সময়ের প্রতিধ্বনি-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখা প্রয়োজন by মোস্তফা কামাল
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাসদরে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের বসার ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছিল, তাঁরা যেন কথাবার্তা বলার সুযোগ পান।
দুই নেত্রী যাতে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করেন সে জন্য তখন দুজন উপদেষ্টা বেশ সক্রিয় ছিলেন। গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যেও ছিল টান টান উত্তেজনা এবং এক ধরনের উচ্ছ্বাসও। ফটোসাংবাদিকরা দুই নেত্রীর ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সুবাদে আমরা পুরো অনুষ্ঠানটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেশের কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল দুই নেত্রীর দিকে। তাঁরা কী কথা বলেন, কী নিয়ে আলোচনা করেন তা জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন।
দুই নেত্রীর কুশলবিনিময়ের পর থেকেই সারা দেশের, এমনকি বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তখনই টের পেলাম সব মানুষই দুই নেত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক দেখতে চান। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি অথবা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং আপামর জনসাধারণ দুই নেত্রীর ভালো সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। দুই নেত্রীর আনন্দে তাঁরা আনন্দিত হন। আমরা মিডিয়ার লোকরাও দুই নেত্রীর ঐক্য চাই। দেশের স্বার্থেই দুই নেত্রীর ঐক্য ও সমঝোতার রাজনীতি দেখতে চাই। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আমরা জানি, সারা দেশে দুই নেত্রীর কোটি কোটি ভক্ত। তাঁরা যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন তাঁদের ভক্ত থাকবে। তাঁরা যদি রাজনীতি ছেড়েও দেন, তার পরও থাকবে। তাঁদের হাত ধরে উত্তরসূরি যাঁরাই আসবেন তাঁরাও ব্যাপক জনপ্রিয় ওঠে উঠবেন। ঘুরেফিরে তাঁদের প্রজন্মই ক্ষমতায় বসবেন। কাজেই তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে। এটা না হলে আবারও তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটবে। সেটা হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুই পরিবারের যে প্রভাব তা আর থাকবে না। উত্তরাধিকার রাজনীতিরও ইতি ঘটবে।
আমাদের বিশ্বাস, দুই নেত্রীই অবগত আছেন, এই দেশটাকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করার। কোনো কারণে দুই নেত্রী ব্যর্থ হলে আবার অশুভ শক্তি জেঁকে বসবে। এই অশুভ শক্তিই দুই নেত্রীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক জিইয়ে রাখছে। আমরা তার প্রমাণ পদে পদে পাচ্ছি। আমরা দেখে আসছি, কোনো ইস্যুতে শেখ হাসিনা না বললে, খালেদা জিয়া হ্যাঁ বলেন, আবার শেখ হাসিনা হ্যাঁ বললে খালেদা জিয়া না বলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এলেন, তখন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করলেন। এর কারণ আমাদের জানা নেই। তিনি কেন বললেন, আলোচনার কোনো সুযোগ নেই তাও আমাদের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। আমার মনে হয়, এটা দুই নেত্রীর 'ইগো' সমস্যা। এটা দূর করতে না পারলে সমঝোতার রাজনীতি আমরা কোনো দিনই দেখতে পাব না। আলোচনার মাধ্যমেই তো উদ্ভূত সমস্যার সমাধান সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদে রাখতে হলেও তো রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে হতে পারে। সংসদ সদস্যরা চাইলেই এ ব্যবস্থা রাখতে পারেন। আমি তো মনে করি, উভয় দলের সংসদ সদস্যরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেবেন।
এ কথা কে না জানে, ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি তুলেছিল। তখন এর ঘোর বিরোধিতা করেছিল বিএনপি। এই দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তখনকার শাসকদল ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনও করেছিল। অবশেষে শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিএনপি সরকার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াল। এখনো মানুষ চায়, এ ব্যবস্থাটি বহাল থাকুক। মানুষের কল্যাণেই তো আইন! মানুষ চাইলে ব্যবস্থাটি বহাল রাখতে অসুবিধা কোথায়?
যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর কিছু ত্রুটির কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল। আইনের ফাঁকফোকরে অপশক্তি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাস বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির অসীম ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে করা যেতে পারে। এ জন্য সব রাজনৈতিক দল আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যবস্থাটি রাখা, না রাখা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে জল ঘোলা করার কোনো মানে নেই।
সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্ক স্পষ্টই বলেছেন, 'প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠিত নীতি অন্য কোনোভাবেই আইনগতভাবে বৈধ নয়, প্রয়োজন এটাকে বৈধ করেছে। জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন। এ তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে ও প্রয়োজনের আলোকে আগামী দুটি নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে হতে পারে।'
রায়ে আরো বলা হয়েছে, 'যাহাই হোক না কেন, এই সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ ইত্যবসরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের বিচারপতিদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারপ্রধানের পদ থেকে বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার স্বাধীনতা সংসদের রইল।'
দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সংসদ তো এ দায়িত্ব পালন করতেই পারে। কী কারণে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ইতিপূর্বে সরকারি দল এবং সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেই তারা সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। ফলে বিরোধী দল কমিটিতে না গেলেও নিশ্চিন্ত ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকছে। কিন্তু আকস্মিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করবেন না তাঁরা। কোর্টের রায় মেনে বিএনপিকে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর বিএনপি ধরেই নিয়েছে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে চাচ্ছে না। কাজেই আলোচনা করেও কোনো ফল হবে না। সংগত কারণেই বিএনপি আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। বিএনপিকে আন্দোলন থেকে ফেরাতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার দেশের অভিভাবক। অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা এবং সব পক্ষকে আস্থায় রেখে কাজ করা। ক্ষমতায় বসে সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধীদের দলন-পীড়ন সহজেই করা যায়। কিন্তু আখেরে তা ভালো ফল দেয় না। ক্ষমতাসীন দল সেটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম।
এটাও ঠিক, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির উচিত ছিল সংবিধান-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির বৈঠকে যোগ দেওয়া। সেখানে বিএনপি পাল্টা প্রস্তাব দিতে পারত। সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে যদি কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে থাকে সেগুলো তুলে ধরতে পারত। কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে সেটাও স্পষ্ট করতে পারত। অথচ বিএনপি কমিটির কোনো বৈঠকেই যায়নি। এ ধরনের একগুঁয়ে স্বভাব পরিত্যাগ করতে হবে। সব কিছুতে না বললে সমঝোতা হবে না। আর সমঝোতা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে সমঝোতা, পরমতসহিষ্ণুতা। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের বিকল্প কিছু ভেবে থাকলে ভিন্ন কথা। তবে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় বসলে হয়তো কারো কারো জন্য সুবিধা হয়। কিন্তু দেশের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
গণতন্ত্র যে সর্বোত্তম ব্যবস্থা তা বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বেচ্ছাচার ও একনায়ক শাসকদের মসনদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে সেসব দেশের সাধারণ মানুষ। ওই সব দেশে এখন গণতন্ত্রের উত্তাল হওয়া বইছে। বর্তমান যুগে মানুষকে দুঃশাসনের জাঁতাকলে দাবিয়ে রাখা যায় না। তাই শাসকদের মনে রাখতে হবে, বিরোধীদের দলন-পীড়ন করা যাবে না। বিরোধী পক্ষের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতেই হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ দুটি ইস্যুতে প্রধান দুই নেত্রীর বৈঠকের কোনো বিকল্প নেই। তাঁরা সংসদেও আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছতে পারেন। আলোচনা করে সমাধান করা যায় না এমন কোনো বিষয় নেই। তাঁরা যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেন তাহলে সংঘাতের পথে না গিয়ে তাঁদের সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
দুই নেত্রীর কুশলবিনিময়ের পর থেকেই সারা দেশের, এমনকি বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তখনই টের পেলাম সব মানুষই দুই নেত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক দেখতে চান। কী আওয়ামী লীগ, কী বিএনপি অথবা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং আপামর জনসাধারণ দুই নেত্রীর ভালো সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। দুই নেত্রীর আনন্দে তাঁরা আনন্দিত হন। আমরা মিডিয়ার লোকরাও দুই নেত্রীর ঐক্য চাই। দেশের স্বার্থেই দুই নেত্রীর ঐক্য ও সমঝোতার রাজনীতি দেখতে চাই। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আমরা জানি, সারা দেশে দুই নেত্রীর কোটি কোটি ভক্ত। তাঁরা যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন তাঁদের ভক্ত থাকবে। তাঁরা যদি রাজনীতি ছেড়েও দেন, তার পরও থাকবে। তাঁদের হাত ধরে উত্তরসূরি যাঁরাই আসবেন তাঁরাও ব্যাপক জনপ্রিয় ওঠে উঠবেন। ঘুরেফিরে তাঁদের প্রজন্মই ক্ষমতায় বসবেন। কাজেই তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে। এটা না হলে আবারও তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটবে। সেটা হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুই পরিবারের যে প্রভাব তা আর থাকবে না। উত্তরাধিকার রাজনীতিরও ইতি ঘটবে।
আমাদের বিশ্বাস, দুই নেত্রীই অবগত আছেন, এই দেশটাকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করার। কোনো কারণে দুই নেত্রী ব্যর্থ হলে আবার অশুভ শক্তি জেঁকে বসবে। এই অশুভ শক্তিই দুই নেত্রীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক জিইয়ে রাখছে। আমরা তার প্রমাণ পদে পদে পাচ্ছি। আমরা দেখে আসছি, কোনো ইস্যুতে শেখ হাসিনা না বললে, খালেদা জিয়া হ্যাঁ বলেন, আবার শেখ হাসিনা হ্যাঁ বললে খালেদা জিয়া না বলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এলেন, তখন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করলেন। এর কারণ আমাদের জানা নেই। তিনি কেন বললেন, আলোচনার কোনো সুযোগ নেই তাও আমাদের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। আমার মনে হয়, এটা দুই নেত্রীর 'ইগো' সমস্যা। এটা দূর করতে না পারলে সমঝোতার রাজনীতি আমরা কোনো দিনই দেখতে পাব না। আলোচনার মাধ্যমেই তো উদ্ভূত সমস্যার সমাধান সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদে রাখতে হলেও তো রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে হতে পারে। সংসদ সদস্যরা চাইলেই এ ব্যবস্থা রাখতে পারেন। আমি তো মনে করি, উভয় দলের সংসদ সদস্যরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেবেন।
এ কথা কে না জানে, ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি তুলেছিল। তখন এর ঘোর বিরোধিতা করেছিল বিএনপি। এই দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তখনকার শাসকদল ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনও করেছিল। অবশেষে শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিএনপি সরকার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াল। এখনো মানুষ চায়, এ ব্যবস্থাটি বহাল থাকুক। মানুষের কল্যাণেই তো আইন! মানুষ চাইলে ব্যবস্থাটি বহাল রাখতে অসুবিধা কোথায়?
যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর কিছু ত্রুটির কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল। আইনের ফাঁকফোকরে অপশক্তি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাস বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির অসীম ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে করা যেতে পারে। এ জন্য সব রাজনৈতিক দল আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যবস্থাটি রাখা, না রাখা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে জল ঘোলা করার কোনো মানে নেই।
সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্ক স্পষ্টই বলেছেন, 'প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠিত নীতি অন্য কোনোভাবেই আইনগতভাবে বৈধ নয়, প্রয়োজন এটাকে বৈধ করেছে। জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন। এ তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে ও প্রয়োজনের আলোকে আগামী দুটি নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে হতে পারে।'
রায়ে আরো বলা হয়েছে, 'যাহাই হোক না কেন, এই সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ ইত্যবসরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের বিচারপতিদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারপ্রধানের পদ থেকে বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার স্বাধীনতা সংসদের রইল।'
দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সংসদ তো এ দায়িত্ব পালন করতেই পারে। কী কারণে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ইতিপূর্বে সরকারি দল এবং সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখেই তারা সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। ফলে বিরোধী দল কমিটিতে না গেলেও নিশ্চিন্ত ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকছে। কিন্তু আকস্মিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করবেন না তাঁরা। কোর্টের রায় মেনে বিএনপিকে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর বিএনপি ধরেই নিয়েছে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে চাচ্ছে না। কাজেই আলোচনা করেও কোনো ফল হবে না। সংগত কারণেই বিএনপি আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। বিএনপিকে আন্দোলন থেকে ফেরাতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার দেশের অভিভাবক। অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা এবং সব পক্ষকে আস্থায় রেখে কাজ করা। ক্ষমতায় বসে সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধীদের দলন-পীড়ন সহজেই করা যায়। কিন্তু আখেরে তা ভালো ফল দেয় না। ক্ষমতাসীন দল সেটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম।
এটাও ঠিক, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির উচিত ছিল সংবিধান-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির বৈঠকে যোগ দেওয়া। সেখানে বিএনপি পাল্টা প্রস্তাব দিতে পারত। সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে যদি কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে থাকে সেগুলো তুলে ধরতে পারত। কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে সেটাও স্পষ্ট করতে পারত। অথচ বিএনপি কমিটির কোনো বৈঠকেই যায়নি। এ ধরনের একগুঁয়ে স্বভাব পরিত্যাগ করতে হবে। সব কিছুতে না বললে সমঝোতা হবে না। আর সমঝোতা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে সমঝোতা, পরমতসহিষ্ণুতা। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের বিকল্প কিছু ভেবে থাকলে ভিন্ন কথা। তবে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় বসলে হয়তো কারো কারো জন্য সুবিধা হয়। কিন্তু দেশের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
গণতন্ত্র যে সর্বোত্তম ব্যবস্থা তা বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বেচ্ছাচার ও একনায়ক শাসকদের মসনদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে সেসব দেশের সাধারণ মানুষ। ওই সব দেশে এখন গণতন্ত্রের উত্তাল হওয়া বইছে। বর্তমান যুগে মানুষকে দুঃশাসনের জাঁতাকলে দাবিয়ে রাখা যায় না। তাই শাসকদের মনে রাখতে হবে, বিরোধীদের দলন-পীড়ন করা যাবে না। বিরোধী পক্ষের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতেই হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ দুটি ইস্যুতে প্রধান দুই নেত্রীর বৈঠকের কোনো বিকল্প নেই। তাঁরা সংসদেও আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছতে পারেন। আলোচনা করে সমাধান করা যায় না এমন কোনো বিষয় নেই। তাঁরা যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেন তাহলে সংঘাতের পথে না গিয়ে তাঁদের সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments