ভাষার বিকৃতি

বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির কথা ভাবতে হবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের গর্বের পরিচায়ক। তিনিও বিশ্বসভায় সমাদৃত। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কিংবা পল্লীকবি জসীমউদ্দীন আমাদের প্রাণের সঙ্গে মিশে আছেন।


জীবনানন্দ আমাদের প্রকৃতির কাছে টানেন, শামসুর রাহমান আমাদের নাগরিক জীবনের কথা বলেন, স্বাধীনতার পাঠ দেন। এঁরা তো বাংলা ভাষার অহঙ্কার। সেই ভাষার সম্মানের জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাসও আমাদেরই সালাম, বরকত ও জব্বার তৈরি করেছেন। বিশ্বের সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবেও আমাদের বাংলা ভাষা নিঃসন্দেহে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। তাই তো ভিনদেশি ভাষা গবেষকদের আসতে হয় এই বাংলায়। তাঁদের খোঁজ করতে হয় লালন, হাসন কিংবা তাঁদেরই উত্তরসূরিদের সৃষ্টিকে। এই বাংলা ভাষা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনের ভাব প্রকাশেও ব্যবহৃত হয়। অথচ এমন একটি সমৃদ্ধ, সুন্দর এবং মর্যাদাপূর্ণ ভাষাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে কিছু মানুষ। এই ধ্বংসের প্রচেষ্টা বিনোদন কিংবা প্রচার সুবিধার জন্য অপরিহার্য_এমন বলারও অবকাশ নেই। কয়েক বছর ধরে আমাদের এখানে বেসরকারি মালিকানাধীন রেডিও এবং কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নতুন প্রজন্মের কিছু কর্মী এই আঘাতগুলো করে চলেছে। বিদেশি বিশেষ করে ইংরেজি শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের উচ্চারণ মিশেল দিয়ে অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করে শ্রোতাদের বিনোদন প্রদানের চেষ্টা করছে তারা। তাদের এই বিকৃত ধারাকে মানুষ কখনো সহজে মেনে নেয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনা চলে আসছিল। পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু প্রচারকারী কর্তৃপক্ষ সেদিকে কান দেয়নি। সর্বশেষ উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে এই ক্ষত থেকে আমাদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য। স্পষ্টভাবে হাইকোর্ট বলেছেন, বিকৃত বাংলা উচ্চারণে কোনো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা যাবে না। আদালত ভাষার এই অবক্ষয় রোধ করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন, যাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেও যুক্ত করা হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে আইনজ্ঞদেরও। প্রথম দিবসেই আদালত এ সম্পর্কিত মতামত শুনেছেন বিশিষ্ট কয়েকজন আইনজীবীর কাছ থেকে। সেখানে স্পষ্টত ঐকমত্য লক্ষ করা গেছে আইনজীবী ও আদালতের মধ্যে। আদালত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে কমিটি গঠনের জন্য যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন তাকেও যুগোপযোগী বলতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে আদালতের দেওয়া আরেকটি প্রস্তাবও অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত। কারণ সেখানে বিশেষজ্ঞমহলের যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। যদিও কমিটি প্রধান অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে সদস্য কো-অপ্ট করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ২০ মার্চের মধ্যে আদালতে এ বিষয়ে মতামত উপস্থাপনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোকে ইতিমধ্যে বিকৃত উচ্চারণে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে নিষেধও করেছেন আদালত। এমন পরিস্থিতিতে আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বিকৃত উচ্চারণে বাংলার ব্যবহার ছেড়ে দেবে।
তাদের বোঝা উচিত বিকৃত উচ্চারণে বাংলার ব্যবহারে বিনোদন বৃদ্ধি হয় না। বরং যাঁরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসেন তাঁদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই এই বিকৃত ভাষার অর্থও বুঝতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে শুধু ভাষা রক্ষাই নয়, তাদের অধিকাংশ দর্শক এবং শ্রোতার কথা বিবেচনা করে শুদ্ধ উচ্চারণের দিকে খেয়াল করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.