রাজনীতি-ক্ষমতা রক্ষা ও আরোহণের খেলা by কামাল লোহানী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা থেকে ফিরে বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতেই হবে। সেই সঙ্গে অবশ্য এটাও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন অবাধ হবে।... এ কথা বিরোধী দল তো কোনোভাবেই মানছিল না। কারণ আমরাও জানি, সর্বোচ্চ আদালত আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার সুপারিশসহ পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শ বাধ্যতামূলক ন রোগশয্যায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়া কি ছাড়া যায়? তবে পড়ার বিষয়গুলো


যখন নির্মম, নিষ্ঠুর হয়ে ফুটে ওঠে মুদ্রিত অক্ষরে, তখন অস্ত্রোপচারের যন্ত্রণার চেয়েও মানসিক কষ্ট বেড়ে যায় দ্বিগুণ। অনেক বিষয়ই চোখে পড়েছে কিন্তু লেখার মতো শারীরিক ক্ষমতা ছিল না। তাই প্রকাশিত সংবাদের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। অনেক বিষয়ই প্রকাশিত হয়েছে, যা নিয়ে পৃথকভাবে লেখা যায়, কিন্তু দুর্বলতার কারণে তা পারছি না। তাই সবগুলো মিলিয়ে একটা 'কোলাজ খেলা' তৈরি করলাম, পাঠক পড়ে মন্তব্য করবেন।
ক্ষমতাসীন মহাজোটকে তো আমরাই বসিয়েছিলাম রাত-দিন খেটে, তাকে যখন খুশি ভালোমন্দ বলতে পারি কারণ আমাদের অধিকার আছে। আমরা তো বলছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সমালোচনা করছি। সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে লড়ছি। বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল ও পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ করার দাবিতে রাজপথে রয়েছি। আদিবাসী জনগণকে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে লড়ছি। অর্পিত সম্পত্তি সেই ৪৬ বছর আগের আইয়ুব খানি জবরদখল ব্যবস্থা তাকে মালিকদের প্রত্যর্পণের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছি। ক্ষমতাসীন দল কখনও ক্ষুব্ধ হচ্ছে, কখনও সমালোচনা করছে। কিন্তু এসবই তো মহাজোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এবং জনগণ এসব কথা শুনেই বিপুলহারে ভোট দিয়েছিল।
সেই প্রতিশ্রুত বিষয়গুলো নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবলভাবে আস্থাবান হয়ে বর্তমান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এবং আদায়ের লড়াই করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে কোনো আপস নেই।
আবার এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে 'স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন' করা বিরোধীদলীয় নেতা, একাত্তরের ঘাতক দালাল জামায়াত-শিবির অর্থাৎ বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানিদের কসাই-জল্লাদদের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে এক জোট গড়েছেন, তারই জোরে পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং আমেরিকার মহব্বতে বলীয়ান হয়ে ধমক দিয়েছিলেন আগামী বছর সেপ্টেম্বরে 'মহাজোট সরকার' নাকি খতম! বিরোধী দলের নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন মাদাম খালেদা জিয়া কোনো খেলা না খেলেই একেবারে ফাইনাল খেলার একতরফা ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন। আমরা তো কেঁপেই উঠেছিলাম। মাদামের 'ধমক' তো_ পিলে চমকে উঠেছিল। এই বুঝি গেল, সব খতম হয়ে গেল।
কিন্তু না, মাদাম যে কথা বলে ফেলেছিলেন সে যে আবেগে বলেছিলেন, তা পরদিনই বুঝতে পারলাম। আসলেই তো দুই ছেলে আর নিজেদের নানা মামলা জটিলতায় ভদ্রমহিলা তো 'মানসিক ক্ষমতা' হারাবেনই। যে পরিবারের কোনো নামগন্ধ ছিল না, সেই পরিবারকে মৃত স্বামীর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যখন দেশটাকে কাউলা করে নেওয়ার কথা ভাবছেন সে সময় ক্ষমতাই মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর নানা দুর্নীতি মামলা চালু করতে শুরু করেছে এবং সবগুলোতেই ফেঁসে যাচ্ছে, তখন চক্রান্তের ভয় দেখাতে ছাড়লেন কেন? ... কিন্তু রাজনীতি যে ভিন্নতর পদ! এটা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তিনি তো ভাবেন, জামায়াত তার বন্ধু আছে, যা খুশি তাই বলে দিলেই হলো। তাই দেখলাম, পরদিন তার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভিন্ন গান গাইলেন। তখন বুঝলাম, মহাপ্রভু নাখোশ হয়েছে এমন ফাইনালের ঘোষণা দেওয়ায়। তাই মির্জা সাহেব সবার সামনে মাইকে আঙুল উঁচিয়ে 'শান্তিপূর্ণ'ভাবে নির্বাচনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটাবেন বললেন। গলায় কী জোর! নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ফাইনাল খেলব এবং সে ফাইনালই হবে মহাজোট সরকারের পতন। তাহলে নির্বাচনে কিছুতেই যাবেন না বলে 'দলমাতা' যে ঘোষণা জনগণের কাছে দিয়েছিলেন, তা কি গিলে খেয়ে ফেললেন, নাকি ওটা কথার কথা ছিল। নাকি 'নির্বাচন' আপনারা অবশ্যই করবেন। না করলে দলের কোনো অস্তিত্বই তো থাকবে না। দলের ভেতরেও এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে ঢের। সুতরাং খালেদা জিয়া যে নির্বাচনে যাবেন না বলেছিলেন, তার মহাসচিব কী করে সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাবেন বললেন। হায়রে দুর্ভাগা দেশ একজন নেত্রী জনগণকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা দিলেন এক আর ঘরোয়া এক সমাবেশে মির্জা সাহেব তাকে খণ্ডন করলেন।... করবেন না কেন? ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত হয়ে পারিবারিক রাজনীতির ঐতিহ্যকে সম্বল করে মির্জা ফখরুল উপজেলা, জেলা হয়ে কেন্দ্রে এসে পেঁৗছেছেন। বাড়ি তার বৃহত্তর দিনাজপুরে। 'দলমাতা'র কোনো প্রশ্ন আছে কি-না জানি না। তবে দলের অনেকে কেন্দ্রে বহুদিন থেকে পদটির জন্য লালায়িত ছিলেন কিন্তু তাদের সবাইকে কাত করে মির্জা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে ভারপ্রাপ্ত। মাদাম এই পলিটিক্সে বেশ ওস্তাদ, তাই খেলিয়ে নিচ্ছেন। আর মির্জাও বেশ 'চমৎকার' রাজনৈতিক ভাষায় বক্তৃতাবাজি, সমালোচনা, প্রত্যুত্তর ইত্যাদি দিয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছে, শিগগিরই ভারমুক্ত হয়ে যাবেন।
যাকগে এসব। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা থেকে ফিরে বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতেই হবে। সেই সঙ্গে অবশ্য এটাও বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন অবাধ হবে।... এ কথা বিরোধী দল তো কোনোভাবেই মানছিল না। কারণ আমরাও জানি, সর্বোচ্চ আদালত আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার সুপারিশসহ পরামর্শ দিয়েছেন। এ পরামর্শ বাধ্যতামূলক নয়। একে নির্ভর করেই বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে চলেছে। কিন্তু মাদামের চ্যালেঞ্জ_ ফাইনাল কিংবা মহাসচিবের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পতনের ঘোষণা শুনে কিছু একটা রহস্য এতে নিশ্চয়ই আছে বলে মনে হচ্ছে। না হলে প্রধানমন্ত্রীও বা এত জোরেশোরে 'বিরোধী দলকে আসতেই হবে' এমন কথা বললেন কিসের জোরে?

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.