সাদাকালো-একজন শহীদ 'বীর-উত্তম'-এর কথা by আহমদ রফিক

পঁচিশে মার্চ, ১৯৭১ আমাদের জাতীয় জীবনে শুধু এক ক্রান্তি সময়ই নয়, পাকিস্তান সামরিক জান্তা দেশপ্রেমিক বাঙালিকে 'সম্মুখ সমরে' এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, 'যুদ্ধে জয় অথবা মৃত্যু' এমন এক শপথে বলীয়ান হতে সাহায্য করেছিল। ছাত্র-যুবা রাজনীতিকদের হাতে সূচিত 'মুক্তিযুদ্ধ' স্বাধীনতার লক্ষ্যে ক্রমে জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। দলীয় চেতনা ও মতাদর্শের ঊধর্ে্ব ভাষিক ভুবনের চেতনা বা আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে উঠেছিল।


পেছন ফিরে তাকিয়ে পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী দিনগুলোর কথা ভাবতে গেলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, একে একে মহল্লা থেকে চেনামুখ, তরুণ মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, ওদের আর দেখতে পাই না। একসময় জানতে পারি, ওরা দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে লড়াইয়ে অংশ নেবে বলে। প্রাণে বজ্রকঠিন সংকল্প : 'হয় মুক্তি না হয় মৃত্যু'। এ চেতনা স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ তাদের শিখিয়ে দেয়নি। দলবহির্ভূত এ তরুণদের সবাই ঘরে ফেরেনি। যেমন ফেরেনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন দলভুক্ত তরুণের অনেকে। ওরা শহীদ। আবার লড়াইয়ের আঁচ গায়ে লাগা বা না লাগা নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষও ঘটনার আলামত লক্ষ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। ঘরে ফিরেছে কী ফেরেনি, সে হিসাব অনেকেরই জানা নেই।
তবে রাজনীতিমনস্ক তরুণ, রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সদস্য নয়, এমন অনেকে আদর্শগত তাড়নায় বা হানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। সাহস ও প্রবল ইচ্ছা তাদের তাড়িত করেছে। বহুকথিত একটি বাক্য : স্বাধীনতা এমন এক জাদুকরি বোধ, যে বোধের টানে ঘরের নিশ্চিন্তি ছেড়ে অনায়াসে বেরিয়ে পড়া চলে, আত্মদানে বিন্দুমাত্র দ্বিধা কাজ করে না। কবি তখন গুন গুন করে উঠতে পারেন : 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান।'
আজ এমন একজন সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, স্বাধীনতা-পাগল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কথা বলব, যার নাম বহু প্রচারিত নয়, অথচ রণাঙ্গনে যাঁর বীরত্ব তাঁকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' উপাধিতে ভূষিত করতে পারত। হয়তো অসময়ে (সেপ্টেম্বর ৪) মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে তা হয়নি। আমরা তাঁকে 'বীর উত্তম' শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া নামে জানি। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যে তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তিনি সেসবেরও অধিক।
খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার জন্ম ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার মালাপাড়া গ্রাম। সরকারি চাকুরে পিতা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া, মা তাবেন্দা আখতার। বড় ভাই কামাল উদ্বিগ্ন ভূঁইয়া পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে অফিসার হিসেবে কর্মরত, একাত্তরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি জীবনযাপন করেছেন। বেশ কয়েকজন ভাইবোনের অসচ্ছল সংসার। হয়তো তাই ১৯৭০ সালে এমকম পরীক্ষা শেষ করে এমবিএ কোর্সের নৈশ বিভাগে ভর্তি হয়েও প্রয়োজনের তাগিদে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন-রূপসী বাংলা) অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ নেন। একসঙ্গে চাকরি ও পড়াশোনা।
শুরু হয়ে গেল পঁচিশে মার্চের বর্বর কালো অধ্যায়। কর্মস্থলে দাঁড়িয়ে যা কিছু সম্ভব দেখেন এবং বুঝে নেন রাজনীতিমনস্ক তরুণ নিজামউদ্দিন। এক মাসেরও কম সময়। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করেন নিজাম। সংসারের দায়, নিজের ভবিষ্যৎ জীবন তথা ক্যারিয়ার সব পেছনে পড়ে থাকে। এপ্রিলের ১৯ তারিখ, ঢাকা থেকে বেরিয়ে নিজ এলাকা হয়ে গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করেন নিজামউদ্দিন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর।
উদ্দেশ্য স্পষ্ট। মাতৃভূমি বাংলার মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। আমরা জানি, পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক খেলার প্রতিক্রিয়ায় এবং সেই সঙ্গে তীব্র জাতীয়তাবাদী আবেগে তরুণদের কাছে ছয় দফা তখন এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত। সে পরিস্থিতিতে নিজামের পক্ষে চুপচাপ কাজ ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
কারণ নিজাম ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষা-আন্দোলন, ষাটের দশকের গণআন্দোলন, এমনকি ঊনসত্তরের উপপ্লবেও তিনি সক্রিয় কর্মী, নেতৃস্থানীয় কর্মী। জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধক আবেগ তাঁর রক্তে। তাই ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে তাঁর স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হঠাৎ আবেগের তাড়নায় নয়, নয় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণে।
পরিস্থিতি বিচারে ঠিকই বুঝতে পারা যায়, ভেবেচিন্তে হিসাব-নিকাশ করেই স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন নিজামউদ্দিন। কারো উপদেশ বা পরামর্শে নয়, বলতে হয় প্রাণের আবেগে। এ বিষয়ে তাঁর সংবেদনশীল কবিচেতনা হয়তো তাঁকে সাহায্য করেছে, তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কারণ আমরা দেখেছি, এ দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলনের পথনির্দেশ করেছে এবং সাংস্কৃতিচর্চার ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রচারীর ভূমিকা_সাহিত্য সংগীত, গায়ন-বাদন সব কিছু নিয়ে।
আর আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি, কমার্স তথা ব্যবসা-বাণিজ্য বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তরুণ নিজামউদ্দিন কবি, সংগীত অনুশীলনে আগ্রহী একজন গিটারবাদক। এমনকি সম্পাদনা করেন 'কালচক্র' নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা। নামটি বলা বাহুল্য অমোঘ তাৎপর্যে চিহ্নিত। আপাদমস্তক সংস্কৃতিসেবী এই তরুণটিকে আমরা দেখতে পাই স্বাদেশিকতায় উজ্জীবিত একজন জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক হিসেবে_যার কণ্ঠে উত্তেজক স্লোগান উচ্চারিত হতে পারে : 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'
হ্যাঁ, গিটার ছেড়ে, কবিতা লেখার কলম ছেড়ে, এমনকি হিসাববিজ্ঞানের কলমটিও ছুড়ে ফেলে নিজামউদ্দিন ভঁূইয়া অর্থাৎ মুহসীন হলের বাসিন্দা রোমান্টিক তরুণের পরিচয় হয়ে ওঠে অস্ত্র হাতে এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। 'লাঙল ফেলিয়া বাহে' কঠিন হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সঙ্গে নিজামউদ্দিনের অস্ত্র তুলে নেওয়ার ঘটনায় আসমান-জমিন ফারাক এবং তা সচেতনতার গুণগত অর্থে। ওই যোদ্ধা কৃষককে ছোট করা নয়, দেশপ্রেম-বীরত্ব_দুইয়ের মধ্যে তেমন ফারাক না থাকলেও রয়েছে সচেতনতার বিচারে, রাজনীতিমনস্কের বিবেচনায়।
একবার মনস্থির হয়ে গেলে কাজ সহজ হয়ে ওঠে। এপ্রিল থেকেই শুরু হয়ে যায় নিজামউদ্দিনের স্বাধীনতাযুদ্ধের ট্রেনিং_মূলত আগরতলার ইন্দ্রনগর অবস্থান থেকে। ট্রেনিং শেষে সিলেটে চার নম্বর সেক্টরে নিজামউদ্দিনের যোদ্ধাজীবন শুরু। তার মনোবল, মানসিক দৃঢ়তা ও সাহস অধিনায়কের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দায়িত্ব পান জালালপুর সাব-সেক্টরে সহঅধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার। তাঁর অধীনস্থ দলটিতে ছিল ৪৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধা।
মূলত কানাইঘাট অঞ্চলের বিভিন্ন অ্যাডভান্স ক্যাম্প থেকে নিজামউদ্দিন যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর সাহস ও প্রেরণা সহযোদ্ধাদের প্রাণিত করতে পেরেছে বলে অনেক জয় অর্জন নিজামউদ্দিনের দলের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। একের পর এক জয় কি মুক্তিযোদ্ধা নিজামউদ্দিনকে যুদ্ধের ঠাণ্ডা হিসাব-নিকাশ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল, তাঁকে পেয়ে বসেছিল ক্রমাগত 'অ্যামবুশের' তাড়না? যে জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের পরিণাম সম্বন্ধে ভেবে দেখার অবকাশ হয়নি তাঁর।
আর ওই 'একিলিস-বিন্দুতে'ই পাতা ছিল সর্বনাশের ফাঁদ। তাই জয়ের প্রবল নেশা মাথায় নিয়ে প্রধানত মানসিক শক্তি, সাহসে ভর করে অসমশক্তির যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হন নিজামউদ্দিন তাঁর ছোটখাটো মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে নিয়ে। দিনটি ছিল একাত্তরের ৪ সেপ্টেম্বর। স্থান কানাইঘাট থানার মন্তাজনগর ক্যাম্পের অধীন সড়কের বাজার।
যতদূর জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ওই অভিযান ছিল সত্যই অসমশক্তির যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক বিরাট সেনাদল। কিন্তু সংযোগ সূত্রের একটি পুল উড়িয়ে দিতে পারার সাফল্যে নিজামউদ্দিনের দলটি সম্মুখ যুদ্ধের জন্য উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সহযোদ্ধাদের অনেকে নিরাপদ অবস্থানে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজি নন কমান্ডার।
যুদ্ধের রীতিনীতিতে পশ্চাদপসরণ স্বীকৃতপন্থা, বিশেষ করে যখন মুখোমুখি সংঘাতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদনে অনেক পড়েছি_'মিত্রবাহিনীর সফল পশ্চাদপসরণ'। অর্থাৎ প্রয়োজনে দুই পা পিছু হটে সুবিধাজনক সময়ে এক পা এগিয়ে গেলেও অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়।
কিন্তু তরুণ কমান্ডার নিজামদ্দিনের রক্তে যখন যুদ্ধের উন্মাদনা, সেখানে 'আগুন জ্বালা শক্তি'। তাই পিছু হটতে পারেননি, বলা যায় পিছু হটতে চাননি অধিনায়ক নিজামউদ্দিন। ওই সম্মুখযুদ্ধে দুপক্ষেরই যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। বড় ক্ষতি হলো মুক্তিযোদ্ধা দলের। হঠাৎ গোলার আঘাতে অধিনায়ক নিজামউদ্দিনের মৃত্যু, সেই সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধারও মৃত্যু। ওরা সবাই শহীদ।
কানাইঘাট স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর শহীদ খাজা নিজামউদ্দিনকে স্থানীয় মানুষ তাদের মাটিতে ধরে রেখেছে, শ্রদ্ধায়-মর্যাদায় একান্ত আপনজনের মতো করে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত রয়েছে একাধিক এলাকার নতুন নামকরণে_সে নাম 'নিজামউদ্দিন'। অন্যদিকে শহর কুমিল্লায় পুলিশ লাইন থেকে কান্দীরপাড় পর্যন্ত রাস্তার নাম 'শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন সড়ক'। আর স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর সাহস ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে 'বীর উত্তম' (মরণোত্তর) উপাধিতে।
তবু আমরা কয়জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজামউদ্দিনের কথা জানি? ইতিহাসে কতটা স্থান পেয়েছেন শহীদ নিমাজউদ্দিন? অথচ তাঁর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সিআর দত্ত, যিনি তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন, সুপারিশ করেছিলেন নিজামউদ্দিনকে 'বীর শ্রেষ্ঠ' উপাধিতে সম্মানিত করতে, মূলত তাঁর সাহসিকতা, বীরত্ব ও গভীর দেশপ্রেমে শাহাদত বরণের জন্য।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে ওই সুপারিশ করা হয়েছিল। আমরা একই কারণে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে আহ্বান জানাই_নিজামউদ্দিনের সাহসী কর্মকাণ্ডের জন্য মক্তিযুদ্ধে তাঁর আবেগদীপ্ত আত্মদানের জন্য তাঁকে 'বীরশেষ্ঠ' উপাধিতে ভূষিত করা হোক। তাতে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হবে না। এমনকি অন্য বীরশ্রেষ্ঠদের সঙ্গে তুলনায় এ দাবি অসংগতও হবে না। যদি তা হতো, তাহলে সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডার এ দাবি তুলতেন না। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। অনেক বছর আগে (১৯৮৯) এমন দাবি তুলেছিলেন মননশীল সাহিত্যিক, ফোকলোর বিশেষজ্ঞ শাসসুজ্জামান খান দৈনিক 'সংবাদ'-এ একটি দীর্ঘ লেখায়। লিখেছিলেন আরো কয়েকজন। সেসব মনে রেখেই আমাদের এ যৌক্তিক দাবি।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.