নিত্যজাতম্‌-মেট্রো রেল প্রশ্নে বিতর্ক সর্বনাশ ডেকে আনছে by মহসীন হাবিব

খন থেকে আরো তিন বছর আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাংলাদেশে নিযুক্ত দূত ড. স্টিফেন ফ্রোইন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় এখন ঢাকা শহরের যানজট। একজন মানুষ পাঁচ-দশ মাইল রাস্তা পার হয়ে কোনো কাজ করতে গেলে তার সারা দিন চলে যায়। এ অবস্থায় একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।' গত তিন বছরে এই শহরে স্তূপের ওপর স্তূপ গড়ে উঠেছে, নতুন অসংখ্য বৈধ-অবৈধ ভবন
গড়ে উঠছে। আরো সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে রাস্তা-অলিগলি। এর মধ্যেই স্রোতের মতো ঢুকে পড়েছে আরো হাজার হাজার প্রাইভেট কারসহ নানা যান। ফলে এখন প্রায় সোয়া কোটি মানুষ বসবাসকারী বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ঢাকা শহরের গণপরিবহনব্যবস্থা অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। মুখে যে যা-ই তত্ত্ব উচ্চারণ করুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে কোনোক্রমেই এ শহরকে আর সচল রাখার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থায় শেষ চিকিৎসা হিসেবে কুইনাইন দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা হলো জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকার ৮০ শতাংশ অর্থ সহায়তায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয়ে উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রো রেললাইন স্থাপন করা। কারণ পৃথিবীর প্রায় সব মেগাসিটি মেট্রো রেলনির্ভর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জন্য তা আরো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ নিয়ে বাংলাদেশের চিরচেনা দুর্ভাগ্যজনক বিপত্তি দেখা দিয়েছে। আর সে দুর্ভাগ্য নিয়ে বিলাপ করাই আজ আমার লেখার উদ্দেশ্য।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এই রুট হওয়ার কথা ছিল বিজয় সরণি হয়ে। কিন্তু বিজয় সরণি দিয়ে রুট হলে জরুরি অবস্থায় (অর্থাৎ যুদ্ধকালীন অবস্থায়) তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আপত্তি জানিয়েছে। বিমানবাহিনী প্রস্তাব করেছে খামারবাড়ি হয়ে এই মেট্রো রেল নির্মাণের, নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যার প্রতি অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিমানবাহিনী এতে জনস্বার্থও অধিক রক্ষিত হবে বলে দাবি করেছে। তবে জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ খামারবাড়ি হয়ে মেট্রো রেল নির্মাণের বিষয়টি যথার্থই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'সংসদ ভবনের ২১৫ একর জায়গা নষ্ট হতে দেবেন না কোনোক্রমেই। বিষয়টি তিনি ২০ অক্টোবর সংসদের একাদশ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন। এই ঠেলাধাক্কায় যা প্রকট হয়ে উঠছে তা হলো, প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কারণ আগামী নভেম্বরের মধ্যে অবশ্যই এ প্রকল্পের অনুমোদন নিতে হবে জাপানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণচুক্তি হওয়ার সময়সীমা শেষ হবে। জাইকাও বিষয়টি নিয়ে স্বস্তিতে নেই। জাইকার কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে এ মাসের মধ্যেই একটি সিদ্ধান্ত দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, দু-চার দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে দেশ আবার একটি বড় প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হবে। বিগত দিনে আমরা শুধু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পের টাকা ফিরে যেতে দেখেছি। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা কতটা এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কতটা সমন্বয়হীনতা; প্রতিষ্ঠানগুলোর হর্তাকর্তারা নিজেদের সুবিধার ব্যাপারে কতটা নাছোড়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বর্তমান এ সংকট। ১৯৯৬ সাল থেকেই বাংলাদেশ মেট্রো রেলের স্বপ্ন দেখছে। সে সময় কানাডার একটি কম্পানির সঙ্গে আলোচনা হলেও বিভিন্ন শর্তের অসংগতির কারণে তা ভেঙে যায়।
মাত্র কয়েক দিন আগে বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে মেট্রো রেল তৈরি নিয়ে কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয় পাতায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন কনকর্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস কে লালা। ছোট নিবন্ধটিতে তিনি অত্যন্ত জোরালো কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর যুক্তিগুলো পড়ে প্রীত হয়েছি। তিনি তাঁর নিবন্ধে যা বলেছিলেন তার সারকথা হলো, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন ঘাঁটি তেজগাঁওয়ে থাকাটাই এখন অযৌক্তিক। জরুরি অবস্থা বলতে যেকোনো বহির্দেশের সঙ্গে যদি যুদ্ধের পরিস্থিতি হয়, তাহলে যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে শত্রুপক্ষ বারবার আঘাত হানতে চেষ্টা করবে বিমানঘাঁটি বা বিমান ওঠানামার স্থানে, এয়ার সিস্টেম ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। ফলে এমন ঘাঁটি বা উড্ডয়নস্থল এমন জায়গায় হওয়া উচিত, যেখানে জনবসতি কম। এ অঞ্চলে রয়েছে অসম্ভব ঘনবসতি। এখানে এমন জরুরি অবস্থা দেখা দিলে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা হবে ভয়াবহ।
তিনি আরো একটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন। আমাদের এই স্বল্প জায়গায় টিকে থাকার একমাত্র পথ এখন উঁচু ভবন নির্মাণ করা। যদি পুরনো বিমানবন্দরে ওঠানামার এ বিষয়টি বিদ্যমান থাকে, তাহলে ঢাকা শহরের একটি বিশাল এলাকায় কোনো উঁচু ভবন তৈরি সম্ভব হবে না। ফলে এ শহর একটি বামন শহরে পরিণত হবে।
বিষয়টি নিয়ে জনগণ কী ভাবছে, জনগণের প্রতিক্রিয়া কী, তা আর মুখে বলতে চাই না। বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন সংবাদের নিচে যে জনতার মন্তব্যগুলো আছে, বিভিন্ন ব্লগে যে মন্তব্য আছে, সেগুলো চোখ খুলে দেখলেই বাংলাদেশের মানুষের এ বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত কী, তা জানা যাবে। বহুদিন ধরেই মানুষের মধ্যে একটি চাপা আলোচনা শোনা যায় বিজিবি (আগের বিডিআর) সদর দপ্তর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের ভেতরে কেন, তা নিয়ে। তা-ই তো! এমন আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে যাওয়া একটি নগরীতে এত বড় একটি জায়গা নিয়ে শহরের ভেতর বিজিবির দপ্তর বসিয়ে রাখার কারণ কী? বরং বিডিআর বিদ্রোহের সময় জনগণ কী এক ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে বসেছিল, তা নিজ চোখে দেখেছি। সৌভাগ্য আমাদের, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ধৈর্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের সঙ্গে সংকট মোকাবিলার কারণে এক বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আমরা বেঁচে গেছি। শুধু বিজিবি সদর দপ্তরই নয়, সরকার ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা ভেবে দেখতে পারেন, সেনানিবাস ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে থাকা বর্তমান সময়ে কতটা যথাযথ। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, মেট্রো রেল কোথায় দিয়ে হওয়া উচিত, কোন পথ সবচেয়ে কার্যকর_এসব বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতই প্রাধান্য পাওয়া উচিত এবং সে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে দ্রুত। এ ক্ষেত্রে সরকার বা বিমানবাহিনী কারো গায়ের জোরের কিছু নেই বা থাকবে না।
পুনশ্চঃ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বরিশালে। শুধু একজন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা বিভাগীয় শহরে থাকবেন, সেই অনিচ্ছার কারণে এরশাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আমলাতন্ত্রের কারণে বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ অফিস মানিকগঞ্জ, সাভার, গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়ে উঠছে না। যে কারণে এই শহরও অচিরেই যানজট, পরিবেশদূষণ, বাড়িভাড়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না। আমলাদের সঙ্গে হিসাব-নিকাশে পেরে ওঠেন না রাজনীতিবিদরা। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমলা ছিলেন স্কুল ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে আর রাজনীতিবিদ ছিলেন ক্লাসের শেষ বেঞ্চে। অথবা হয়তো খাতায় নাম ছিল, ক্লাসেই যেতেন না রাজনীতিবিদ। জয়তু আমলাতন্ত্র!
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.