শেয়ারবাজার : লুটপাটের আখড়া by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথা ভেবে খুব দুঃখ পাই। আরো বেশি দুঃখ পাই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে অভিভাবকহীন দেখে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এতটা এতিম, এতটা অসহায় আর পরিচর্যাহীন যে পৃথিবীর যেকোনো দেশের অর্থনীতিবিদ বা অর্থনীতি বোঝেন এমন কেউ আমাদের দেশে এসে আশ্চর্য হবেন।


এতিম, যার মা-বাবা কেউ নেই, তাকেও দেখাশোনা বা পরিচর্যা করার জন্য খালা, ফুফু, চাচি, দাদি, নানি, সমাজ অথবা রাষ্ট্র_কেউ না কেউ থাকে। কিন্তু এতিম, অসহায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দেখার যেন কেউ নেই। বলা যায়, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখন পরিণত হয়েছে লুটপাটের সোমনাথ মন্দিরে_মধ্য যুগে যেমন ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এলে মুসলিম সেনাপতিরা প্রথমেই লুট করে নিতেন সোনা-গয়নায় ভরা সোমনাথ মন্দির। সুলতান মাহমুদ থেকে শুরু করে প্রত্যেক মুসলিম শাসকই ভারতবর্ষ জয় করতে এসে সোমনাথ মন্দির লুট করেছিলেন। আওয়ামী লীগের পরপর দুই মেয়াদে শেয়ারবাজারে লুটপাট হয়ে যাওয়া দেখে সোমনাথ মন্দিরের কথাই মনে পড়েছে কেবল।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের এই লুটপাট দেশকে আজ দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে_এক পক্ষে আছে লুটেরা, কালোবাজারি, চোরাকারবারি আর অবৈধ ব্যবসায়ী, যারা শেয়ারবাজারের সবটুকু ঐশ্বর্য লুট করে যাপন করছে এখন উৎকৃষ্ট জীবন। অন্যদিকে নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর জীবনে পতিত হয়েছে গরিব শ্রমিক, সাধারণ শিক্ষক, গাড়িচালক, অফিসের কেরানি_এঁরা সামান্য টাকা-পয়সা নিয়ে নেমেছিলেন শেয়ারবাজারে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ এক অদ্ভুত অর্থনীতিশাসিত দেশে বাস করছি আমরা। আমাদের বাংলাদেশে 'অর্থনীতি'র সংজ্ঞা বইতে যেভাবে লেখা আছে, সেই কাঠামোয় পরিচালিত হয় না। আমাদের দেশে সব উল্টো। অর্থের সঙ্গে নীতির কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের দেশে। অর্থ আর নীতি আমাদের দেশে পরস্পরের শত্রু।
বাংলাদেশই পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যে দেশে ৩৩ জন মানুষ শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুটে নিয়ে টাকার স্তূপের ওপর বসে থাকে আর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আত্মীয়-পরিবার মিলে মোট এক কোটি মানুষ শেষ সম্বল হারিয়ে হাহাকারে মেতে থাকেন। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর টাকা শেয়ারবাজার থেকে লুটে নিয়ে অল্প কয়েকজন লোক চমৎকার বাড়িতে থাকছে, গাড়িতে চড়ছে, সিঙ্গাপুর যাচ্ছে, চায়নিজ খাচ্ছে, ক্ষমতার চেয়ার আলোকিত করছে; আর অসংখ্য মানুষ টাকা হারিয়ে অশ্রু, শোক, মৃত্যু, মাতম, দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারকে জীবনের সঙ্গী করেছেন। বাংলাদেশের মতো এতটা অসহায়, অভিভাবকহীন, এতিম শেয়ারবাজার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। প্রতিটি দেশে অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, স্টক এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান, ব্যবসায়ী, খুদে বিনিয়োগকারী_সবাই শেয়ারবাজারের অভিভাবক। কিন্তু আমাদের দেশে, আগেই বলেছি, অর্থনীতি বইয়ের ভাষায় চলে না। বাংলাদেশে বরং অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আর স্টক এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান_কারো সঙ্গে কারো যেন যোগাযোগ নেই। সকাল-দুপুর-রাতে একেকজনের একেক রকম কথায়, শেয়ারবাজার লুটপাট হয়ে যাওয়ার পর, গত অর্ধবছরে সূচক নামতে নামতে আকাশ থেকে এখন পাতালে গিয়ে ঠেকেছে। এই সময়ের মধ্যে রাস্তায় নিয়মিত গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, বিক্ষোভ হয়েছে, সমাবেশ হয়েছে, মন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে, কিভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়ে বাজারে এসে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে লাখ লাখ মানুষ, তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে, পথে বসে যাওয়া হাজারো মানুষের কাহিনী শোনানো হয়েছে, তদন্ত কমিটি হয়েছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বেরিয়েছে এবং এর পর তদন্ত কমিটির প্রধানকে নিয়ে টানাহেঁচড়াও হয়েছে। কিন্তু যেটা সবচেয়ে মূল বিষয়, শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য লুটপাটকারীদের কবে নাগাদ বিচার হবে, তা আজও জানা যায়নি। অথচ সর্বস্ব হারানো বিনিয়োগকারীদের অনেকে আওয়ামী লীগেরও কর্মী। আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছিলেন যে ড্রাইভারটি, ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন, এখন তিনি সর্বস্বান্ত। ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। গরিব কেরানি আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছিলেন গত নির্বাচনে। সারা জীবন চাকরি করে পেনশনের কিছু টাকা পেয়েছিলেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে এখন বুকের ঠিক বাঁ পাশে ব্যথা অনুভব করছেন। ১০ বছর বিদেশে ঝাড়ুদারের চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়ে দেশে এসে শেয়ারবাজার থেকে কিছু লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছিলেন চট্টগ্রামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী।
আজকের আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে গত নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে ভোট দেওয়া ভোটারদের একাংশ তো শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগকারী। তাই তাঁদের দলীয় সরকারের আমলে শেয়ারবাজার লুটপাটের একটা বিহিত-ব্যবস্থা তাঁরা আশা করেছিলেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। অথচ তিনি কি না বলেছেন, শেয়ারবাজার হচ্ছে ফটকাবাজি। কিন্তু বিশ্বের যেকোনো উন্নত দেশের অর্থনীতির সূচকের অনেক কিছুই নির্ভর করে সে দেশের পুঁজিবাজারের ওপর। ছোট ছোট জলকণা যেমন করে গড়ে তোলে সাগর-মহাসাগর, তেমনি লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা অর্থ নিয়ে গড়ে ওঠে দেশের পুঁজিবাজার। একটি দেশের পুঁজিবাজার যত সমৃদ্ধ, সে দেশের অর্থনীতির চিত্র তত মজবুত। শেয়ারবাজার তাই অর্থনীতির কোনো বিচারেই ফটকাবাজি নয়। এটা স্রেফ ব্যবসা। নিয়ন্ত্রণহীন ছিল বলে লুটেরার দল শেয়ারবাজার লুটপাট করেছে, যেমনটি পাহারাদার না থাকলে ক্ষেত-খামারেও হয়ে থাকে। লুটেরার দল সব সময় তক্কে তক্কে থাকে। হোক সেটি রাজস্ব বোর্ড, কাস্টমস, বন্দর কিংবা শেয়ারবাজার। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে লুটপাট চলবেই। অতীতেও চলেছে, ভবিষ্যতেও চলবে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও এ রকমই হয়েছে। ওপরের মহলের নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলেই পাহারাদাররাই বরং শেয়ারবাজারে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই শেয়ারবাজারকে আর রক্ষা করা যায়নি। এর পর শেয়ারবাজারের পাহারাদারদের কাউকে কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্টক এঙ্চেঞ্জে, বাংলাদেশ ফান্ড নামের পাঁচ হাজার কোটি টাকার ফান্ড বাজারে আনা হয়েছে। কিন্তু মূল কাজ যেটা, সেটা আজও করা হয়নি। সেটা হচ্ছে শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ,
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া
shahnewaybiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.