সরকারের ভেতরে কি আরও সরকার আছে? by আবদুল মান্নান

আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী তো বটেই, সারা দেশের মানুষেরই ব্যাপক আগ্রহ আছে। সরকার রাজি না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন সেখানে সেনা মোতায়েন করতে পারেনি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনে কি কোনো প্রভাব ফেলবে? নির্বাচন কি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে?


এ নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

যদিও স্থানীয় সরকার সংস্থার একটি নির্বাচন, তার পরও এটা নিয়ে বাড়তি আগ্রহ এ জন্য যে নবগঠিত নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের কে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হবেন। তা ছাড়া রাজধানীর কাছেই হওয়াতে আরও বেশি আগ্রহ যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বড় দুটি দলের স্থানীয় নেতারা এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এখানে আওয়ামী লীগের দুজন প্রার্থী: একজন শামীম ওসমান, যাঁকে সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আরেকজন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সমর্থন পেয়েছেন। আর আছেন বিএনপির সমর্থিত একক প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর এটিই প্রথম নির্বাচন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্যও এটি বড় এবং সম্ভবত শেষ নির্বাচন। তাই নির্বাচন কমিশন, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই এটা বড় পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশনকে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন করতে হবে। কেননা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব মূলত তাদেরই। সাধারণ ভোটাররাও তা-ই চান। তা ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন কারণে এ নির্বাচন নিয়ে বিপুল আবেগ-উদ্দীপনাও জেগেছে। এই অবস্থায় সবাই চেয়েছে নির্বাচনে কোনো রকম বিঘ্ন না ঘটুক। সে জন্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
এসব কারণেই একাধিক প্রার্থী, ভোটার ও নির্বাচন কমিশনসহ সবাই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন। এবং আইনতও সেই দাবি তাঁরা করতে পারেন। শুক্রবার পর্যন্ত ধারণা ছিল যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। সবকিছু মোটামুটি ঠিকই ছিল। এর মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিতভাবে সেনা মোতায়েন হয়নি। এই অঘটনে নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা হতাশ হয়েছেন আর দেশবাসীর অনেকেই হয়েছেন শঙ্কিত। এ থেকেই সন্দেহ জেগেছে, নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হবে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেছেন, সরকার যেহেতু তাঁদের চাহিদামতো সেনা মোতায়েন করেনি, সেহেতু কোনো গোলযোগ হলে তার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়।
প্রশ্ন হলো, এ রকম অবস্থায় দায়িত্বটা তাহলে কে নেবে? সংগত কারণেই সরকারের দিকেই দায়টা ঝুলে থাকবে।
অনেক সময় দেখা যায়, সরকারের মধ্যেও সরকার কাজ করে। সরকারের ভেতর অন্য কোনো শক্তি সরকারের অনেক ভালো কাজকে নষ্ট করে দেয়। এদের জন্য পুরো সরকারই বিপাকে পড়ে। এখানেও সে রকম হয়েছে কি, যার জন্য সরকার একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো? এর আগে মাগুরা উপনির্বাচনে বিগত চারদলীয় জোট সরকার এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যথেষ্ট বিপত্তির জন্ম দিয়েছিল এবং তার খেসারতও তাদের দিতে হয়েছিল। এখানেও আমরা আরেকটি মাগুরা-ধরনের নির্বাচন চাই না।
উত্তেজনা ও অশান্তির পরিস্থিতিতে কখনো কখনো সেনাবাহিনী একটা প্রতিরোধক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রথমে সেনাবাহিনী দেওয়া হয়নি। পরে তাদের মোতায়েন করা হয় এবং তার ফল ভালোই হয়। এই নির্বাচনেও সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারত।
আমরা আশা করব, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো গোলযোগ হবে না এবং নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী নির্ভয়ে ভোট দিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনই শেষ নির্বাচন নয়, ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচন আসছে। তার জন্য ভোট-প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার সরকারি সামর্থ্য ও সদিচ্ছার ওপর জনগণের আস্থা নির্ভর করবে। এই নির্বাচন তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছিল।
সরকার বলছে, আগামী নির্বাচন নির্বাচিত সরকার অথবা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে। যার অধীনেই হোক, সে রকম একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, সেই আস্থার প্রমাণ তো সরকারকেই দিতে হবে। না হলে সরকারের যুক্তি ধোপে টিকবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যা যা করার দরকার ছিল, তা না করে সরকার ভুলই করল বলে আমাদের ধারণা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি প্রতিষ্ঠা করতেও এই নির্বাচনে তার পরীক্ষা দেওয়া যেত। আমি মনে করি, এখনো পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে যায়নি। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করে সরকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
আমাদের আইনে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও একই কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটা নষ্ট করা মানে বিশেষ কোনো কারণে একটা ভুল সংকেত দেওয়া। এ অবধি সরকার বলেনি, কোন কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিল। যদি নির্বাচনে কোনো অঘটন ঘটে, তাহলে এ রকম সিদ্ধান্তের খেসারত তাদের দিতে হতে পারে।
মানুষ এখন অনেক সচেতন, শুধু দলীয় সমর্থনের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে না। মানুষ এখন নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করছে, নিজস্ব পছন্দের প্রার্থী বেছে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হচ্ছে। তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.