শ্রদ্ধাঞ্জলি-পিতা, তোমার জন্মদিনে

অনেকভাবেই পিতা কবি মঈনুদ্দীন হোসাইনকে স্মরণ করা যায়। এক সংগ্রামী সাহসী মানুষ, তাঁকে তাঁর আদর্শিক জীবনের জন্য অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে আরাধ্য মানুষ হিসেবে বুকের মধ্যে লালন করা যায়। ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই মানুষটি খুব ছোটবেলায় হারিয়েছিলেন তাঁর মা-বাবাকে।
মা-বাবার সর্বকনিষ্ঠ এই সন্তান ভালোবাসার স্থান দুটিকে হারিয়ে মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতার মতো এক বিশাল নগরে নিজের প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন জীবিকার তাড়নায় ভাগ্যান্বেষণে। ছোটবেলার হিরু মিয়া বড় হতে হতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মঈনুদ্দীন এবং পরিণত বয়সে নিজেকে একজন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন সেই বিভাগ-পূর্ব ভারতে।
শুধু লেখক হিসেবে নন, তখনকার দিনের বিভিন্ন সময়ের সামাজিক আন্দোলনে তাঁর আগুয়ান ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে পিতা মঈনুদ্দীন নিজেকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বিলেতি কাপড় শরীরে না জড়িয়ে খদ্দরের পোশাক পরতে শুরু করেছিলেন।
স্বদেশি আন্দোলন ছাড়াও তৎকালীন নারীর সামাজিক স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রশ্নে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সোচ্চার। যুবক মঈনুদ্দীন মাত্র ১১ বছরের এক মেয়েকে বিয়ে করে কলকাতায় এসে শুধু সাংসারিক কাজে আবদ্ধ না রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের কথা স্মরণ করা এই নারী মুক্তির প্রশ্নে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামাল যাঁদের সহযোগিতায় সব বাধা অতিক্রম করে বাইরের উন্মুক্ত পৃথিবীতে পা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সওগাত সম্পাদক শ্রদ্ধেয় নাসিরুদ্দীন সাহেব এবং কবি মঈনুদ্দীন ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ১৯২০ সাল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল নবযুগ পত্রিকা অফিসে, যখন নজরুল যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করছিলেন। ১৯২৩ সালে মঈনুদ্দীন ‘মোসলেম জগতে বিদ্রোহ’ নামক সম্পাদকীয় প্রকাশের জন্য কারারুদ্ধ হলেন। নজরুলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় এবং সখ্য গড়ে ওঠে এই হুগলি জেলেই।
কবি মঈনুদ্দীনের এক অনবদ্য গ্রন্থ যুগ স্রষ্টা নজরুল। এটা নজরুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ নয়, নজরুলের জীবনের যে ঘটনাগুলোর সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, সেগুলোই তিনি এখানে বিশদভাবে বর্ণনা করে গেছেন। কবি নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার বিয়ে পড়িয়েছিলেন মঈনুদ্দীন হোসাইন এবং এই বিয়ের প্রধান সাক্ষী ছিলেন কবি মঈনুদ্দীন। নজরুলের জ্যেষ্ঠ পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর মতো আরও অনেক বিপর্যস্ত ঘটনার সঙ্গে মঈনুদ্দীন জড়িত ছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেমন তিনি তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনি একসময় পাকিস্তান সরকারের অন্যায় বিমাতাসুলভ আচরণে প্রতিবাদী হয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজস্ব ভূমিকার মধ্য দিয়ে।
বিভাগ-পূর্ব ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি সংগত কারণেই বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠেছিল। স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পৃথক এক জাতি হিসেবে চিন্তাভাবনার ফলে একসময় পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু পরে তাদের সেই শুভ চিন্তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল। আশাহত পিতা মঈনুদ্দীন তীব্র প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন যুদ্ধের নয় মাস। পুরোনো শহরে তাঁর বিরাট বাড়ি, বিশাল পারিবারিক গ্রন্থাগার—সবকিছু পেছনে ফেলে তিনি স্বভূমিতে সেই স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে, সবার সঙ্গে একাত্মতার ব্যগ্র প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
কবি মঈনুদ্দীন তাঁর সাহিত্যিক জীবনে যেমন একজন সার্থক লেখক এবং ব্যক্তি-ভুবনে তিনি ছিলেন এক স্নেহময় পিতা। এই লেখার মধ্য দিয়ে আমি তাঁকে দুভাবে লেখার এবং দেখার চেষ্টা করেছি।
‘বাবা! আজ অনেক বছর পরে এখনো অনুভব করতে পারছি আপনার বৃষ্টিতে ভেজা বুকের উষ্ণতা। প্রবল বৃষ্টিপাত! কেমন করে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরবেন লাইব্রেরি থেকে। আকুল চোখে আমি তাকিয়েছিলাম শিকবিহীন জানালা দিয়ে। আপনি ফিরলেন, জানলেন আমার আকুলতা। বুকের উষ্ণতায় সেদিনের সেই ছোট্ট আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেই ভালোবাসার উষ্ণতায় আমি আজও এগিয়ে চলেছি।’
খুরশীদ জাহান

No comments

Powered by Blogger.