বাণিজ্যিক কোচিং এবং... by সুব্রত কুমার দাস

বাংলা বা ইংরেজি_যে ভাষায়ই হোক না কেন, 'কোচিং' শব্দটি কিন্তু ইতিবাচক। প্রাতিষ্ঠানিক 'টিচিং' এবং দেশে প্রচলিত 'কোচিং'-এর অভিধানগত পার্থক্য না খুঁজেও আমরা বুঝতে পারি, 'কোচিং' জিনিসটা আসলে কী। কিন্তু বিদ্যালয় ভবন এবং শ্রেণীকার্যক্রম সময়ের বাইরে শিক্ষকের বাসায় শিক্ষার্থীদের আগমন বা শিক্ষার্থীদের বাসায় স্বয়ং শিক্ষকের গমন তো সুদূর


অতীতে কোনো গর্হিত কাজ ছিল না! এখনো তো তেমনটি হওয়ার কথা নয়। ইতিহাসজুড়ে এবং বিশ্বজুড়েও এমন কাজের যথেষ্ট নজির বর্তমান। নিকট অতীতের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সেটা খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জীবনের। তাঁর জীবনভিত্তিক উপন্যাস 'আর্ভিং স্টোন'-এর 'লাস্ট ফর লাইফ' যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মিন্ডেজ কোস্টার কথা মনে আছে। পণ্ডিত কোস্টাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ভিনসেন্টকে লাতিন ও গ্রিক শেখানোর জন্য। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষকের কথাও তো সবার জানা। এতগুলো বিষয়ের জন্য এমন বাছা বাছা গৃহশিক্ষক না দেওয়া হলে কবি রবির কী দুর্গতি হতো, তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ আছে বৈকি! কিন্তু আজকের লেখাটির প্রসঙ্গ শিক্ষা নিয়ে হলেও রয়েছে ভিন্নতা, যে ব্যাপারে ছোট-বড় সবাই উদ্বিগ্ন। উদ্বেগের কারণ, এর বাণিজ্যিকীকরণ। আর এ কারণেই এটা নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্প্রতি এত সোচ্চার। প্রশ্ন হলো, বিদ্যালয় ভবনে প্রয়োজনমতো শিখতে ব্যর্থ হয়ে সেটা অন্য উপায়ে পুষিয়ে নেওয়া দোষের হবে কেন! দোষটা আসলে ভিন্ন কারণে। কারণটা বাণিজ্যিক। শিক্ষকতা আজ অধিকাংশতই বাণিজ্যে পর্যবসিত। ভালো শিক্ষকের ভালো কাজের সত্যিকারের মর্যাদা খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বর্তমানে দিয়ে থাকে। ভালো কাজের মূল্যায়ন না করায় অসৎ শিক্ষক উৎসাহিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসৎ শিক্ষককে নিরুৎসাহিত করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয় না। অভিযোগ, তেমন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীকে বাধ্য করেন শিক্ষকের বাসায় যেতে। না গেলে পরীক্ষায় নম্বর কমে যায়। আর সেসব কাজে ব্যস্ততার কারণে শিক্ষক তাঁর দায়িত্ব অর্থাৎ শ্রেণীকার্যক্রমে অমনোযোগী হন।
একটি উদাহরণ দেই। আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু ততদিন নিশ্চিন্ত ছিলেন, যতদিন তাঁর মেধাবী ছেলের ওপর শিক্ষকের (কু)নজর পড়েনি। ধানমণ্ডিতে বাসা, স্কুল পিলখানায়। অঙ্ক-ইংরেজির মতো বিষয়ে ছেলেটি আগে থেকেই শিক্ষকের বাসায় যেত। এবারকার জনের বিষয় ইসলামী শিক্ষা। অকারণে পরীক্ষায় নম্বর কমে যায়। কারণ, জিজ্ঞেস করায় শিক্ষক হুমকিও দিয়েছেন। ছেলেকে শুধু নয়, বাপকেও। উপায় খুঁজে না পেয়ে সরল-সোজা মানুষটি অবশেষে মনের দুঃখে ছেলের স্কুল বদলালেন। বিশাল মাঠের স্কুল থেকে তাকে নিয়ে গেলেন চার দেয়ালে আটকানো এক ভবনে, যেখানে টিফিনও খেতে হয় ক্লাসরুমে বসে। আগে মাসিক বেতন ছিল ৫০০ টাকা। নতুন বিজ্ঞাপনসর্বস্ব স্কুলে সেটা হাজার পনেরো। নিয়ে যাওয়ার কারণ, সেখানে নাকি প্রাইভেট পড়তে হয় না। কিন্তু নিজে ব্যবসায়ী হয়েও বুঝতে পারেননি শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা মানুষের কৌশল। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশে এত উচ্চ মাসিক বেতনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের '২০২১ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে' স্লোগান যে কত বড় মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে, তা আগে থেকে বোঝেননি আমার বন্ধু। ঢুকেই পড়লেন বিপদে। ছেলের নতুন স্কুল যা করবে বলে, তা করে না। স্কুলশেষে যে শিক্ষক পড়ান (প্রাইভেটের বদলে) তাঁর মেধা ও যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন বন্ধুটি। ছেলেকে তিনি নিয়ে গেলেন মনিপুর স্কুলে। ততদিনে তাঁর বাসা গেছে শেরেবাংলানগরের দিকে। হায়রে ভাগ্য! মনিপুর স্কুলের কাণ্ড তো এখন দেশবাসীর জানা। পঞ্চম শ্রেণীতে মেধাবৃত্তি পাওয়া ছাত্রটির এমন দুর্দশা হলে সাধারণদের অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আমার চেনা আরেকজনের কথা জানি। তার অঙ্ক শিক্ষকের কথা শুনবেন? কোচিং সেন্টারে তাঁর ভাষা হলো_"শুনো মেয়েরা, আজ থেকে তোমরা কেউ 'সুদ' বলবা না। 'সুদ' হলো হিন্দুর ভাষা, আর মুসলমানের ভাষা হলো 'মুনাফা'।" ঢাকা শহরে বসে একজন সরকারি স্কুলের শিক্ষক কোচিং সেন্টারে এমন ভাষণ দিচ্ছেন! সরকার থেকে এমপিওর টাকা না নেওয়া স্কুলগুলোর ঔদ্ধত্য সম্পর্কে অবহিত বলেই আগেভাগেই শিক্ষামন্ত্রী হুশিয়ারি উচ্চারণ করে রেখেছেন। গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোচিং বন্ধে আদালতের রায় সংক্রান্ত যে বৈঠক হয়, তার বিবরণ ছাপা হয়েছিল পরদিন সব দৈনিকে। কেননা, তিনি জানেন, টাকা না নিলেও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের প্রচলিত বিধি অনুসরণ করতে বাধ্য। তবে তাঁকেও মনে রাখতে হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের এই আচরণের পেছনের শক্তিও নিহিত কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসেই। আগের সরকারের শিক্ষামন্ত্রী তো এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকের দেওয়া একটি পাজেরো গাড়ি মন্ত্রিত্বকালের পুরো সময়টা ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই স্কুলের কর্তৃপক্ষ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকেও গাড়িতে চড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে নিয়মিত। এসব স্কুল-কলেজে আবার টিচার ট্রেনিংয়ের নামে মক শো চলে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তারা আসেন এবং প্রশিক্ষকরা এক দিনের পারিশ্রমিক বাবদ নগদ টাকার সঙ্গে এত বেশি উপঢৌকন পান যে, ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
এবার শিক্ষকদের কিছু জঘন্য কর্মকাণ্ডের উদাহরণ দেই। মহানগরীর একটি প্রধান সারির প্রতিষ্ঠান প্রচলন করেছে অসাধারণ এক ব্যবস্থা_কোচিং না করলে বিশেষ ভাতা। প্রতিষ্ঠানের বিশাল ভাণ্ডার থেকেই সেটা মেটানো হয়। অথচ দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক কোচিংও করান এবং চালুকৃত বিশেষ ভাতাও নেন। ঢাকার বাইরে কর্মরত বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক সপ্তাহে অর্ধেকের বেশি দিন ঢাকায় অবস্থান করেন শুধু কোচিং চালানোর জন্য। মহানগরীর বাইরে কর্মরত তেমন কত শতাংশ শিক্ষক ঢাকায় বা অন্য মহানগরীতে সপ্তাহের অধিকাংশ দিন কাটান, তা কখনো হিসাব করে দেখা হয়নি। কিন্তু দেখা দরকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যেসব ক্ষেত্রে আমাদের ধীর অগ্রগতি, সেগুলোর একটি হলো শিক্ষাক্ষেত্র। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটি বিপুল উদ্যমে দীর্ঘকালের জঞ্জাল সাফ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর আগেরবারের মন্ত্রিত্বকালেই। এবারও তিনি কাজ করে চলেছেন সততা ও নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবেই। তাঁর প্রশংসাযোগ্য কাজের তালিকা আরো দীর্ঘ হোক_এমনটি সব সজ্জন ও বিদ্বজ্জনেরই প্রত্যাশা।
লেখক : গবেষক

No comments

Powered by Blogger.