পরিবেশ বিপর্যয়-এই স্বেচ্ছাচার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে

প্রতিবছরের মতো এবারও ৫ জুন মোটামুটি সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। 'বন : প্রকৃতি আপনার সেবায়'_এই প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে বহু বক্তৃতা, বিবৃতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে। অথচ এই দিনে বিভিন্ন পত্রিকায় যে কয়টি খবর চোখে পড়েছে, তা মোটেও সুখকর নয়।
নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে, বন ধ্বংস করা হচ্ছে, আবাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ায় বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাহলে এমন ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালনের অর্থ কী? সার্থকতা কোথায়?
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কোনো দেশে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে আছে ১০ শতাংশেরও কম। তাও স্বাভাবিক বন নয়_ একাশিয়া, ইউক্যালিপটাসসহ বিদেশি গাছের বন, বাণিজ্যিকভাবে রাবার চাষের বন অথবা অর্থমূল্য আছে এমন কাঠগাছের বন। হাজার বছর ধরে বাংলার প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির বন নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অবস্থা দেখলে একটা প্রবাদ মনে পড়ে, তা হলো 'কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।' আইনে আছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটখোলা থাকতে পারবে না। অথচ কেবল চুনতি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও টেকনাফ গেম রিজার্ভের প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে ১৮টি ইটখোলা। এরা ইট বানানোর জন্য পাহাড়ের মাটি কাটছে আর ইট পোড়ানোর জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটছে। আইনে আছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো করাতকল বসানো যাবে না। কিন্তু কেবল সখীপুর উপজেলায়ই ৪৮টি করাতকল আছে, সংরক্ষিত বন থেকে যেগুলোর দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়, মাত্র ২০০ মিটার। একই চিত্র দেখা যায় মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, কঙ্বাজারসহ সারা দেশে।
বাংলাদেশের বনাঞ্চল প্রাকৃতিকভাবেও অনেক বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করছে। সিডরের সময় সুন্দরবনের প্রায় ২৫ শতাংশ গাছপালা নষ্ট হয়েছিল। আইলায়ও সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই বেশি করে নোনা পানি সুন্দরবনে ঢুকছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে না পেরে সুন্দরীসহ সুন্দরবনের বহু গাছ মরে যাচ্ছে। আবার উত্তরাঞ্চলে অতিরিক্ত খরার কারণে গাছপালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর বন বিভাগের এক শ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী বন ধ্বংসের কাজে যথেষ্ট তৎপর। সেখানে নিম্নতম কর্মচারী থেকে শুরু করে টাকার বালিশওয়ালা সিসিএফ পর্যন্ত জড়িত থাকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বন থাকবে কিভাবে, আর বন্য প্রাণীই বা থাকবে কিভাবে?
বন, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের আরেকটি বড় কারণ ক্রমবিকাশমান শিল্প-কারখানাগুলোতে নূ্যনতম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা। এতে রাসায়নিক ও বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে বা প্রকৃতিতে মিশে যায়। মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো গাড়ির অবাধ চলাচল ও অতিরিক্ত পরিমাণে হাইড্রোকার্বন নির্গমন হয়। এসব কারণে সারা বিশ্বে রাজধানী ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এখনো যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে খুব বেশিদিন নেই, যেদিন কেবল ঢাকা নয়_পুরো বাংলাদেশই বসবাসের অযোগ্য স্থান হিসেবে এক নম্বরে চলে যাবে। আমরা কি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব? নাকি পরিবর্তনের চেষ্টা করব?

No comments

Powered by Blogger.