আইভীর জয়, মানুষের জয় by আসিফ নজরুল
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয় অস্বাভাবিক নয়। আমি এর আগের লেখায় লিখেছিলাম, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ‘জনগণের প্রার্থী’ জিতবেন। নির্বাচন দৃশ্যত সুষ্ঠুভাবে হওয়ায় তিনিই জিতেছেন। শেষ মুহূর্তে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় তাঁর বিজয় আরও সুনিশ্চিত হয়েছে।
বিএনপির সমর্থকদের কাছে সংগত কারণে শামীমের চেয়ে আইভী অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। নিজ দলের প্রার্থী সরে দাঁড়ানোর পর তাঁদের সিংহভাগ আইভীকে ভোট দিয়েছেন, এটি ধারণা করা যায়। তবে আইভী যে বিপুলসংখ্যক ভোটের ব্যবধানে জিতলেন, এটি মূলত তাঁরই কৃতিত্ব। তাঁর নিষ্কলুষ, দৃঢ়চেতা ও জনমুখী চরিত্র তাঁকে নারায়ণগঞ্জের মানুষের আপনজন হিসেবে আগেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আইভী আওয়ামী লীগ থেকে এ নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁকে সমর্থন করে তাঁর বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করতে পারত দলটি। এখন তাঁর বিজয়ে কিছুটা হলেও নৈতিক পরাজয় হলো তাদের। কিন্তু আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ এখন বলবে, বিজয়ী আমাদের লোক, কাজেই আমাদেরই বিজয় হয়েছে! আওয়ামী লীগ এটিও দাবি করবে যে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে, দলীয় সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া এবং ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এই দাবির ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচন একই রকমভাবে (দলীয় সরকারের অধীনে, সেনা মোতায়েন ব্যতীত এবং ইভিএম পদ্ধতিতে) করার চেষ্টা জোরদার করবে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন থেকে সরে এসে বিএনপি সেই সুযোগ কিছুটা হলেও নস্যাৎ করে দিয়েছে। যে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল নেই, সে নির্বাচনের ভিত্তিতে কোনো কিছু দাবি করার সুযোগ কমে যাওয়ার কথা।
বিএনপি মেয়র পদে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তে। এ সিদ্ধান্ত আকস্মিক হলেও অভাবিত নয়। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা জোরালো ছিল না। বিএনপির অংশগ্রহণ থাকলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি বিএনপি মেনে নিয়েছে—এটি প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ছিল। তা ছাড়া বিএনপির এই আশঙ্কাও ছিল যে নির্বাচনে কারচুপি করে হলেও শামীমকে জেতানো হবে।
বিএনপির প্রার্থী সরে দাঁড়ানোয় সেই কারচুপির আশঙ্কা অনেকাংশে দূর হয়েছিল। কারণ, তৈমুরের ভোট আইভী পাবেন, এমন পরিস্থিতিতে শামীমকে জেতানোর জন্য কারচুপি করতে হলে তা বিশাল মাত্রায় করতে হতো। গণমাধ্যমের এত গভীর নজরদারির মধ্যে ছোটখাটো কারচুপি হয়তো করা যায়, কিন্তু বিশাল কারচুপি করা সম্ভব নয়।
মেয়র নির্বাচন বর্জন করার জন্য বিএনপিকে খুব একটা সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। কারণ, সেনা মোতায়েন না করে এই পরিবেশ আওয়ামী লীগ সরকারই তৈরি করেছে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, সরকারের কর্তব্য হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। কমিশন সহায়তা চেয়েছিল সেনা মোতায়েনের বিষয়ে। সরকার তা উপেক্ষা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, পছন্দমতো নির্বাচন করার লক্ষ্যে তার পক্ষে সংবিধান লঙ্ঘন করাও সম্ভব। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও বলেছেন যে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। বিএনপির নির্বাচনের ঘোষণা তাই খুব সমালোচিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।
নারায়ণগঞ্জে ‘জনগণের প্রার্থী’ বিজয়ী হলেন। বিজয়ী হলো নারায়ণগঞ্জের মানুষও। আমরা বহুদিন যাবৎ বলে আসছি, বাংলাদেশের মানুষ যোগ্য বিকল্পের অভাবে বড় দুই দলের ঠিক করা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর সামনে সুযোগ এসেছিল যোগ্য একজন তৃতীয় বা বিকল্প প্রার্থীকে নির্বাচিত করার। আইভী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বড় দুই দলের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীন ও সুশীল সত্তার জয় হয়েছে। আশা করব, আইভী মানুষকে নিরাশ করবেন না।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে। কমিশন প্রার্থীদের এবং নারায়ণগঞ্জবাসীকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার দিয়েছিল যে নির্বাচনের দুই দিন আগে সেনা মোতায়েন করা হবে। এর পরও সরকার নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেয়নি। এমনকি এ-সম্পর্কিত কমিশনের চিঠির উত্তর দেওয়ার সৌজন্য প্রকাশ করেনি। কমিশনের এখন কর্তব্য হচ্ছে, এ সম্পর্কে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করা এবং জনগণকে তা জানানো। তা করতে ব্যর্থ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের উচিত হবে পদত্যাগ করা। সংবিধান লঙ্ঘন এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অবমাননা করার প্রতিবাদে কমিশনাররা পদত্যাগ করলে একটি উজ্জ্বল নজির স্থাপিত হবে দেশে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আইভী আওয়ামী লীগ থেকে এ নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁকে সমর্থন করে তাঁর বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করতে পারত দলটি। এখন তাঁর বিজয়ে কিছুটা হলেও নৈতিক পরাজয় হলো তাদের। কিন্তু আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ এখন বলবে, বিজয়ী আমাদের লোক, কাজেই আমাদেরই বিজয় হয়েছে! আওয়ামী লীগ এটিও দাবি করবে যে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে, দলীয় সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া এবং ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এই দাবির ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচন একই রকমভাবে (দলীয় সরকারের অধীনে, সেনা মোতায়েন ব্যতীত এবং ইভিএম পদ্ধতিতে) করার চেষ্টা জোরদার করবে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন থেকে সরে এসে বিএনপি সেই সুযোগ কিছুটা হলেও নস্যাৎ করে দিয়েছে। যে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল নেই, সে নির্বাচনের ভিত্তিতে কোনো কিছু দাবি করার সুযোগ কমে যাওয়ার কথা।
বিএনপি মেয়র পদে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তে। এ সিদ্ধান্ত আকস্মিক হলেও অভাবিত নয়। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা জোরালো ছিল না। বিএনপির অংশগ্রহণ থাকলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার বিষয়টি বিএনপি মেনে নিয়েছে—এটি প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ছিল। তা ছাড়া বিএনপির এই আশঙ্কাও ছিল যে নির্বাচনে কারচুপি করে হলেও শামীমকে জেতানো হবে।
বিএনপির প্রার্থী সরে দাঁড়ানোয় সেই কারচুপির আশঙ্কা অনেকাংশে দূর হয়েছিল। কারণ, তৈমুরের ভোট আইভী পাবেন, এমন পরিস্থিতিতে শামীমকে জেতানোর জন্য কারচুপি করতে হলে তা বিশাল মাত্রায় করতে হতো। গণমাধ্যমের এত গভীর নজরদারির মধ্যে ছোটখাটো কারচুপি হয়তো করা যায়, কিন্তু বিশাল কারচুপি করা সম্ভব নয়।
মেয়র নির্বাচন বর্জন করার জন্য বিএনপিকে খুব একটা সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। কারণ, সেনা মোতায়েন না করে এই পরিবেশ আওয়ামী লীগ সরকারই তৈরি করেছে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, সরকারের কর্তব্য হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। কমিশন সহায়তা চেয়েছিল সেনা মোতায়েনের বিষয়ে। সরকার তা উপেক্ষা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, পছন্দমতো নির্বাচন করার লক্ষ্যে তার পক্ষে সংবিধান লঙ্ঘন করাও সম্ভব। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও বলেছেন যে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। বিএনপির নির্বাচনের ঘোষণা তাই খুব সমালোচিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।
নারায়ণগঞ্জে ‘জনগণের প্রার্থী’ বিজয়ী হলেন। বিজয়ী হলো নারায়ণগঞ্জের মানুষও। আমরা বহুদিন যাবৎ বলে আসছি, বাংলাদেশের মানুষ যোগ্য বিকল্পের অভাবে বড় দুই দলের ঠিক করা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর সামনে সুযোগ এসেছিল যোগ্য একজন তৃতীয় বা বিকল্প প্রার্থীকে নির্বাচিত করার। আইভী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বড় দুই দলের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীন ও সুশীল সত্তার জয় হয়েছে। আশা করব, আইভী মানুষকে নিরাশ করবেন না।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে। কমিশন প্রার্থীদের এবং নারায়ণগঞ্জবাসীকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার দিয়েছিল যে নির্বাচনের দুই দিন আগে সেনা মোতায়েন করা হবে। এর পরও সরকার নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেয়নি। এমনকি এ-সম্পর্কিত কমিশনের চিঠির উত্তর দেওয়ার সৌজন্য প্রকাশ করেনি। কমিশনের এখন কর্তব্য হচ্ছে, এ সম্পর্কে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করা এবং জনগণকে তা জানানো। তা করতে ব্যর্থ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের উচিত হবে পদত্যাগ করা। সংবিধান লঙ্ঘন এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অবমাননা করার প্রতিবাদে কমিশনাররা পদত্যাগ করলে একটি উজ্জ্বল নজির স্থাপিত হবে দেশে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments