ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট by আবু সাইয়িদ
১৯৬৯ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি মুখ্য হয়ে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে।
মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে সেনা-ঘাতকের হাতে শহীদ হন। এ অবস্থায় সারা বাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ১৭ ফেব্রুয়ারি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরে পেঁৗছে। এক পর্যায়ে দালালদের বাসা ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। লাঠিচাজর্, টিয়ার গ্যাস। পদ্মা তীরে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ। ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আহত হয় ছাত্র-জনতা। এ নিয়ে জেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ড. জোহার বিতণ্ডা হয়। লাঠিচার্জে আহত ছাত্রদের নিজ গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করান। তার সাদা শার্ট ছিল ছাত্রদের তাজা রক্তে সিক্ত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত। ঐদিন রাতেই বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত 'ভাষা ও সাহিত্য' সপ্তাহ পালনের জন্য আয়োজিত সভা প্রতিবাদ সভায় রূপান্তরিত হয়। সে সভা পুলিশি গুণ্ডামির বিরুদ্ধে ছিল বিক্ষুব্ধ। ছাত্ররা গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা ভাঙার।
১৮ ফেব্রুয়ারি। শাহ্ মুখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সিদ্ধান্তের কথাটি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহাকে তার বাসভবনে গিয়ে জানালে তিনি বের হয়ে আসেন। ড. জোহা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে আসেন, তখন নাটোর রোডের দিকে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেছে। ড. জোহার সঙ্গে আরও কতিপয় শিক্ষক ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এমআর সরকার, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. আবদুল খালেক, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আবদুল রাজ্জাক, প্রফেসর জুলফিকার মতিন প্রমুখ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের নাটোর রোড থেকে সরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। ছাত্ররা যখন ফিরে আসছিল ঠিক সে মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতক সৈনিকরা গুলিবর্ষণ করে। ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। সেদিনের ছাত্র নূরুল ইসলাম রাজশাহী শহরে নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুল খালেক, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, ড. কাজী আবদুল মান্নান প্রমুখ। ড. জোহার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ একযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন, যা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। অচল হয়ে পড়ে দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের দাবির মুখে তৎকালীন উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনের চত্বরে সমাহিত করতে বাধ্য হন। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিবসটি পালিত হয় না। সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উত্তর জনপদে পড়ে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোহার অসামান্য আত্মবলিদানকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, হচ্ছে। এ ধরনের অবমূল্যায়ন ক্রমাগতভাবে দেশকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানবতাবাদী, সংস্কৃতবান একজন মানুষ আত্মজ-অঙ্গীকার রেখেই দেশ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। বৃহত্তর স্বার্থে এসব মানুষ নিজেকে করে তোলেন তুচ্ছ এবং নিঃস্বার্থ। '৬৯-এর যে কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ তারই ফলশ্রুতি। যেখানে বৈষম্য, অনাচার থাকবে না, থাকবে মুক্তির নব নব দিগন্ত। অথচ রাজনীতির দুষ্টু চক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তা ও স্বশাসনের বাতাবরণ সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশা ক্ষমতা অর্জনের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছেন। দলবাজি, কোন্দল আর মিথ্যা অহমিকা শিক্ষাঙ্গনকে গ্রাস করেছে। শিক্ষাকে পেশা হিসেবে না দেখে কমিটমেন্ট হিসেবে দেখার সময় এসেছে। ড. জোহার সমগ্র জীবনটাই ছিল কমিটমেন্টের। সমকালীন ইতিহাসে তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার বল্গু-প্রিন্ট, অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তার স্বশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। ড. জোহার আত্মদান গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। 'তারা কোনোদিন পরিত্যক্ত_ আমাদের মতো বুড়িয়ে যাবে না, বয়সের ভার তাদের ক্লান্ত করবে না, সময় করবে না বাতিল
সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় এবং প্রত্যুষে আমরা তাদের স্মরণ করব।'
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ :সাবেক
তথ্য প্রতিমন্ত্রী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত। ঐদিন রাতেই বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত 'ভাষা ও সাহিত্য' সপ্তাহ পালনের জন্য আয়োজিত সভা প্রতিবাদ সভায় রূপান্তরিত হয়। সে সভা পুলিশি গুণ্ডামির বিরুদ্ধে ছিল বিক্ষুব্ধ। ছাত্ররা গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা ভাঙার।
১৮ ফেব্রুয়ারি। শাহ্ মুখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সিদ্ধান্তের কথাটি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহাকে তার বাসভবনে গিয়ে জানালে তিনি বের হয়ে আসেন। ড. জোহা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে আসেন, তখন নাটোর রোডের দিকে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেছে। ড. জোহার সঙ্গে আরও কতিপয় শিক্ষক ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এমআর সরকার, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. আবদুল খালেক, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আবদুল রাজ্জাক, প্রফেসর জুলফিকার মতিন প্রমুখ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের নাটোর রোড থেকে সরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। ছাত্ররা যখন ফিরে আসছিল ঠিক সে মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতক সৈনিকরা গুলিবর্ষণ করে। ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। সেদিনের ছাত্র নূরুল ইসলাম রাজশাহী শহরে নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুল খালেক, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, ড. কাজী আবদুল মান্নান প্রমুখ। ড. জোহার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ একযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন, যা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। অচল হয়ে পড়ে দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের দাবির মুখে তৎকালীন উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনের চত্বরে সমাহিত করতে বাধ্য হন। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিবসটি পালিত হয় না। সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উত্তর জনপদে পড়ে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোহার অসামান্য আত্মবলিদানকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, হচ্ছে। এ ধরনের অবমূল্যায়ন ক্রমাগতভাবে দেশকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানবতাবাদী, সংস্কৃতবান একজন মানুষ আত্মজ-অঙ্গীকার রেখেই দেশ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। বৃহত্তর স্বার্থে এসব মানুষ নিজেকে করে তোলেন তুচ্ছ এবং নিঃস্বার্থ। '৬৯-এর যে কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ তারই ফলশ্রুতি। যেখানে বৈষম্য, অনাচার থাকবে না, থাকবে মুক্তির নব নব দিগন্ত। অথচ রাজনীতির দুষ্টু চক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তা ও স্বশাসনের বাতাবরণ সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশা ক্ষমতা অর্জনের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছেন। দলবাজি, কোন্দল আর মিথ্যা অহমিকা শিক্ষাঙ্গনকে গ্রাস করেছে। শিক্ষাকে পেশা হিসেবে না দেখে কমিটমেন্ট হিসেবে দেখার সময় এসেছে। ড. জোহার সমগ্র জীবনটাই ছিল কমিটমেন্টের। সমকালীন ইতিহাসে তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার বল্গু-প্রিন্ট, অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তার স্বশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। ড. জোহার আত্মদান গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে। 'তারা কোনোদিন পরিত্যক্ত_ আমাদের মতো বুড়িয়ে যাবে না, বয়সের ভার তাদের ক্লান্ত করবে না, সময় করবে না বাতিল
সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় এবং প্রত্যুষে আমরা তাদের স্মরণ করব।'
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ :সাবেক
তথ্য প্রতিমন্ত্রী
No comments