কালের পুরাণ-দেশ উদ্ধার, না দল উদ্ধার? by সোহরাব হাসান

বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে তরুণ বয়সে যাঁরা তুখোড় বামপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই পূর্ণ যৌবনে বা প্রৌঢ় বয়সে মধ্য বা চরম ডান পন্থায় দীক্ষা নেন। সাবেক বামপন্থীদের বড় অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগ হয়ে কখনো মন্ত্রিত্ব, কখনো নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করছেন।


ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে এখনো কোনো বামপন্থী নেতা সমাসীন না হলেও বিএনপি অন্তত দুইজন বামপন্থী মহাসচিব পেয়েছে—আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাবেক ভাসানী ন্যাপ ও ইউপিপির নেতা মান্নান ভূঁইয়ার বিএনপিতে আগমন যতটা আনন্দঘন ছিল, বিদায়টা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি করুণ। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) নেতা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনিও ভাসানী ন্যাপ করতেন। কিন্তু বাম পন্থায় বেশি দিন আস্থা না রাখতে পেরে তিনি ডান পন্থার শক্ত ঘাঁটি বিএনপিতে যোগ দেন এবং বর্তমানে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
মির্জা ফখরুল ভালো বক্তৃতা দেন। ফালতু কথা বলেন না বলেই দলের বাইরেও তাঁর একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে। এ কারণে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর যখন তাঁকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মনোনীত করা হয়, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, বিএনপিতে ‘ভাইয়া-সংস্কৃতি’র দিন সম্ভবত আর নেই। কিন্তু হালে তাঁর কণ্ঠে তারেকবন্দনা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। একে অনেকে চাকরি রক্ষার কৌশল বলেও মনে করেন। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ চলে চেয়ারপারসন বা সভানেত্রীর একক কর্তৃত্বে। অতএব, তাঁরা যা শুনতে পছন্দ করেন, নেতারা তা-ই বেশি বেশি বলেন। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—দুই দলেই সাবেক বামদের বিরুদ্ধে একটা অঘোষিত ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। সুযোগ পেলেই ডানপন্থীরা তাঁদের একহাত নিতে ছাড়েন না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরকার সাবেক বামরা সাফল্য বা কৃতিত্ব দেখালেও অন্যরা সন্দেহ করেন, অনুপ্রবেশকারী বলে গালমন্দ করেন। ন্যাপের এককালীন ডাকসাইটে নেতা মহিউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতার পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করলেও ‘ন্যাপ মহিউদ্দিন’-এর বদনাম ঘোচাতে পারেননি।
আগেও দেখেছি, যখনই কোনো নেতা দলের ভেতরে একটু কোণঠাসা থাকেন, তখনই গরম গরম কথা বলে অন্যদের খামোশ করতে চান। মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে কি না, আমরা জানি না।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত সোমবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই জন্ম হয়েছিল বিএনপির।’ তাঁর এ ব্যাখ্যা সঠিক কি না, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলতে পারবেন। কিন্তু আমরা সবিনয়ে মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাই, আওয়ামী লীগের পর বিএনপিও যখন ব্যর্থ হয়, তখন মানুষের কী করণীয়? তারা কোথায় যাবে? আওয়ামী লীগের শাসনের পর জিয়া, সাত্তার, খালেদা জিয়া মিলে ১৬-১৭ বছর দেশ শাসন করেছেন। এ সময়ে ভালো কিছু হলে তার কৃতিত্ব যেমন বিএনপি দাবি করতে পারে, তেমনি খারাপের দায়ও তো তাদের নিতে হবে।
মির্জা ফখরুলের ভাষায় ‘যা কিছু কল্যাণ ও শুভ’ তার সবই যদি জিয়াউর রহমান করে থাকেন, তাহলে দেশের এই দুরবস্থা কেন? কেন আজ তাঁর সন্তানদের বিদেশে পালিয়ে থাকতে হয়? সবটাই কি আওয়ামী লীগ বা সরকারের ষড়যন্ত্র? হারিছ চৌধুরী তো জিয়া পরিবারের কেউ নন, তাঁকে কেন পাঁচ বছর ধরে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে? কেন সব বোমা ও গ্রেনেড হামলার মামলায় বাবরের নাম আসছে?
জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা, ২৭ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন—এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য তিনিই রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসিত করেছেন। তিনিই গায়ের জোরে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করেছেন। তাই ‘যা কিছু কল্যাণ ও শুভ’র সঙ্গে কিছু অকল্যাণের দায়ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতাকে নিতে হবে। জিয়া কথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও পরবর্তী সময়ে সেই সিপাহি-জনতার কথা মনে রাখেননি। মনে রেখেছেন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের কথা। বাংলাদেশের এক কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধীকে স্বাধীনতা পদকও দিয়েছিলেন তিনি।
সাবেক বামপন্থী হিসেবে তাঁকে আরও একটি প্রশ্ন করব, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় একজন সেনা কর্মকর্তাকে কেন রাজনীতিতে আসতে হলো? তখনো মওলানা ভাসানী জীবিত ছিলেন, সক্রিয় ছিলেন বহু বামপন্থী নেতা। তাঁরা কেন নেতৃত্ব দিতে পারলেন না?
আসলে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা নয়, বিরোধিতার জন্যই বিএনপির জন্ম। আওয়ামী লীগ যেসব নীতি ঘোষণা করেছিল, বিএনপির তা পছন্দ নয়। আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে তো জাসদ, ন্যাপ বা অন্য কোনো দলের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু সেনানিবাস থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসতে হবে কেন? বাংলাদেশ কেন পরিত্যক্ত পাকিস্তানি মডেল অনুসরণ করবে? আজ যে দেশে রাজনৈতিক সংকট, তার মূলে রাজনীতিতে অরাজনৈতিক শক্তির অনুপ্রবেশ। আর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে যদি বিএনপির জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে এরশাদের দাবিকেও মেনে নিতে হয়। তিনি বলেছেন, বিএনপির ব্যর্থতার কারণেই ১৯৮২ সালে তাঁকে দেশের শাসনভার নিতে হয়েছে। রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে জাতীয় পার্টি গঠন করতে হয়েছে। এখনো দেখুন, জিয়ার ১৯ দফার সঙ্গে এরশাদের ১৮ দফারতেমন পার্থক্য নেই।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করাই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ এ পর্যন্ত না হয় ঠিকই ছিল। তিনি খানিকটা আগ বাড়িয়ে বলেছেন, ১৯৭৮ সালে যে প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়া বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এখন নাকি দেশে সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। কীভাবে? ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস হলো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে অব্যাহত সেনাশাসন। তখন জনগণ নয়, সকল ক্ষমতার উৎস ছিলেন জিয়াউর রহমান ও সেনাবাহিনী। তিনি একাধারে সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি। বিএনপির নেতারা জিয়াকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে দাবি করেন। হ্যাঁ, জিয়া ততটাই বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন, যতটা দিলে তাঁর ক্ষমতার ভিত আরও শক্ত হয়। জিয়া যদি এতই গণতান্ত্রিক হবেন, তাহলে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে কেন পদত্যাগে বাধ্য করলেন? কেন ’৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা, তা বাতিল করলেন? কীভাবে জিয়া বিচারপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন, সে বিবরণ আছে তাঁর At Bangabhaban : Last Phase বইয়ে।
জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।এর আগে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলেন কীভাবে? বিএনপির নেতারা এখন সংবিধান নিয়ে অনেক কথা বলেন; কিন্তু জিয়াউর রহমান যখন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলে দিলেন, তখন কাদের মতামত তিনি নিয়েছিলেন? তিনিও কি আইয়ুব ও এরশাদের মতো তথাকথিত গণভোটের আশ্রয় নেননি? এসব কথা বলার অর্থ এই নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতি অর্জনে জিয়ার অবদান অস্বীকার করছি। আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী নেতাদের মতো আমরা এ-ও মনে করি না, জিয়া পাকিস্তানিদের এজেন্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে একাত্তরে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিএনপির নেতারা কেন জিয়াকে শেখ মুজিবের বিপরীতে দাঁড় করাতে চান? ইতিহাসে কার কী ভূমিকা, তা মওদুদ আহমদের বই পড়লেই জানা যাবে (যদিও সম্প্রতি সত্য ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়েছিলেন)। জাতীয়তাবাদী দলের গঠনতন্ত্রে যে ১৯ দফা কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে, সেই ১৯ দফা কবে প্রণীত হয়েছে, কারা প্রণয়ন করেছেন—বিএনপির নেতারা কি তা বলতে পারবেন? ১৯ দফা প্রণীত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে গণভোটের আগে, এর সঙ্গে রাজনীতিবিদদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
অতএব, আজকের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জিয়ার বিএনপি প্রতিষ্ঠার মিল খোঁজা রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছু নয়। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। রাজনীতিবিদেরা কারাগারে আর রাজনীতি ছিল সেনানিবাসে বন্দী। এখন দেশের রাজনীতি সেনানিবাসে বন্দী না থাকলেও নেতাদের বিষবাণে বন্দী। এক দল বলে, গণতন্ত্র উদ্ধার করতে হবে; আরেক দল বলে, গণতন্ত্র বাঁচাতে হবে। তাঁরা কেউ গণতন্ত্র নিয়ে ভাবেন না; ভাবেন ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা নিয়ে। তাই মির্জা ফখরুল যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার কথা বলছেন, সেটি দেশের মানুষের স্বার্থে নয়, বিএনপির নেতা-নেত্রীদের স্বার্থে। ২০০১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে তাঁরা কী করেছেন, তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ২০০৮ সালে গণতন্ত্র উদ্ধার করে আওয়ামী লীগ কী করছে, জনগণ তা এখন উপলব্ধি করছে। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন কথায় কথায় সরকারকে জালেম, ফ্যাসিবাদ ও তাঁবেদার বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, তাঁদের আমলে কি দেশের অবস্থা এর চেয়ে ভালো ছিল? যদি না থেকে থাকে, তাহলে কেন মানুষ তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে দলীয় নেতা-নেত্রীদের পুনরুদ্ধারে সাড়া দেবে? বিএনপির মহাসচিব কি বলবেন, এখন স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার ও দল যেসব অপকর্ম করছে, তার কোনটি তাঁদের আমলে অনুপস্থিত ছিল? বরং বাড়তি উপসর্গ ছিল জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি; সিনেমা হলে, যাত্রার প্যান্ডেলে, সংগীতানুষ্ঠানে, মাজারে, রাজনৈতিক দলের অফিসে, জনসভায় বোমা মেরে মানুষ খুন করা।
অতএব, বিএনপির নেতারা যে বলছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরালেই গণতন্ত্র আসবে—তার নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে বহুবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। নতুন নতুন সরকারের নামে নতুন নতুন চেহারা এলেও তাতে গণতন্ত্র রক্ষা পায়নি, উদ্ধারও হয়নি। গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতির ধারেকাছেও আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেই। এর অর্থ এই নয় যে অনির্বাচিত কোনো সরকার দেশের কল্যাণ করতে পারবে। ২০০৭-০৮ সালের জরুরি সরকারও পারেনি। জনগণকে নিজেদের পথ খুঁজে নিতে হবে। যত দিন আমরা ভালো নেতৃত্ব তৈরি করতে না পারব, তত দিন এই দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
এখন গণতন্ত্র রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের আওয়াজ শুনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়। আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী কিংবা ২০০৬ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী দুঃসময়ের দৃশ্য। আমরা আতঙ্কিত হই আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধের মহড়ার কথা ভেবে। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের কাছে করজোড়ে মিনতি জানাই, শক্তি প্রদর্শনের এই মহড়া থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি একটু সহিষ্ণু হোন, একটু বাকসংযমী হোন। কথাবার্তায় শালীনতা বজায় রাখুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.