চিরঞ্জীব মোহাম্মদ ফরহাদ by গোলাম মোহাম্মদ ইদু
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, কর্মঠ নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ প্রয়াত হয়েছেন ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর। তিনি দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় যান এবং মস্কোর অক্টোবরস্কায়া হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে শোষণবিরোধী আন্দোলনে মুখর ছিল ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর অঞ্চল। সেখানে শুরু হয়েছিল তেভাগা আন্দোলন, যার ঢেউ সারা দেশকে আলোড়িত করেছিল। যাঁদের নেতৃত্বে সেই
আন্দোলন সফল হয়েছিল, সেই কমিউনিস্ট নেতা, গুরুদাশ তালুকদার, সুশীল সেন, হাজি মোহাম্মদ দানেশ, কম্পরাম সিং প্রমুখের প্রেরণাপ্রাপ্ত হয়ে শোষণমুক্তির আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন কিশোর মোহাম্মদ ফরহাদও। কলেজজীবনে লাইব্রেরি গড়া, বই পড়াই ছিল নেশা, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ বিপ্লবী অনীল রায়ের লাইব্রেরির বই কিশোর ফরহাদকে কমিউনিস্টকর্মী হতে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
দিনাজপুরে স্কুলে পড়ার সময়ই মোহাম্মদ ফরহাদ ছাত্রনেতার অভিধা পেয়ে যান। দল গঠন, আন্দোলন পরিচালনা_সব কাজেই তিনি যেন সিদ্ধহস্ত। দিনাজপুরে তাঁর আরেকজন প্রেরণাদাতা ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মির্জা নূরুল হুদা কাদের বখশ (ছোটি ভাই), যিনি পরে পিকিং লাইনে অবস্থান নেন। ছোটি ভাইয়ের সংস্পর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির দিশারি করে দেয় কিশোর ফরহাদকে। স্কুলজীবনে তিনি নাটক, আবৃত্তি ও বক্তৃতায় তুখোড় ছিলেন। সুকান্তের 'দিয়াশলাই' কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন বিএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের কিছু পরই, জুলাই মাসে। দেশে তখন আইয়ুব খানের সামরিক আইন চলছিল। দেশে সব দলের কার্যক্রম স্থগিত। দমবন্ধ অবস্থা, ধরপাকড়, জেল-জরিমানা, বেত মারা_নানা জুলুম চলছিল। এ অবস্থায়ই ফরহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা ও রাজনীতি করে গেছেন। তখন তিনি সাইকেলে যাতায়াত করতেন। এরই মধ্যে তিনি ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হন। ছাত্র ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ছাত্র ইউনিয়নকে গড়ে তোলার মূল কাজটি মূলত তিনিই শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে সহযোগী ছাত্রসংগঠনকে সক্রিয় করা এবং আন্দোলনে-মেলবন্ধনের কাজটি করতে থাকেন। তখন তাঁকে গোপনে অবস্থান করতে হয় এবং ছাত্র আন্দোলনের মূল কাজটিই তাঁকে করতে হয়। ছাত্রদের গোপন সভার স্থান নির্বাচন, গোপনে তাঁদের নিয়ে আসা, আলোচনার বিষয় নির্বাচন_এ সবই তাঁকে গোপনে থেকে করতে হতো। দীর্ঘদিন চেষ্টার পর ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দাবির মধ্যে ছাত্রদের মূল দাবি ছিল সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজবন্দিদের মুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত সর্বজনীন শিক্ষা। শাসকদের একগুঁয়েমির জন্য কোনো দাবিই কার্যকর হয় না। ফলে আন্দোলনও জোরদার হতে থাকে, সাধারণ মানুষও অংশ নিতে থাকে আন্দোলনে। এসবের রূপকার হিসেবে যাঁর নাম আগে আসে, তিনি হলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
ঢাকায় আসার কিছুদিন পর ১৯৬০-৬১-র মাঝামাঝি সময়ে তিনি দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদকের কাজ নেন এবং আন্দোলনের আহ্বানের সামনে চাকরিকে তুচ্ছ ভেবে ছেড়ে চলে আসেন দেশের তখনকার মূল কাজে_তা হলো সামরিক শাসন হটাও। আন্দোলনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। এখন আমরা যেটাকে বলি চিকামারা, সেই দেয়াললিখনের সিদ্ধান্তটিও আসে তাঁর কাছ থেকে।
সাংগঠনিক উদ্ভাবনশক্তির অধিকারী মোহাম্মদ ফরহাদ সংগঠনকে বৃহৎ আকার দেওয়া, শক্তিশালী করা এবং এর বিস্তার ঘটানো_এসব কাজ আনন্দের সঙ্গে করতেন। তখন দলের আর কারো মধ্যে এ রকম কর্মস্পৃহা দেখা যায়নি।
১৯৬৩ সালে গোপন পার্টিতে এবং সব বাম সংগঠনে আদর্শগত ভিন্নমত দেখা দেয়। ছাত্র ইউনিয়নকে এর বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন মোহাম্মদ ফরহাদ। ওই বছরই তিনি গোপনে থাকা পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরের একসময় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ হুলিয়া জারি করে, কিন্তু তিনি পরোয়া না করে হুলিয়া মাথায় নিয়েই ছাত্রদের নেতৃত্বদানসহ পার্টির কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়ন কমিটিতে না থাকলেও তাঁর পরামর্শেই সব ছাত্র আন্দোলন-সংগ্রাম চলত। তাঁর পক্ষে তা সম্ভবও ছিল। যেহেতু সব কিছু তাঁর নখদর্পণে ছিল, এ জন্য একাধারে পার্টির এবং ছাত্র ইউনিয়নের কাজ সুচারুভাবেই তিনি করে গেছেন।
১৯৬৪ সালে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এই দাঙ্গায় ইন্ধন জোগায়। সরকারের স্বভাবসুলভ কাজেরই অংশ ছিল এটি। এই দাঙ্গা প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন ফরহাদ। নিজের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে দাঙ্গাবিরোধী মিছিল শহরে নামান।
সমাজবদলে মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ একান্তভাবে প্রয়োজন। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তিনি সদস্য হয়েছিলেন। সংগঠনকে ধারণ, এর বৃদ্ধি, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা ইত্যাদি ব্যাপারে পার্টির কাজের বাইরে তিনি পরামর্শদান ও পথনির্দেশ করতেন।
কৃষক সমিতির কর্মকাণ্ডেও মোহাম্মদ ফরহাদ সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন। এ দেশে কৃষক আন্দোলন জঙ্গিপথ ধরে অগ্রসর হোক_তা তিনি চাইতেন না।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ছিল পার্টির প্রধান উদ্যোগ। এ জন্য পুরো পার্টিকেই যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়। কলকাতায় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরে নেতারা চলে গেলেও আগরতলার ক্রাফটস হোস্টেলের অভ্যর্থনা অফিসের দায়িত্বে থেকে যান মোহাম্মদ ফরহাদ। দেশ থেকে তাড়িত সর্বস্বহারা মানুষ, কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু যুবকদের তিনি গ্রহণ করে নিতেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের গৃহসংস্থান, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করতেন।
নারী আন্দোলনকে গণচরিত্রদানে তাঁর যথেষ্ট চেষ্টা ছিল। সংবিধানে নারীর অধিকার কায়েম হোক_এ নিয়ে তিনি আন্দোলন চাইতেন এবং তাঁদের দাবি নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিতেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে উন্মুক্ত মঞ্চে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। সেই কংগ্রেসের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সম্মেলন শেষে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মোহাম্মদ ফরহাদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। 'মাত্র' কথাটি উদ্ধৃত করার কারণ কমিউনিস্ট পার্টির মতো পোড় খাওয়া এবং দীর্ঘ পাথরচাপা সদ্যমুক্ত একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া এ বয়সে বিস্ময়করই। এই পদলাভের পেছনে ছিল তাঁর প্রজ্ঞা, একাগ্রচিত্ততা, সর্বহারা মানুষের মুক্তির স্পৃহা, বিচক্ষণতা, দেশের জন্য করণীয় এবং দরদ।
১৯৭২ সালে মোহাম্মদ ফরহাদের বিয়ে হয়। স্ত্রী প্রখ্যাত ছাত্রনেত্রী রীনা খান। তাঁদের দুটি সন্তান_একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ফরহাদের বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে যিনি গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, 'মামি, চোখ বন্ধ করে দিয়ে দাও। সোনার টুকরো ছেলে, এমন ছেলে আর হয় না।' জাতীয় রাজনীতিতেও মোহাম্মদ ফরহাদ ব্যক্তি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৮৬ সালে তিনি পঞ্চগড়ের বোদা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মোহাম্মদ ফরহাদ মাত্র ৫৯ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। মস্কোয় প্রয়াত এই ক্ষণজন্মা পুরুষের কফিন ঢাকার বিমানবন্দর থেকে এনে পার্টি অফিসে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে শেষশ্রদ্ধা জানাই আমরা।
মোহাম্মদ ফরহাদের চিরঞ্জীব স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সভাপতি
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
দিনাজপুরে স্কুলে পড়ার সময়ই মোহাম্মদ ফরহাদ ছাত্রনেতার অভিধা পেয়ে যান। দল গঠন, আন্দোলন পরিচালনা_সব কাজেই তিনি যেন সিদ্ধহস্ত। দিনাজপুরে তাঁর আরেকজন প্রেরণাদাতা ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মির্জা নূরুল হুদা কাদের বখশ (ছোটি ভাই), যিনি পরে পিকিং লাইনে অবস্থান নেন। ছোটি ভাইয়ের সংস্পর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির দিশারি করে দেয় কিশোর ফরহাদকে। স্কুলজীবনে তিনি নাটক, আবৃত্তি ও বক্তৃতায় তুখোড় ছিলেন। সুকান্তের 'দিয়াশলাই' কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন বিএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের কিছু পরই, জুলাই মাসে। দেশে তখন আইয়ুব খানের সামরিক আইন চলছিল। দেশে সব দলের কার্যক্রম স্থগিত। দমবন্ধ অবস্থা, ধরপাকড়, জেল-জরিমানা, বেত মারা_নানা জুলুম চলছিল। এ অবস্থায়ই ফরহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা ও রাজনীতি করে গেছেন। তখন তিনি সাইকেলে যাতায়াত করতেন। এরই মধ্যে তিনি ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হন। ছাত্র ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ছাত্র ইউনিয়নকে গড়ে তোলার মূল কাজটি মূলত তিনিই শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে সহযোগী ছাত্রসংগঠনকে সক্রিয় করা এবং আন্দোলনে-মেলবন্ধনের কাজটি করতে থাকেন। তখন তাঁকে গোপনে অবস্থান করতে হয় এবং ছাত্র আন্দোলনের মূল কাজটিই তাঁকে করতে হয়। ছাত্রদের গোপন সভার স্থান নির্বাচন, গোপনে তাঁদের নিয়ে আসা, আলোচনার বিষয় নির্বাচন_এ সবই তাঁকে গোপনে থেকে করতে হতো। দীর্ঘদিন চেষ্টার পর ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দাবির মধ্যে ছাত্রদের মূল দাবি ছিল সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজবন্দিদের মুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত সর্বজনীন শিক্ষা। শাসকদের একগুঁয়েমির জন্য কোনো দাবিই কার্যকর হয় না। ফলে আন্দোলনও জোরদার হতে থাকে, সাধারণ মানুষও অংশ নিতে থাকে আন্দোলনে। এসবের রূপকার হিসেবে যাঁর নাম আগে আসে, তিনি হলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
ঢাকায় আসার কিছুদিন পর ১৯৬০-৬১-র মাঝামাঝি সময়ে তিনি দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদকের কাজ নেন এবং আন্দোলনের আহ্বানের সামনে চাকরিকে তুচ্ছ ভেবে ছেড়ে চলে আসেন দেশের তখনকার মূল কাজে_তা হলো সামরিক শাসন হটাও। আন্দোলনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। এখন আমরা যেটাকে বলি চিকামারা, সেই দেয়াললিখনের সিদ্ধান্তটিও আসে তাঁর কাছ থেকে।
সাংগঠনিক উদ্ভাবনশক্তির অধিকারী মোহাম্মদ ফরহাদ সংগঠনকে বৃহৎ আকার দেওয়া, শক্তিশালী করা এবং এর বিস্তার ঘটানো_এসব কাজ আনন্দের সঙ্গে করতেন। তখন দলের আর কারো মধ্যে এ রকম কর্মস্পৃহা দেখা যায়নি।
১৯৬৩ সালে গোপন পার্টিতে এবং সব বাম সংগঠনে আদর্শগত ভিন্নমত দেখা দেয়। ছাত্র ইউনিয়নকে এর বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন মোহাম্মদ ফরহাদ। ওই বছরই তিনি গোপনে থাকা পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরের একসময় তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ হুলিয়া জারি করে, কিন্তু তিনি পরোয়া না করে হুলিয়া মাথায় নিয়েই ছাত্রদের নেতৃত্বদানসহ পার্টির কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়ন কমিটিতে না থাকলেও তাঁর পরামর্শেই সব ছাত্র আন্দোলন-সংগ্রাম চলত। তাঁর পক্ষে তা সম্ভবও ছিল। যেহেতু সব কিছু তাঁর নখদর্পণে ছিল, এ জন্য একাধারে পার্টির এবং ছাত্র ইউনিয়নের কাজ সুচারুভাবেই তিনি করে গেছেন।
১৯৬৪ সালে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার এই দাঙ্গায় ইন্ধন জোগায়। সরকারের স্বভাবসুলভ কাজেরই অংশ ছিল এটি। এই দাঙ্গা প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন ফরহাদ। নিজের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে দাঙ্গাবিরোধী মিছিল শহরে নামান।
সমাজবদলে মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ একান্তভাবে প্রয়োজন। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তিনি সদস্য হয়েছিলেন। সংগঠনকে ধারণ, এর বৃদ্ধি, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা ইত্যাদি ব্যাপারে পার্টির কাজের বাইরে তিনি পরামর্শদান ও পথনির্দেশ করতেন।
কৃষক সমিতির কর্মকাণ্ডেও মোহাম্মদ ফরহাদ সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন। এ দেশে কৃষক আন্দোলন জঙ্গিপথ ধরে অগ্রসর হোক_তা তিনি চাইতেন না।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ছিল পার্টির প্রধান উদ্যোগ। এ জন্য পুরো পার্টিকেই যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়। কলকাতায় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরে নেতারা চলে গেলেও আগরতলার ক্রাফটস হোস্টেলের অভ্যর্থনা অফিসের দায়িত্বে থেকে যান মোহাম্মদ ফরহাদ। দেশ থেকে তাড়িত সর্বস্বহারা মানুষ, কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু যুবকদের তিনি গ্রহণ করে নিতেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের গৃহসংস্থান, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করতেন।
নারী আন্দোলনকে গণচরিত্রদানে তাঁর যথেষ্ট চেষ্টা ছিল। সংবিধানে নারীর অধিকার কায়েম হোক_এ নিয়ে তিনি আন্দোলন চাইতেন এবং তাঁদের দাবি নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিতেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে উন্মুক্ত মঞ্চে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। সেই কংগ্রেসের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সম্মেলন শেষে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মোহাম্মদ ফরহাদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। 'মাত্র' কথাটি উদ্ধৃত করার কারণ কমিউনিস্ট পার্টির মতো পোড় খাওয়া এবং দীর্ঘ পাথরচাপা সদ্যমুক্ত একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া এ বয়সে বিস্ময়করই। এই পদলাভের পেছনে ছিল তাঁর প্রজ্ঞা, একাগ্রচিত্ততা, সর্বহারা মানুষের মুক্তির স্পৃহা, বিচক্ষণতা, দেশের জন্য করণীয় এবং দরদ।
১৯৭২ সালে মোহাম্মদ ফরহাদের বিয়ে হয়। স্ত্রী প্রখ্যাত ছাত্রনেত্রী রীনা খান। তাঁদের দুটি সন্তান_একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ফরহাদের বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে যিনি গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, 'মামি, চোখ বন্ধ করে দিয়ে দাও। সোনার টুকরো ছেলে, এমন ছেলে আর হয় না।' জাতীয় রাজনীতিতেও মোহাম্মদ ফরহাদ ব্যক্তি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৮৬ সালে তিনি পঞ্চগড়ের বোদা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মোহাম্মদ ফরহাদ মাত্র ৫৯ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। মস্কোয় প্রয়াত এই ক্ষণজন্মা পুরুষের কফিন ঢাকার বিমানবন্দর থেকে এনে পার্টি অফিসে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে শেষশ্রদ্ধা জানাই আমরা।
মোহাম্মদ ফরহাদের চিরঞ্জীব স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সভাপতি
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
No comments