সৌরবিদ্যুৎ-বদলে যাওয়া চরের জীবন by মুশফিকুর রহমান

গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে ট্রলারে প্রায় এক ঘণ্টা যমুনার উজান বেয়ে নিশ্চিন্তপুর চর। এক পাশে ব্রহ্মপুত্র, অন্য পাশে যমুনা বইছে। পাটের খেত, সবজির মাচা, ধানের বীজতলা, কাদামাটিতে কৃষকের লাঙল চষা জমি পেরিয়ে টিনের ঘরগুলোর এই চরের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের ধরন অনেকটাই বলে দেয়।


চরবাসী অনেক মানুষ নদীভাঙনে ভিটেহারা হয়ে চরে এসে ঘরসংসার পেতেছে। নদীর চরের নিয়মিত ভাঙাগড়া জীবনের অনেক ওঠানামা অবধারিত করলেও মানুষ বিলাপ করার চেয়ে এখানে জীবনসংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে। বাঁশের বেড়ার ঘরে খাড়া টিনের ছাউনি দিয়ে মানুষ কেবল ঘরই বাঁধেনি, সেই ঘরের মাথায় টিভি অ্যান্টেনা ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়েছে। বর্ষার ভরা নদী বেয়ে বিকেল হয়ে গেল আমাদের নিশ্চিন্তপুরে পৌঁছাতে। নিশ্চিন্তপুর চরের কয়েকটি ঘরে উঁকি দিয়ে বিদ্যুতের আলো জ্বলতে এবং দল বেঁধে বসে পরিবারের মানুষগুলোকে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দেখলাম।
সন্ধ্যায় ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলবে, পরিবারের সদস্যরা মিলে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপভোগ করবে—এটা আমরা যারা শহরবাসী তাদের জন্য অতি পরিচিত দৃশ্য, বরং উল্টো চিত্র হলে সেটা অস্বাভাবিক। কিন্তু মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নদীর চরে যাদের বসবাস, বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্রিডলাইন যে চরবাসী মানুষের কাছে পৌঁছানো দূর স্বপ্নের মতো, সেখানে ইচ্ছেমতো সুইচ টিপে আলো জ্বালানোর স্বাধীনতা সহজ বিষয় নয়।
বিদ্যুতের আলো কেবল ভূত তাড়ায় না, ব্যবহারিক জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিশ্চিন্তপুর চরে বসবাসকারী কৃষক দম্পতি শহর আলী ও আলেয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে বিষয়টি আবারও স্পষ্ট হলো। এই দম্পতির দুটি সন্তান, বড়টি কেবল স্কুলে যায়। আলেয়া বেগম বলছিলেন, সৌরবিদ্যুতের আলো থাকায় তাঁর সন্তানের লেখাপড়ার সুবিধা হয়েছে। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এসেছে, নৌকায় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমরা কাছের চরের ফজলপুর বাজারে পৌঁছালাম। মেঠোপথ বেয়ে, কিছু পথ জমির আইল দিয়ে, কিছু পথ সরু রাস্তা বেয়ে ফজলপুর বাজারে গিয়ে নিজেরাই অবাক। গ্রামের বাজারে বিদ্যুতের আলো রাত নামতে দেয়নি। সরগরম বাজার। দোকানিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বেচাকেনা করছেন, চায়ের স্টলে ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে বাজারে আসা মানুষেরা আড্ডা আর গল্পে মুখর।
সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হওয়ায় এখন ফজলপুর বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। কোনো কোনো দোকানে মুঠোফোন চার্জ দেওয়ার সার্ভিস চালু হয়েছে। প্রতিটি সেট একবার চার্জ দেওয়ার জন্য পাঁচ টাকা ব্যয় করতে হয়। আবার কেউ নিজের দোকানে বসানো সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল থেকে পাশের দোকানে একটি বাল্বের সংযোগ ভাড়া দিয়েছেন, এতে প্রতি মাসে তাঁর আয় হচ্ছে ১৫০ টাকা।
কেবল যমুনা-ব্রহ্মপুত্রবেষ্টিত নদীর চরে নয়, নদীর পাড়ের ফুলছড়ি উপজেলার অনেক জনপদেই এখনো গ্রিডলাইনে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। নিকট ভবিষ্যতে পৌঁছাবে, এমন ভরসাও কম। এমনই এলাকার একটি ফুলছড়ি উপজেলার কেতকীর হাট। কেতকীর হাটে সৌরবিদ্যুৎ প্রায় প্রতিটি দোকান, চায়ের স্টল, ডাক্তারখানা আলোকিত করছে। সন্ধ্যা নামলেই যেখানে দোকানগুলো হয় বন্ধ হয়ে যেত বা কেরোসিনের কুপি আলো-আঁধারির ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করত, এখন সেখানে সৌরবিদ্যুতের উজ্জ্বল আলো কেতকীর হাটকে জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্রে রূপান্তর করেছে। কেতকীর হাটে জমজমাট চা-মিষ্টির দোকানের কাউন্টারে মালিক নূর আলমের সঙ্গে কথা হলো। প্রায় ছয় মাস আগে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছেন। নূর আলমের মাথার ওপর ছোট একটা বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে সারাক্ষণ। এ ছাড়াও চারটি এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বলে দোকানে। এসবই টিনের চালে বসানো সৌরবিদ্যুতের প্যানেল থেকে পাওয়া বিদ্যুতের কল্যাণে চলছে।
সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জের মানুষের যে পরিচিতি ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেটি কিন্তু হঠাৎ হয়নি। এ কথা সত্য, শহর ও গ্রামে গ্রিডলাইনে যে বিদ্যুৎ আমরা ব্যবহার করে অভ্যস্ত, সৌর বিদ্যুতের তুলনায় তা অনেক সস্তা। কিন্তু যখন গ্রিডলাইনে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ অনুপস্থিত, কেরোসিনের ব্যয়বহুল লণ্ঠন বা কুপির বিকল্প বেছে নেওয়ার প্রশ্ন যখন বাস্তব জিজ্ঞাসা, তখন মানুষ অনায়াসে বেছে নেয় সৌরবিদ্যুৎ। সারা দেশে ইতিমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি সোলার হোম সিস্টেম বাড়িঘর, দোকানপাটে ব্যবহারের উপযোগী সৌরবিদ্যুৎ-ব্যবস্থা সংযুক্ত হয়েছে। ছোট ছোট সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল দিয়ে মাত্র কয়েক ওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন-ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই মিলিতভাবে দেশে প্রায় ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
সৌরবিদ্যুৎ অফুরান সূর্যের আলোকে ফটো ভোল্টাইক সেলের সাহায্যে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই ব্যবস্থায় কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে হয় না। জটিল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দরকার হয় না। শব্দ, ধোঁয়া বা বিকিরণ না ছড়িয়ে প্রকৃতির ছড়িয়ে দেওয়া সূর্যালোকের সামান্য কিছু আলো ব্যবহার উপযোগী বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করা হয়। সংগত কারণেই সৌরবিদ্যুৎকে পরিবেশবান্ধব বলা হয়।
দেশে সৌরবিদ্যুৎ ঘরে ঘরে ব্যবহার করতে সোলার প্যানেল ছাড়াও চার্জ কন্ট্রোলার, কনভার্টর, এনার্জি সেভিং বাল্ব, ব্যাটারি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এসব উপাদান ও যন্ত্রাংশ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ক্রমাগত বাড়ছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ পরিচিত ও জনপ্রিয় করতে দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া একজন পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন গ্রামীণ শক্তির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং সিইও। দীপাল বড়ুয়ার পথ ধরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সোলার হোম সিস্টেম বাজারজাত করছে। এ জন্য কিস্তিতে পরিশোধের বিভিন্ন প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে। ৫০ ওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম পেতে প্রায় ১০ হাজার ৫০০ এবং ১৩০ ওয়াটের জন্য ২৭ হাজার ১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এক লিটার কেরোসিন তেলের দাম ৫০ টাকা। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারকারী মূলত বিবেচনায় নিচ্ছেন, সপ্তাহে এক লিটার কেরোসিন পুড়িয়ে কুপি বা লণ্ঠনের যে আলো পাওয়া যায়, তার চেয়ে উন্নত, সস্তা, বিরতিহীন ও বেশি সময়জুড়ে সৌরবিদ্যুতের আলো মেলে।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.