ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাধীনতা পদক : তাৎপর্য ও প্রস্তাব by কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাদেশে ২০১১ সালের স্বাধীনতা দিবসে যাঁরা স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্যতম। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সরকারের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'শিক্ষা আর গবেষণার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফল নেতৃত্ব দিয়েছে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক আর কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের সফল নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতি লাভ করেছে স্বাধীনতার সূতিকাগার হিসেবে।' এর সঙ্গে হয়তো আরো যোগ করার রয়েছে, তবে পৃথিবীর খুব বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো এ ধরনের পদক পায়নি, কিংবা তাদের সম্পর্কে এ ধরনের ভূয়সী প্রশস্তি-বাচন করা হয়নি। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৩১ মার্চ, ২০১১, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন।
তবে আমার বিনীত অভিমত হচ্ছে, ঘটনাটি যত অর্থপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ, স্বয়ং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আয়োজন তাকে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত করেনি। ক্যাম্পাসে তা কোনো সাড়া জাগিয়েছে বলে মনে হয়নি। এ কথা বলছি এ কারণে যে ঘটনাটিকে তার পূর্ণ ও সঠিক তাৎপর্যে দেখা না হলে এবারের এই পদকের দাতাদের মহৎ অভিপ্রায় যেমন ব্যর্থ হয়ে যাবে, এর উদ্দেশ্য-লক্ষ্যও থেকে যাবে অনর্জিত। এ ঘটনাকে তার অভিপ্রেত গুরুত্বে দেখার চেষ্টা এখনো করা যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলার চেষ্টা যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি একে শুধুই একটি নির্দিষ্ট মহলের একটি কর্মকাণ্ড বলার প্রবল মনোভাবকেও। মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করাটাও ঠিক এই মনোভাবের সঙ্গে যুক্ত। যেন দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো চরিত্র-নির্ধারক পটভূমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছিল না, যেন এটি একটি বিশিষ্ট জনযুদ্ধ ছিল না! যেন কিছুসংখ্যক নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ মানুষের তৎপরতার মধ্য দিয়েই তা শুরু হয় এবং শেষ। যাঁরা ওই দাবিটি করেন, তাঁরাই পাকিস্তানি কায়দায় এ দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনের স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন। স্পষ্টভাবেই এ দেশে এ রকম সব ঘটনা পরস্পর যুক্ত এবং ঠিক এই পটভূমিতে রেখে দেখলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এবারের স্বাধীনতা পদক প্রদানের প্রকৃত ও বৃহত্তর তাৎপর্য স্পষ্ট হবে। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-জনতার নানা আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ছিল; কিন্তু সেটা মোটেই সব নয়। এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে জ্ঞানগতভাবে এতদঞ্চলের সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘকালব্যাপী সেই প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য সেটা ছিল ভিন্ন এবং আরো দীর্ঘ প্রস্তুতি ও যুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমিক আয়োজনের এই পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতে না দেখলে কখনোই তা ইতিহাসের সঠিক সংজ্ঞাসম্মত হবে না। কোনো সংকীর্ণ কারণে নয়, এতদঞ্চলে শিক্ষা ও জ্ঞানের শীর্ষ পীঠ হিসেবেই এ সত্যটি নির্দেশ করতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, এর শিক্ষক-অধ্যাপকদের। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যে ব্যাপক জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে শুধু নয়, তাদের জ্ঞানভিত্তিক অগ্রযাত্রার পরিণতিতেই নিশ্চিত হয়েছে, এ সত্য প্রতিষ্ঠা করাটাও জরুরি প্রয়োজন। আর সেখানেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের বিশেষ গুরুত্ব। এটি একটি আদর্শিক বার্তা, দার্শনিক ঘোষণা। বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শিক লক্ষ্যকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভূমিকাটিও তাঁদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কিছু বিষয়ে মতবিনিময় করেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও মান, বিশেষত গবেষণার সংখ্যা ও মান নিয়ে আলোচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের এ ব্যাপারে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমার ধারণা, স্বাধীন দেশে ঠিক এসবই হতে পারে শীর্ষ বিদ্যাপীঠের ভূমিকা। এ জন্য আর্থিক সমর্থনের প্রয়োজন হওয়াটাই সম্ভব; প্রধানমন্ত্রী সে ব্যাপারেও শিক্ষক সমিতির নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন। সম্প্রতি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধির আশ্বাস দেওয়ার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথাও তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন। আর এও হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আরেকটি অবস্থান, প্রধানমন্ত্রী, যা সম্প্রতি গ্রহণ করেছেন। সংগতিপূর্ণ এটাও যে শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, শিক্ষা খাতে ব্যয় জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আরো বলেছেন, এ খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ এবং সরকারের বাজেটের ২০ ভাগ ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। আমার ক্ষুদ্র অভিমত হচ্ছে, জ্ঞানের প্রসার ব্যতীত অতীতে আমাদের অগ্রগতি হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এই চিন্তার মোহনাতেই আমাদের সব সিদ্ধান্তকে যুক্ত করতে হবে। সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রণেতা ও রূপকার_দুই-ই হতে হবে; সঠিক নেতৃত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতিসহ মুক্ত ও আলোকিত দেশ গড়ার লক্ষ্যে অবিচলভাবে এগোনোর জন্য শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ যেমন সরকারকে বাড়াতেই হবে, তাকে সদ্ব্যবহারের দৃষ্টান্তও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আসতে হবে। আমার আশা, সারা দেশের বহু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন।
তাই প্রস্তাব করছি, সময় আর গড়ানোর আগেই অর্থাৎ এ বছরের স্বাধীনতা পদক প্রদানের রেশ বজায় থাকতে থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পর্যায়ে এবং মানানসইভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করুক, যেখানে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা উপস্থিত করবে। প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো ও আর্থিক সমর্থন চিহ্নিত করবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সানুগ্রহে সেখানে উপস্থিত হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদাসহ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সরকারের আর্থিক সমর্থনের নীতিগত ঘোষণা প্রদান করবেন। সম্ভব হলে সরকার আসন্ন বাজেটেই সে ঘোষণার কিছুটা প্রতিফলন ঘটাবে। এ ধরনের চিন্তায় সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তবে এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান ও ঘোষণা প্রদান হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের মহৎ ভিশনের পক্ষে আবশ্যকীয়ভাবে পরিপূরক। অন্যথায় একটি মহৎ চিন্তা তার দার্শনিক ও বাস্তব লক্ষ্য অর্জনে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হবে। আশা করি, এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নেতৃত্ব ব্যর্থ হবেন না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিং দ্রুত উন্নয়নের প্রয়োজন সম্পর্কেও চারদিকে যে আলোচনা, প্রস্তাবিত এ পদক্ষেপ সে ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তবে আমার বিনীত অভিমত হচ্ছে, ঘটনাটি যত অর্থপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ, স্বয়ং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আয়োজন তাকে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত করেনি। ক্যাম্পাসে তা কোনো সাড়া জাগিয়েছে বলে মনে হয়নি। এ কথা বলছি এ কারণে যে ঘটনাটিকে তার পূর্ণ ও সঠিক তাৎপর্যে দেখা না হলে এবারের এই পদকের দাতাদের মহৎ অভিপ্রায় যেমন ব্যর্থ হয়ে যাবে, এর উদ্দেশ্য-লক্ষ্যও থেকে যাবে অনর্জিত। এ ঘটনাকে তার অভিপ্রেত গুরুত্বে দেখার চেষ্টা এখনো করা যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলার চেষ্টা যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি একে শুধুই একটি নির্দিষ্ট মহলের একটি কর্মকাণ্ড বলার প্রবল মনোভাবকেও। মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করাটাও ঠিক এই মনোভাবের সঙ্গে যুক্ত। যেন দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো চরিত্র-নির্ধারক পটভূমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছিল না, যেন এটি একটি বিশিষ্ট জনযুদ্ধ ছিল না! যেন কিছুসংখ্যক নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ মানুষের তৎপরতার মধ্য দিয়েই তা শুরু হয় এবং শেষ। যাঁরা ওই দাবিটি করেন, তাঁরাই পাকিস্তানি কায়দায় এ দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনের স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন। স্পষ্টভাবেই এ দেশে এ রকম সব ঘটনা পরস্পর যুক্ত এবং ঠিক এই পটভূমিতে রেখে দেখলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এবারের স্বাধীনতা পদক প্রদানের প্রকৃত ও বৃহত্তর তাৎপর্য স্পষ্ট হবে। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী-জনতার নানা আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ছিল; কিন্তু সেটা মোটেই সব নয়। এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে জ্ঞানগতভাবে এতদঞ্চলের সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘকালব্যাপী সেই প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য সেটা ছিল ভিন্ন এবং আরো দীর্ঘ প্রস্তুতি ও যুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমিক আয়োজনের এই পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতে না দেখলে কখনোই তা ইতিহাসের সঠিক সংজ্ঞাসম্মত হবে না। কোনো সংকীর্ণ কারণে নয়, এতদঞ্চলে শিক্ষা ও জ্ঞানের শীর্ষ পীঠ হিসেবেই এ সত্যটি নির্দেশ করতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, এর শিক্ষক-অধ্যাপকদের। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যে ব্যাপক জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে শুধু নয়, তাদের জ্ঞানভিত্তিক অগ্রযাত্রার পরিণতিতেই নিশ্চিত হয়েছে, এ সত্য প্রতিষ্ঠা করাটাও জরুরি প্রয়োজন। আর সেখানেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের বিশেষ গুরুত্ব। এটি একটি আদর্শিক বার্তা, দার্শনিক ঘোষণা। বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শিক লক্ষ্যকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভূমিকাটিও তাঁদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কিছু বিষয়ে মতবিনিময় করেছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও মান, বিশেষত গবেষণার সংখ্যা ও মান নিয়ে আলোচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের এ ব্যাপারে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমার ধারণা, স্বাধীন দেশে ঠিক এসবই হতে পারে শীর্ষ বিদ্যাপীঠের ভূমিকা। এ জন্য আর্থিক সমর্থনের প্রয়োজন হওয়াটাই সম্ভব; প্রধানমন্ত্রী সে ব্যাপারেও শিক্ষক সমিতির নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন। সম্প্রতি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধির আশ্বাস দেওয়ার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথাও তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন। আর এও হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আরেকটি অবস্থান, প্রধানমন্ত্রী, যা সম্প্রতি গ্রহণ করেছেন। সংগতিপূর্ণ এটাও যে শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, শিক্ষা খাতে ব্যয় জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আরো বলেছেন, এ খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ এবং সরকারের বাজেটের ২০ ভাগ ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। আমার ক্ষুদ্র অভিমত হচ্ছে, জ্ঞানের প্রসার ব্যতীত অতীতে আমাদের অগ্রগতি হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এই চিন্তার মোহনাতেই আমাদের সব সিদ্ধান্তকে যুক্ত করতে হবে। সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রণেতা ও রূপকার_দুই-ই হতে হবে; সঠিক নেতৃত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতিসহ মুক্ত ও আলোকিত দেশ গড়ার লক্ষ্যে অবিচলভাবে এগোনোর জন্য শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ যেমন সরকারকে বাড়াতেই হবে, তাকে সদ্ব্যবহারের দৃষ্টান্তও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আসতে হবে। আমার আশা, সারা দেশের বহু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন।
তাই প্রস্তাব করছি, সময় আর গড়ানোর আগেই অর্থাৎ এ বছরের স্বাধীনতা পদক প্রদানের রেশ বজায় থাকতে থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত পর্যায়ে এবং মানানসইভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করুক, যেখানে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা উপস্থিত করবে। প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো ও আর্থিক সমর্থন চিহ্নিত করবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সানুগ্রহে সেখানে উপস্থিত হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদাসহ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সরকারের আর্থিক সমর্থনের নীতিগত ঘোষণা প্রদান করবেন। সম্ভব হলে সরকার আসন্ন বাজেটেই সে ঘোষণার কিছুটা প্রতিফলন ঘটাবে। এ ধরনের চিন্তায় সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তবে এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান ও ঘোষণা প্রদান হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা পদক প্রদানের মহৎ ভিশনের পক্ষে আবশ্যকীয়ভাবে পরিপূরক। অন্যথায় একটি মহৎ চিন্তা তার দার্শনিক ও বাস্তব লক্ষ্য অর্জনে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হবে। আশা করি, এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নেতৃত্ব ব্যর্থ হবেন না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিং দ্রুত উন্নয়নের প্রয়োজন সম্পর্কেও চারদিকে যে আলোচনা, প্রস্তাবিত এ পদক্ষেপ সে ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments