সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বাস্তবায়ন by শামসুল হুদা

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বীর ভাষা শহীদদের অকাতরে প্রাণ বিসর্জনে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠোর সংগ্রামে নির্যাতিত-আত্মত্যাগী ভাষাসংগ্রামীদের অসাধারণ অবদানে এত বড় বিজয় অর্জনের পরও আমরা দেশে সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রয়োগ ও প্রচলন করতে সক্ষম হইনি। বাংলা ভাষাকে এখনও আমরা কাঙ্ক্ষিত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারিনি।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই কেবল আমরা বাংলা ভাষার ব্যাপারে তৎপরতা দেখাই। তারপর ভুলে যাই। আমাদের এ ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করে তার আশু সমাধান এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রজ্ঞাপন জারি করে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করতে হবে। দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তিনামা ইত্যাদি বাংলায় লিখতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, কৃষি-প্রযুক্তির বই-পুস্তক বাংলায় প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তা জনপ্রিয় করে তুলতে কর্মসূচি নিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সংকোচন নীতি দূর করতে হবে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এ ভাষার ব্যবহার হয়ে থাকে। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষ ক্ষেত্রে ইংরেজির ব্যবহার গ্রহণযোগ্য। কারণ, আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ইংরেজিরই সহযোগিতা নিতে হয়। বাংলা ভাষাকে আরও গঠনমূলক ও দ্রুত অনুধাবনের জন্য পরিচর্যা ও অনুশীলনের প্রয়োজন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠান, ইন্টারনেট, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য করে তুলতে হবে। একুশের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে ধারণ করে বাংলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই উগ্র মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা রোধ করা সম্ভব।
বাঙালি জাতির একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এখন বিশ্বের দুইশ'র অধিক দেশে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন হচ্ছে। বাংলা ভাষা সারাবিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এ দেশের মানুষের মরণজয়ী ভাষাসংগ্রামের ফসল হিসেবেই গণআন্দোলনের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও প্রতিষ্ঠা। এ স্বাধীনতা সার্থক রূপ নেবে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার সর্বস্তরে প্রচলন ও প্রসারের মাধ্যমে। এ জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করে আমাদের আন্তরিকভাবে নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

শামসুল হুদা : ভাষাসংগ্রামী, '৫২ সালে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর

No comments

Powered by Blogger.