চালচিত্র-কেমন রাষ্ট্র কেমন ধর্ম কেমন সমাজ চাই by শুভ রহমান
রাষ্ট্র, ধর্ম কিংবা সংবিধান অথবা সমাজ_সবই আমাদের চাওয়ার একটি সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিত রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যা আমাদের সর্বাধিক প্রিয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এটিই আমাদের চাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে সরে গেলে আমাদের কোনো চাওয়াই ঠিকভাবে পূর্ণ হবে না।
আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও স্বাধীনতা প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই এবং সেগুলোর ওপর প্রত্যেকের অধিকার সমান। এই তিনটি বিষয় সবার, কিন্তু ধর্ম প্রত্যেকের এক নয়, যার যার, তার তার। এই মৌলিক বিষয়টি তথা প্রেক্ষিতটি বিস্মৃত হলে আমরা সঠিক রাষ্ট্র, সমাজ ও স্বাধীনতা পাব না। ধর্ম কারো কাছ থেকে কেউ জোর করে কেড়ে নিতে পারে না, বড়জোর দাবিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু সেটাও চিরতরে পারে না। শুধু ধর্মের কারণে দীর্ঘকাল ধরে বহু হানাহানি হয়েছে, এক ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে আরেক ধর্মাবলম্বীদের, একই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেও। কোনো লাভ হয়নি, শুধু রক্তগঙ্গাই বয়েছে। সভ্যতা লজ্জিত, কুণ্ঠিত, শিহরিত হয়েছে। বর্বরতা ও অমানুষতা সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয়েছে। প্রায় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে এসব আত্মঘাতী কলহ-বিবাদ-সংঘাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র তার স্বকীয় ও সর্বজনীন চরিত্র হারিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে একটা পুরো জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীরা নয়, কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়_হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, এ অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা_সবাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কোনো একক ধর্মাবলম্বী বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি_অংশ নিয়েছিল সবাই সম্মিলিতভাবে এবং একটি মাত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আর সে লক্ষ্য হচ্ছে এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সে স্বাধীনতার আলোয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা। গণতন্ত্রই হচ্ছে এসব স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম, আর সে গণতন্ত্র কার্যকর করার জন্য একটি অভিন্ন দলিল দরকার, যার নাম সংবিধান। সংবিধানবলেই বিচারালয়, সংসদ আর প্রশাসন গঠিত ও কার্যকর হয়।
আমরা এখন এক মহাসংকটে আছি। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে হলে, তার সম্মিলিত সত্তা, বৈশিষ্ট্য ও স্বার্থ বজায় রাখতে হলে কোনোভাবেই ধর্মকে তার মধ্যে টেনে আনা যাবে না।
ধর্ম যেহেতু আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠীর, সেহেতু রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সংহতি ও সংবদ্ধতা ক্ষুণ্ন হবে ধর্মকে তার মধ্যে টেনে আনা হলে এবং ধর্মকে জোর করে তার ভিত্তি করতে গেলে। সেটা যে বিজ্ঞানসম্মতও হয় না, ভ্রান্ত দর্শনভিত্তিক হয়, পাকিস্তানের দ্বিজাতিতাত্তি্বক ভ্রান্ত রাষ্ট্রকাঠামো ও দর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বাঙালি জাতির স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে তা সুপ্রতিষ্ঠিত করা গেছে।
দেরিতে হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, সচেতনতা ও কল্যাণচিন্তার কারণেই সংবিধান, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে স্বচ্ছ ধ্যান-ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সে লক্ষ্যেই জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য (পঞ্চদশ সংশোধনী) দীর্ঘ ১১ মাস ধরে একটি বিশেষ কমিটি কাজ করে এসেছে এবং এখন অবশেষে একটি খসড়া দাঁড় করিয়েছে। এ খসড়ায় যে সুপারিশমালা প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রশ্নে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানিয়েছেন কমিটির দুই সদস্য_রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আরো দুই মেয়াদে রাখার পক্ষেও মত দিয়েছেন। তবে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যেভাবে তিন মাসের কথা বলে দুই বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকেছে, তাতে ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরানোর মতো এ পদ্ধতির কথা শুনলেই এ দেশের পোড়খাওয়া মানুষের আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। সেদিক থেকে আদালতের রায়কে মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছে।
রাষ্ট্রধর্ম আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে দুই সংসদ সদস্য বস্তুত ইতিহাস ও বাস্তবতার পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁদের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং অবশ্যম্ভাবী রূপেই একদিন জয়যুক্ত হবে।
রাষ্ট্রের ওপর ধর্মের আছর থাকা মানেই ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিণতি যে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের উত্থান, তা নিয়ে আজ আর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থাদৃষ্টে কারো মনে সন্দেহের লেশমাত্র থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক শান্তি সম্মেলনে আগত দুই বামপন্থী রাজনীতিক যথার্থই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে এটা স্পষ্টই হয়ে গেছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে একটি জ্বালাও-পোড়াও হরতাল করে ফেললেও আদালতের রায়ের হেরফের হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। মহাজোট সরকারের প্রধান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী চরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে ওই অযৌক্তিক হরতাল করতে দেওয়ার পরও এটাই বাস্তব যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দুই পক্ষের আলোচনাই মাত্র নির্ধারক হতে পারে। গায়ের জোরে কোনো কিছুই করা যাবে না। দুই পক্ষকে আলোচনায় বসেই এ প্রশ্নে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে হবে।
তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর বিসমিল্লাহ যেহেতু রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র ও স্বাধীনতার প্রশ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সে দুটি প্রশ্ন অমীমাসিংত থেকে যাওয়ার অর্থ দাঁড়াবে নতুন করে একটি মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া।
এককালে পুরোহিততন্ত্রের স্থান ছিল রাজতন্ত্রের ওপরে, রাজা ছিলেন পুরোহিতের আজ্ঞাধীন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সেকাল আমরা অতিক্রম করে এসেছি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল সম্প্রতি ঢাকায় রূপসী বাংলা হোটেলে (হোটেল শেরাটন) কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এককালে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল আজ সব ধর্মের মানুষকে সমান মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে।
রাজতন্ত্রের অচলায়তন ভেঙে যে মানুষ নেপালে বুকের রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, সে মানুষকে রাষ্ট্র তার ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে সমান মর্যাদা ও সম্মান দেবে। তা আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এটাই তো প্রকৃত গণতন্ত্র। সেখানে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের রক্তদান বৃথা যায়নি। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লড়াকু মানুষকে আমরা আর কতকাল তার প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত রাখব?
০৭.৬.২০১১
No comments