ধর নির্ভয় গান-দেশে ফিরে আসা এবং একটি নাগরিক উপলব্ধি by আলী যাকের
আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দ্বারাই সম্ভব দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। যে কোনো সরকার বা রাজনীতিবিদের প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে মানুষকে এসব নাগরিক চেতনা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। মাঝে মধ্যে দুঃখজনক হলেও সত্য বলে মনে হয় যে, আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ নিজেরাই স্বেচ্ছাচারী, অপরিচ্ছন্ন এবং আইন ভঙ্গকারী। অতএব তারা কী করে সাধারণ মানুষকে এসব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলবেন, তা বোঝা কষ্টসাধ্য
আমি বেড়াতে ভালোবাসি। কেবল দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরেও। এই জগতে কত বিচিত্র দেশ রয়েছে! কত বিচিত্র মানুষ বাস করে সেখানে। রয়েছে কত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ভিনদেশে গেলে মনটা স্বভাবতই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আমি গত ৪০ বছর ধরে বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণ করেছি। প্রাচ্য, প্রতীচ্য সর্বত্র। আজ এই ক্ষণে একটি ব্যাপার বলতেই হচ্ছে যে, যতবারই আমি দেশ ছেড়ে বাইরে গেছি ততবারই দেশে ফিরে আসার জন্য মন আইঢাই করেছে। আমার পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবরা জানে, আমি দেশ ছেড়ে বিদেশে যাই আবার দেশে ফিরে আসার আনন্দটা উপভোগ করার জন্য। তা সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেই হোক কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেস, যুক্তরাজ্যের লন্ডন হোক কিংবা স্কটল্যান্ডের এডিনবরা, জাপানের টোকিও কিংবা চীনের বেইজিং। অথবা বাড়ির কাছের দিলি্ল কিংবা মুম্বাই। বড়জোর সাত থেকে দশ দিন। তারপরই বাড়ি ফেরার অস্থিরতা পেয়ে বসে আমাকে। মনে হয় দিন আর ফুরাতেই চায় না যেন। এই অতি সম্প্রতি আমি চীন ঘুরে এলাম। অদ্ভুত দেশ। অসাধারণ মানুষ। সদা হাস্যময়। একটাই মুশকিল। না আমি বুঝি ওদের, না ওরা বোঝে আমাকে। আমার চীনা বন্ধু যে ভাষায় কথা বলে তা আমি বুঝি না। আর আমি যে ভাষায় বলি তা সে বোঝে না। এবারে সঙ্গে করে কিছু ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। মাছ, মুরগি, শাকসবজি ইত্যাদির। রেস্টুরেন্টে গিয়ে এসব ছবি দেখিয়ে ক্ষুনি্নবৃত্তি করা যায়। কিন্তু এত হ্যাপায় না গিয়ে আমরা যে হোটেলে ছিলাম, অর্থাৎ একটি পাঁচতারা হোটেল, সেই হোটেলেই দু'বেলার খাওয়া সেরে নিতাম। রাস্তার ধারে অসংখ্য ছোট ছোট খাবারের দোকান। সেখানে নানাবিধ গরম গরম খাবার নিত্যই তৈরি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে খাবার দেখিয়ে বলতাম, এইটা দাও, ওইটা দাও ইত্যাদি এবং এই কথাগুলো বাংলাতেই বলতাম। কোনোই অসুবিধা হতো না। বোধ করি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ওপরে আর কোনো ভাষা নেই। মাঝে মধ্যে অবশ্য এই বোঝা-না-বোঝায় রীতিমতো কান্না পেত। এমতাবস্থায় প্রথম দিন সকালেই বিখ্যাত তিয়ান আনমেন স্কয়ার এবং নিষিদ্ধ নগরী দেখতে হোটেল থেকে হেঁটে বের হলাম। হোটেল থেকে এগুলোর দূরত্ব ১৫ কি ২০ মিনিটের হাঁটা পথ। অতএব কোনো অসুবিধাই হলো না। তিয়ান আনমেন স্কয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, সামনেই নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করার তোরণ। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর মিং রাজবংশ সম্পর্কে জানতে হলে কীভাবে জানব, এই নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ দেবদূতের মতো আমাদের দিকে এগিয়ে এলো ঝকঝকে এক যুবক। পরনে চশমা, বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমার নাম হ্যারি। তোমাদের যদি গাইডের প্রয়োজন হয়, আমি তোমাদের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। দরকষাকষি করে হ্যারিকে আমরা সঙ্গে নিয়ে নিলাম। বেশ ভালো ইংরেজি বলে এবং বোঝে। সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাস ওর প্রিয় বিষয়। অতএব গড়গড় করে বলে গেল অনেক কথা; যার কিছু হয়তো জানতাম, অধিকাংশই জানতাম না। একে একে নিষিদ্ধ নগরী, স্বর্গের উদ্যান, চা তৈরির গোপন কথা, গ্রেট ওয়াল, সবই দেখা হলো। তবে আমার আজকের কলাম যেহেতু ঘরে ফেরা নিয়ে, আমার ভ্রমণ বৃত্তান্তের ওপরে বিশদভাবে পরে কোনো এক সময় লিখব।
বেইজিংয়ে চার রাত কাটিয়ে গিয়েছিলাম কুনমিংয়ে। সেখানেও ভাষা নিয়ে কম কষ্ট পেতে হয়নি। তবে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল হোটেলের কর্তৃপক্ষ। সেখানেও আমরা একজন দোভাষীকে পেয়ে যাই। অতএব দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মেলে। ততদিনে, আমার যেমন স্বভাব, বাড়ি ফেরার জন্য মন কেমন করতে লাগল। কুনমিং বিমানবন্দরে রাত ১টায় আমি, সারা এবং আমাদের কন্যা শ্রিয়া যখন ঢাকার উদ্দেশে প্লেনে উঠলাম, তখন আমার মনে খুশি আর ধরে না। যেন কতদিন বাদে দেশে ফিরছি। বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টায় যখন ঢাকা বিমানবন্দরে হাওয়াই জাহাজ অবতরণ করল, তখন দৈহিকভাবে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ইমিগ্রেশন শেষে লাগেজ বহনকারী কনভেয়ার বেল্টের কাছে যখন এসে দাঁড়ালাম, তখন মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আলোর অপ্রতুলতা, মেঝের ওপরে কাগজ ছড়িয়ে পড়ে আছে যত্রতত্র, বাথরুমে যাওয়ার চেষ্টা করে ফিরে আসতে হলো দুর্গন্ধের জন্য। বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনার স্তূপ। সে এক হতশ্রী কাণ্ড। এই প্রথম নয়, যতবার বিদেশ থেকে বড় অস্থির হয়ে দেশের টানে ঢাকার বিমানবন্দরে এসে নেমেছি, ততবার আমাদের এই নোংরা পরিবেশ আমায় উত্ত্যক্ত করেছে। কেবল কি বিমানবন্দরে? ঢাকার রাস্তায় সর্বত্র আবর্জনার কোনো অভাব নেই। ঢাকার বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেটে ঢোকা অসম্ভব। অথচ এসব জায়গা পরিষ্কার রাখার জন্য কর্মী রয়েছে, যথেষ্ট কর্মী। তাহলে রাস্তাঘাট, সরকারি ভবন এসবের অবস্থা এমন বিচ্ছিরি কেন? অবশ্যই প্রথম দোষটি যায় কর্তৃপক্ষের ওপর। আমার মনে আছে, আমার জীবনে আমি একবারই ঢাকার মেয়রের দফতর 'নগর ভবন'-এ গিয়েছিলাম। সেখানকার মেঝের ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সিগারেটের খণ্ডাংশ, দেয়ালে পানের পিক অথবা চুনের দাগ দেখে আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসি। আমার ধারণা, ঢাকার তাবৎ পরিচ্ছন্নকর্মী ঢাকা পৌরসভার অন্তর্গত। অথচ পৌর পিতার দফতরই যদি এমন নোংরা থাকে, রাস্তাঘাট যদি হয় আবর্জনার আধার, তাহলে দেশকে যতই ভালোবাসি, কী করে মন উৎফুল্ল রাখি? তবে যদিও সাধারণভাবে আমরা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে এসব অব্যবস্থার জন্য দায়ী করতে পারি, এর সিংহভাগই কিন্তু বর্তায় আমাদের সাধারণ মানুষের উদাসীনতার ওপর। আমরা অবলীলায় অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, আমাদের উচ্ছিষ্ট এবং বর্জ্য সবকিছুই যত্রতত্র ছুড়ে ফেলি। আসলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষকে পরিচ্ছন্নতার ওপর নাগরিক চেতনা অথবা দায়দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো শিক্ষাই দেওয়া হয় না। এই শিক্ষার শুরু হওয়া উচিত বাল্যকাল থেকে। মানুষের রুচি এবং কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা বিলম্বে দিলে তার কোনো প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে না। অতএব আমরা অবলীলায় আবর্জনা নিক্ষেপ করি রাস্তাঘাটে। থুথু ফেলি যেখানে-সেখানে এবং যে আইন আমরা নিজেরাই আমাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা সৃষ্টি করি, তা ভঙ্গ করি নির্বিচারে। আজ যদি আমরা নিজেরাই সচেতন হয়ে উপরোক্ত অনভিপ্রেত কাজগুলো থেকে বিরত থাকি, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দ্বারাই সম্ভব দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। যে কোনো সরকার বা রাজনীতিবিদের প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে মানুষকে এসব নাগরিক চেতনা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। মাঝে মধ্যে দুঃখজনক হলেও সত্য বলে মনে হয় যে, আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ নিজেরাই স্বেচ্ছাচারী, অপরিচ্ছন্ন এবং আইন ভঙ্গকারী। অতএব তারা কী করে সাধারণ মানুষকে এসব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলবেন, তা বোঝা কষ্টসাধ্য।
জনসাধারণের সমাগম যেসব স্থানে হয়ে থাকে সে জায়গাগুলোকে পরিষ্কার রাখার দুটি উপায়_ ১. আমরা নিজেরাই সচেতন হয়ে স্থানগুলোকে অপরিচ্ছন্ন করব না; ২. যথাযথ কর্তৃপক্ষ ওই স্থানগুলোকে ক্রমাগত পরিষ্কার রাখার একটি ব্যবস্থা রাখবে। চীনে আমি নিজ চোখে দেখেছি, নগর পরিচ্ছন্নকর্মীরা হাতে ঝাড়ূ নিয়ে একটু পরপরই আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছে, যদিও এর পরিমাণ অতি কম। কেননা কেউ যদি আবর্জনা নিক্ষেপ করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। যেখানে আমাদের প্রায় সব নগরপিতা কেবল নিজস্ব দলীয় রাজনীতি নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, সেখানে তার দায়িত্বটি কে পালন করবেন, বুঝতে পারি না।
কাজেই যে আমি আকুল আগ্রহে ফিরে আসি যখনই দেশের বাইরে যাই, এ দেশের আকাশের ওপর দিয়ে বিমানটি নিচে নামতে থাকলে চোখ ভরে আসে জলে, সেই আমিই বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র সম্পূর্ণ আশাহত হয়ে যাই। আমার একটি আবেদন সব গণমাধ্যমের কাছে_ আপনারা অনুগ্রহ করে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে প্রতিজনের চারপাশটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার একটি আহ্বান আপনাদের ইলেকট্রনিক অথবা ছাপার মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরুন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার মতোই অনেকে ভাবেন। তারা দয়া করে শিক্ষিত করে তুলুন তাদের আশপাশের মানুষকে যেন সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের এই সুন্দর দেশটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। সব দাবির আগে প্রথম দাবি হওয়া উচিত, আমরা একটি পরিচ্ছন্ন দেশ চাই। কবে আসবে সেই দিন জানি না, যখন তীব্র ভালোবাসা নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে দেখব চারদিক ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেছে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
বেইজিংয়ে চার রাত কাটিয়ে গিয়েছিলাম কুনমিংয়ে। সেখানেও ভাষা নিয়ে কম কষ্ট পেতে হয়নি। তবে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল হোটেলের কর্তৃপক্ষ। সেখানেও আমরা একজন দোভাষীকে পেয়ে যাই। অতএব দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মেলে। ততদিনে, আমার যেমন স্বভাব, বাড়ি ফেরার জন্য মন কেমন করতে লাগল। কুনমিং বিমানবন্দরে রাত ১টায় আমি, সারা এবং আমাদের কন্যা শ্রিয়া যখন ঢাকার উদ্দেশে প্লেনে উঠলাম, তখন আমার মনে খুশি আর ধরে না। যেন কতদিন বাদে দেশে ফিরছি। বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টায় যখন ঢাকা বিমানবন্দরে হাওয়াই জাহাজ অবতরণ করল, তখন দৈহিকভাবে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ইমিগ্রেশন শেষে লাগেজ বহনকারী কনভেয়ার বেল্টের কাছে যখন এসে দাঁড়ালাম, তখন মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আলোর অপ্রতুলতা, মেঝের ওপরে কাগজ ছড়িয়ে পড়ে আছে যত্রতত্র, বাথরুমে যাওয়ার চেষ্টা করে ফিরে আসতে হলো দুর্গন্ধের জন্য। বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনার স্তূপ। সে এক হতশ্রী কাণ্ড। এই প্রথম নয়, যতবার বিদেশ থেকে বড় অস্থির হয়ে দেশের টানে ঢাকার বিমানবন্দরে এসে নেমেছি, ততবার আমাদের এই নোংরা পরিবেশ আমায় উত্ত্যক্ত করেছে। কেবল কি বিমানবন্দরে? ঢাকার রাস্তায় সর্বত্র আবর্জনার কোনো অভাব নেই। ঢাকার বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেটে ঢোকা অসম্ভব। অথচ এসব জায়গা পরিষ্কার রাখার জন্য কর্মী রয়েছে, যথেষ্ট কর্মী। তাহলে রাস্তাঘাট, সরকারি ভবন এসবের অবস্থা এমন বিচ্ছিরি কেন? অবশ্যই প্রথম দোষটি যায় কর্তৃপক্ষের ওপর। আমার মনে আছে, আমার জীবনে আমি একবারই ঢাকার মেয়রের দফতর 'নগর ভবন'-এ গিয়েছিলাম। সেখানকার মেঝের ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সিগারেটের খণ্ডাংশ, দেয়ালে পানের পিক অথবা চুনের দাগ দেখে আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসি। আমার ধারণা, ঢাকার তাবৎ পরিচ্ছন্নকর্মী ঢাকা পৌরসভার অন্তর্গত। অথচ পৌর পিতার দফতরই যদি এমন নোংরা থাকে, রাস্তাঘাট যদি হয় আবর্জনার আধার, তাহলে দেশকে যতই ভালোবাসি, কী করে মন উৎফুল্ল রাখি? তবে যদিও সাধারণভাবে আমরা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে এসব অব্যবস্থার জন্য দায়ী করতে পারি, এর সিংহভাগই কিন্তু বর্তায় আমাদের সাধারণ মানুষের উদাসীনতার ওপর। আমরা অবলীলায় অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, আমাদের উচ্ছিষ্ট এবং বর্জ্য সবকিছুই যত্রতত্র ছুড়ে ফেলি। আসলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষকে পরিচ্ছন্নতার ওপর নাগরিক চেতনা অথবা দায়দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো শিক্ষাই দেওয়া হয় না। এই শিক্ষার শুরু হওয়া উচিত বাল্যকাল থেকে। মানুষের রুচি এবং কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা বিলম্বে দিলে তার কোনো প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে না। অতএব আমরা অবলীলায় আবর্জনা নিক্ষেপ করি রাস্তাঘাটে। থুথু ফেলি যেখানে-সেখানে এবং যে আইন আমরা নিজেরাই আমাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা সৃষ্টি করি, তা ভঙ্গ করি নির্বিচারে। আজ যদি আমরা নিজেরাই সচেতন হয়ে উপরোক্ত অনভিপ্রেত কাজগুলো থেকে বিরত থাকি, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দ্বারাই সম্ভব দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। যে কোনো সরকার বা রাজনীতিবিদের প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে মানুষকে এসব নাগরিক চেতনা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। মাঝে মধ্যে দুঃখজনক হলেও সত্য বলে মনে হয় যে, আমাদের অনেক রাজনীতিবিদ নিজেরাই স্বেচ্ছাচারী, অপরিচ্ছন্ন এবং আইন ভঙ্গকারী। অতএব তারা কী করে সাধারণ মানুষকে এসব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলবেন, তা বোঝা কষ্টসাধ্য।
জনসাধারণের সমাগম যেসব স্থানে হয়ে থাকে সে জায়গাগুলোকে পরিষ্কার রাখার দুটি উপায়_ ১. আমরা নিজেরাই সচেতন হয়ে স্থানগুলোকে অপরিচ্ছন্ন করব না; ২. যথাযথ কর্তৃপক্ষ ওই স্থানগুলোকে ক্রমাগত পরিষ্কার রাখার একটি ব্যবস্থা রাখবে। চীনে আমি নিজ চোখে দেখেছি, নগর পরিচ্ছন্নকর্মীরা হাতে ঝাড়ূ নিয়ে একটু পরপরই আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছে, যদিও এর পরিমাণ অতি কম। কেননা কেউ যদি আবর্জনা নিক্ষেপ করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। যেখানে আমাদের প্রায় সব নগরপিতা কেবল নিজস্ব দলীয় রাজনীতি নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, সেখানে তার দায়িত্বটি কে পালন করবেন, বুঝতে পারি না।
কাজেই যে আমি আকুল আগ্রহে ফিরে আসি যখনই দেশের বাইরে যাই, এ দেশের আকাশের ওপর দিয়ে বিমানটি নিচে নামতে থাকলে চোখ ভরে আসে জলে, সেই আমিই বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র সম্পূর্ণ আশাহত হয়ে যাই। আমার একটি আবেদন সব গণমাধ্যমের কাছে_ আপনারা অনুগ্রহ করে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে প্রতিজনের চারপাশটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার একটি আহ্বান আপনাদের ইলেকট্রনিক অথবা ছাপার মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরুন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার মতোই অনেকে ভাবেন। তারা দয়া করে শিক্ষিত করে তুলুন তাদের আশপাশের মানুষকে যেন সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের এই সুন্দর দেশটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। সব দাবির আগে প্রথম দাবি হওয়া উচিত, আমরা একটি পরিচ্ছন্ন দেশ চাই। কবে আসবে সেই দিন জানি না, যখন তীব্র ভালোবাসা নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে দেখব চারদিক ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেছে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments