসে তৎকালীন বিডিআর-প্রধান সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলেছিলেন যে: ‘এসব নিয়ে চিন্তিত হওয়া ঠিক হবে না। আমরা বিষয়টি আলোচনা করছি এবং আমরা এটি নিশ্চিত করব যে কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে না।’ হিউম্যন রাইটস ওয়াচের বিশ্লেষণ অনুসারে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এই উক্তির মাধ্যমে মেনে নিয়েছিলেন যে সীমান্তে ‘অপরাধী’ বাংলাদেশিদের গুলি করে মেরে ফেলা যাবে! সীমান্তে এর পরও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, গুলি খেয়ে মরেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থানরত নিরপরাধ মানুষও। ৯ ফেব্রুয়ারি বিএসএফ-প্রধান এও জানিয়ে দিলেন যে সীমান্তে গুলি ভবিষ্যতেও হবে।
এসব বক্তব্যের মধ্যে শ্রুতিমধুর কিছু কথাবার্তা হয়েছে। দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে—এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার না করে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে, এমন কথা শোনা গেছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো মন্ত্রণালয় থেকে কখনো ম্রিয়মাণ, কখনো কিছুটা কড়া প্রতিবাদ করা হয়েছে। বিএসএফ-প্রধানের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন বিজিবি-প্রধান। কিন্তু আমরা দেখেছি এসব প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়, এসব প্রতিবাদে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে আমাদের বলেছিলেন যে তিনি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে সীমান্তে আর গুলিবর্ষণ করা হবে না। এই প্রতিশ্রুতির পরও নিয়মিতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করা হয়েছে।
সরকারের কার্যক্রম ও বক্তব্যে মনে হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা খুব একটা বিচলিত নয়, বিচলিত হলেও তাদের আসলে করার কিছু নেই, ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ সব কর্মকান্ড মেনে নিতে হবে বাংলাদেশকে। মাত্র ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বললেন, সীমান্তের ঘটনাবলি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমরা জানি পৃথিবীতে বহু দেশে এ ধরনের ঘটনায় আন্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ফাটল ধরে। এই সেদিন তুরস্কের ত্রাণবাহী জাহাজে হামলাতে কয়েকজন নাগরিক নিহত হওয়ায় তুরস্ক তার দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রায় সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। অথচ বিএসএফের অব্যাহত হত্যাকাণ্ডগুলো দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর—এই সামান্য কথাও বর্তমান সরকার বলতে পারছে না!
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে দুই রাষ্ট্রের যুক্ত ইশতেহারে বরং বলা হয়েছিল যে সীমান্তে উভয় পক্ষ এখন থেকে সংযতভাবে দায়িত্ব পালন করবে। যুক্ত ইশতেহারের কথা শুনে মনে হতে পারে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুই দেশ সমভাবে ঘটিয়ে চলেছে এবং তাই দুই দেশেরই সংযত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে কখনো কখনো মারা যায় সীমান্তবর্তী এলাকার ভারতের কিছু নাগরিকও। সেখানে তবু এর বিরুদ্ধে ভারতীয় পুলিশ আর আদালতের কাছে যাওয়া যায়, বাংলাদেশের হতভাগা মানুষের সেই সুযোগও নেই।

২.
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এবং পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংস্থা ‘মাসুম’-এর ‘ট্রিগার হ্যাপি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে গত ১০ বছরে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী বা তাদের মদদে ভারতীয় নাগরিকদের হাতে খুন হয়েছে এক হাজারের বেশি মানুষ (অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১০০ জন)। বিএসএফ এই সংখ্যা সব সময় কমিয়ে বলে, কিন্তু নিয়মিতভাবে যে তাদের গুলিতে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এটি তারা অস্বীকার করতে পারেনি কখনো। অধিকারের প্রধান অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান এ বছর ১৯ জানুয়ারি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে তাই পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তরঞ্জিত সীমান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অ্যাডভোকেট আদিলুরের বক্তব্য অতিশয়োক্তি নয়। ইউনাইটেড স্টেটস বর্ডার পেট্রোলের হিসাব অনুসারে প্রতিবছর গড়ে মেক্সিকো-আমেরিকা বর্ডারে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এর অধিকাংশই মারা যায় অবৈধভাবে দুর্গম সীমান্ত অতিক্রমকালে নদীতে ডুবে, গাড়ি দুর্ঘটনায় বা মাদক চোরাচালানি চক্রের সঙ্গে গোলাগুলিতে। কিন্তু মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে মেক্সিকোর নিরস্ত্র মানুষ গুলি খেয়ে মরছে, এ ঘটনা খুব বিরল এবং এমন ঘটনা ঘটলে বিচারিক তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র।
পৃথিবীর আরেকটি রক্তরঞ্জিত সীমান্ত ফিলিস্তিন-ইসরায়েল। ইসরায়েলি ‘সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ইন দ্য অকুপাইড টেরিটোরি’র হিসাব অনুসারে, গত ১০ বছরে (২০০০-২০১০) ৬৫৩৭ জন ফিলিস্তিনি এবং ১০৯২ ইসরায়েলি মারা গেছে প্রতিপক্ষের হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মৃত্যু ঘটেছে দুই যুদ্ধরত পক্ষের গোলাগুলিতে বা প্রতিশোধমূলক হামলায়। অন্যদিকে গত ১০ বছরে ইসরায়েলের মাটিতে বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সীমান্তে হত্যা করা হয়েছে ৭২ জন ফিলিস্তিনিকে (প্রতিবছর সাত জন)। আরও যা লক্ষণীয়, মেক্সিকো-আমেরিকা বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সীমান্তে মারা যায় দুই পক্ষেরই মানুষ। যেমন: মেক্সিকোর মাদক পাচারকারী চক্র ও অবৈধ অনুপ্রেবেশকারী চক্রের হাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় অর্ধশত আমেরিকান সীমান্তরক্ষী।
অন্যদিকে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন বিএসএফ ভারতীয় পুলিশকে দিয়েছে তার একটিতেও খুন হওয়া কোনো বাংলাদেশির কাছ থেকে মারাত্মক বা প্রাণঘাতী অস্ত্র উদ্ধারের বিবরণ নেই। এর সোজা মানে হচ্ছে, বিএসএফ হত্যা করছে স্রেফ নিরস্ত্র মানুষকে বা এমন মানুষকে যে বিএসএফের কারও জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি।

৩.
বিএসএফের এ হত্যাযজ্ঞ নেই এমনকি ভারতের শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান বা চীন সীমান্তে। হত্যার শিকার হয় শুধু বাংলাদেশের মানুষ। এর কারণ কী? তেমন কোনো প্রতিবাদ হয় না বলে? বিএনপি আমলে এবং ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিবাদ হতো কিছুটা জোরালো ভাষায়, কিন্তু তা কখনো যথেষ্ট মাত্রায় নয়। বর্তমান সরকারের আমলেও কখনো কখনো প্রতিবাদ হয়, কিন্তু তা অর্থহীন হয়ে ওঠে হত্যাযজ্ঞের প্রতি সরকারের কারও কারও সমর্থনে। এই সরকারের আমলে বরং বিএসএফ বাহিনীর রাষ্ট্রের পণ্য পরিবহনের জন্য নদীর বুকে রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়, নদীর পানি বা ছিটমহল না দিলেও চলে বন্ধুত্বের বন্দনা, ট্রানজিটের বিনিময়ে মাশুল চাওয়ার কথা বললে প্রতাপশালী উপদেষ্টা ধমকে ওঠেন ‘অসভ্যতার’ জন্য, টিপাইমুখের পক্ষে প্রচারণায় নেমে ক্ষমতা বাড়ে উপদেষ্টা-মন্ত্রীর, চাকরির মেয়াদ বাড়ে আমলাদের।
বিএসএফ বা ভারতের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। তাদের দাবি: সীমান্তে গুলি করা হয় গরু ও পণ্য চোরাকারবারিদের, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের। বিএসএফের এ বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়। একাধিক ঘটনায় তাদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা মানুষ। অবৈধ প্রবেশকারী ও পণ্য চোরাকারবারিরা অপরাধী, তাদের গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তারের জন্য প্রয়োজন হলে যুক্তিসংগত মাত্রায় শক্তিপ্রয়োগের অধিকার বিএসএফের রয়েছে। কিন্তু তাই বলে তাদের বিনা সতর্ক সংকেতে বা অযৌক্তিক মাত্রায় শক্তি প্রয়োগ করে হত্যা করার কোনো অধিকার বিএসএফের নেই। আজ পর্যন্ত বিএসএফের কেউ বাংলাদেশের চোরাকারবারির গুলিতে মারা যায়নি, কিংবা বিএসএফ নিহত বা ধৃত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র উদ্ধারের কথাও বলতে পারেনি। এসব প্রমাণ করে যে আত্মরক্ষামূলকভাবে বা সমানুপাতিক বল প্রয়োগ করে তারা হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে না। কিশোরী ফালানীসহ আরও কিছু হত্যাকাণ্ড বরং এই ধারণা দেয় যে বাংলাদেশ সীমান্তে দেখামাত্র গুলি করার ভয়ংকর নীতি রয়েছে তাদের।
সীমান্তে বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য প্রযোজ্য বহু আন্তর্জাতিক চুক্তি (যেমন: ১৯৬৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল ও পলিটিক্যাল রাইটস, ১৯৮৪ সালের কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার) এবং নীতিমালা অনুসারে (যেমন বেসিক প্রিন্সিপ্যাল ফর দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ার আর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিশিয়ালস) এভাবে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হত্যা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। রোম স্ট্যাটিউট অনুসারে ‘সিস্টেমেটিক’ ও ‘ওয়াইডস্প্র্রেড’ হিসেবে এসব হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক আমলে নেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ বলেও বিবেচিত হতে পারে।

৪.
ভারতকে কে বলবে এসব কথা? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিযোগ তোলা দূরে থাক, জোরালো প্রতিবাদ জানানোর ক্ষমতা কি আছে বাংলাদেশের কোন সরকারের? আগের অন্য সরকারগুলোর তুলনায় বর্তমান সরকারের পক্ষে আরও বহুভাবে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। ভারতের জন্য তুলনামূলকভাবে বহুগুণ অনুকূল যে চুক্তিগুলো এই সরকারের আমলে সম্পাদিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে অনীহা দেখিয়ে সরকার সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ভারত কোনো চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি না মানলে এটি করার অধিকার অবশ্যই বাংলাদেশের রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রয়োজনে এমন দৃঢ় দেশপ্রেমিক অবস্থান আশা করে মানুষ। ভারতকে তাদের দাবিমতো সবকিছু প্রদান করার পরও সীমান্ত হত্যা কেন তার সরকার বন্ধ করতে পারছে না বা বাংলাদেশের বহু ন্যায্য অধিকার কেন আদায় করা যাচ্ছে না, এর সদুত্তর পাওয়ার অধিকারও রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের।

 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.